পোয়াতুরকুঠিবাসী প্রবীন মনসুর আলি মিঞা-র বয়ান (শেষ পর্ব), বোঝার সুবিধার জন্য ভাষার পরিবর্তন করেছেন সোমনাথ চৌধুরি, কোচবিহার, ১৫ সেপ্টেম্বর#
এদিকে এই অঞ্চলের মানুষতো বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় ছিট সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমাকে নিয়ে গিয়েছিল দাশিয়ারছড়াতে। আমি বলেছিলাম ‘মিথ্যে পরিচয় দিয়ে যাব না। দুই সরকার মিলে যাওয়ার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই মেনে নেব’। শেষ পর্যন্ত যার কাছে ভোটার কার্ড আছে তার সাথে গিয়ে পৌঁছালাম দাশিয়ারছড়াতে। গিয়ে দেখি সব ছিটের লোক জমা হয়েছে। মানুষ কাতারে কাতারে যাচ্ছে। মানুষ এসে বসে আছে রাত্রি ২টা ৩টা থিকে। আমি গিয়ে পৌঁছাইছি, সকাল তখন ৮টা বাজে। এত মানুষ আসছে ধারনার বাইরে আর আমাদের নেতা দীপ্তিমানকে দেখে মনে হয় ব্রাহ্মণ পুরোহিত বসেছে। অনুষ্ঠান শুরু হল বিকাল ৩ টার সময়ে। আমি শুনলাম একটা বৈশিষ্ট সব ছিটমহলেই আছে। প্রতিটা ছিটমহলের পাশেই নদী। জীবন নির্বাহের জন্যে আল্লাহ্ এমন করছে। আমি বলি কি নদীটাই আমাদের সরকার। নদীটাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে। গরীব মানুষে মাছ মারে, বাজারে বিক্রি করে তারপর খাবার জিনিস কেনে। আমাদের আবাদ ত করতেই হবে। এখানে আবাদ ভালোই হয়, জমি ভাল। কিন্তু ওই আল্লাহ্ যদি মারে — এই যে খরায়, ছড়ায় বিভিন্নভাবে আঘাত আসে কৃষির উপরে সেক্ষেত্রে কি করা যায়?
ওইপার থেকে তো আসতেছে শুনলাম ৯৭৯ জন, তাদের যে কি ব্যবস্থা করে।
এই ত গতবছরে দিনহাটা থেকে ক্লাবের সভাপতি চন্দন সেনগুপ্ত ফোন করে বলল ‘মনসুরদা আপনাকে পহেলা তারিখে আসতে হবে’
আমি বললাম ‘কেন?’
-‘না, প্রয়োজন আছে’।
-‘বলতে হবে আমাকে’।
-‘খেলাধুলা করতে হবে’।
-‘খেলাধুলা এই বুড়া বয়েসে করলে ত হাত পাও আর আস্ত থাকবে না’।
-‘দেখেন, আমি আপনার সিস্টেম জানি, আপনি পারবেন, নেতার হাত দিয়ে চিঠি যাবে’।
২০ তারিখ চিঠি দিল। আমি নাতিকে নিয়ে গেলাম। এই বুড়া বয়েসে একটা বডিগার্ড যাক সাথে। আমি তো গেলাম ১০টার আগেই। সঙ্গে সঙ্গে মাইকে আমার নাম ঘোষণা হল, ‘ছিটমহলের প্রবীন মনসুর আলি মিঞা এখানে উপস্থিৎ’।
সেখানে অতিথিদের যে বসার জায়গা আছে সেখানে বিডিওর পাশে ১টা চেয়ার বাদ দিয়ে আমাকে বসালো। তারপর আমাদের ২০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতা। ১ম চক্করে আমি ফার্স্ট, ২য় চক্করেও যখন অল্প বাকি তখন সবাই বলে, ‘মনসুর ভাই সাবধান, আপনার পাজামায় ঠেকে গেলে সর্বনাশ হবে’। আমি যদি আগে বুদ্ধি করে পাজামার তলাটা রবার দিয়া লাগাইয়া নিতাম তাহলে কাজ হত। ওই সাবধান হতে গিয়েই ৩য় হয়ে গেলাম। আমি ওখানে ৩টা পুরস্কারই পাইলাম। প্রথম পুরস্কার আতিথেয়তা গ্রহণের। দ্বিতীয়টা হল আমার হাত দিয়ে প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় প্রাইজ দেওয়া হইল। আর রাজা জগদ্দ্বীপেন্দ্রনারায়ণ ভূপবাহাদুরের সাথে যিনি ফুটবল খেলছিলেন তিনি আমাকে থার্ড হওয়ার পুরস্কার দিলেন। আর আমাকে এটাও বলছে যে যতদিন আমি জীবিত থাকব ততদিন হলের মাঠে আমার জন্যে একটা জায়গা থাকবে। সন্মান চাইলে পাওয়া যায় না। সন্মান দিয়ে সন্মান পেতে হয়।
আমাকে কলকাতা থেকে একটা শাল দিয়েছিল, আমি পরি নাই। কলকাতা থেকে ফোন করল ‘মনসুরদা শাল গায়ে দিছেন?’ আমি বলেছিলাম ‘যেদিন সত্যিকারের স্বাধীনতা পাব সেদিন গায়ে দিব’।
শেষপর্যন্ত আমরা স্বাধীনতা পেলাম। আমাদের জীবন তো কেটেই গেল, আমাদের নাতি নাতনিরা স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়াবে মাথা উঁচু করে। আমরা ৬৮ বছর দুই দেশের মধ্যে বেঁচে ছিলাম, পরিচয় ছিল না। আগামী প্রজন্মকে অন্তত সেই ব্যাথা সহ্য করতে হবে না।
Leave a Reply