ব্যাসদেব বোস, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৩ মে#
১
১২ মে ২০১৫ দুপুর সাড়ে বারোটা। মেদিনীপুর জেলা আদালত চত্বর এখন কৌতুহলী ভিড়ের উষ্মা এবং ব্যতিব্যস্ত হয়ে তা সামালের ভার প্রশাসনের। এবং ততোধিক ব্যস্ততায় মিডীয়ার ছাতাগাড়ি জেনারেটিং সিস্টেম চেক করায়। খবরওয়ালাদের দৌড়োদৌড়ি। অবশ্য এর কিছুক্ষণ আগে সকাল ১১ টা ৫০ মিনিট নাগাদ ছত্রধর সহ ছয় লালগড় আন্দোলনের শরিক বিচারাধীন বন্দীকে আদালতে নিয়ে আসা হয়েছে। সে সময় রাজা সরখেল ও প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বিবৃতি সাংবাদিকদের কে উদ্দেশ্য করে এবং তা পুলিশে ছিঁড়ে ফেলাকে কেন্দ্র করে তর্কে জড়ায়। এবং তা মিডিয়ার হাতে পৌঁছয়। এই ছিল সকাল বেলার ছবি।
কোর্ট চত্বরের প্রথম গেট ও দ্বিতীয় গেটের মধ্যেকার রাস্তা দুদিক দিয়ে পুলিশ ব্যারিকেডে মোড়া। অন্য দিনের তুলনায় পুলিশ মোতায়েনও একটু বেশি। কথা ছিল, রায়দান হবে দুটোর পরে। কিন্তু তা হলো বিকেল পাঁচটায়। চারটে চল্লিশ নাগাদ প্রেস কর্মীদের কোর্টের পক্ষ থেকে ব্যরিকেড লাগোয়া দাঁড়াতে বলা হয়। তার আগে অবশ্য পুরোটাই প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকে স্লোগান দিতে দিতে নামে ছত্রধর মাহাতো রাজা সরখেল সহ ছয়জন। বিচারের নামে প্রহসন মানছি না মানবো না। এবং গান ধরেন। আমরা ক্ষুদিরামের ভাই। আমরা ভগৎ সিং-এর ভাই। আমরা দেশের কাজে জেল-এ গেছি, অন্য কাজে নাই। ১২১ ও ১২৪ ধারায় ছত্রধর মাহাতো সুখশান্তি বাস্কে শম্ভুনাথ সোরেন ও সাগেন মুর্মুকে ইউএপিএ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন ঘোষণা করেন। এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার একই ধারায় রাজা সরখেল প্রসূন চট্টোপাধায়েরও যাবজ্জীবন হয়।
প্রিজন ভ্যানে ওঠার সময় ছত্রধরন মাহাতো বিচারক্রিয়ার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি নির্দোষ। প্রমাণ ছাড়াই শাস্তি দিচ্ছে। সাজানো সাক্ষী দিয়ে মামলা সাজানো। এর জবাব জঙ্গলমহলের মানুষ দেবে।
গাড়ি যখন বেরোচ্ছিল, সাংবাদিকদের ভিড়ের একটু দূরেই জটলা মানুষদের ভেতর থেকেই ছত্রধরের সমর্থনে একজনকে বলতে শুনলাম, ছত্রধর যা বলে খাঁটি। বন্দীমুক্তি কমিটি বা এপিডিআর কর্মীরা প্রিজন ভ্যানকে ঘিরে ফেলে বেশ কিছুক্ষণ স্লোগান দিতে থাকে।
গত বিধানসভা নির্বাচনে ভোটে দাঁড়িয়েছিল ছত্রধর। এদিন অবশ্য ২০১১ বিধানসভায় ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে কুড়ি হাজার সাঁইত্রিশ ভোটের ভোটদাতাদের তেমন কাউকে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি কমিটির আন্দোলনের প্রথম সারির সেই সব ব্যক্তিদের, যারা এখন তৃণমূল শাসক দলের তাবড় তাবড় নেতা। ছত্রধরের সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী শ্যামল মাহাতো লালগড় পাঁচ নম্বর অঞ্চলের সভাপতি। দিলীপ মাহাতো তৃণমূলে নাম লিখিয়ে ধরমপুর এলাকার দাপুটে নেতা এখন। জামিনে মুক্ত মনোজ মাহাতো অসিত মাহাতো সরে পড়েছে। এবং তৃণমূলে ভিড়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, তৃণমূলের বশ্যতা স্বীকার করেছে। ছত্রধর বা তার পরিবার প্রত্যক্ষভাবে বর্তমান সরকারের বশ্যতা না মানায় এই পরিণাম — এই মত অবশ্য তৃণমূলের একাংশেরই। উল্লেখ্য, সুচিত্রা মাহাতো জাগরি বাস্কের মতো মাওবাদী নেত্রী সরকারের বশ্যতা স্বীকার করায় যারা আজ প্রশাসনের ছত্রছায়ায় চাকরি ও পুনর্বাসন নিয়ে দিব্যি রয়েছেন।
২
ছত্রধরদের যে যাবজ্জীবন হয়েছে, জঙ্গলমহলের ক-জনই বা তা জানে! কেউই খুব মুখ খুলছে না। ওদিকে ছত্রধরের যাবজ্জীবন ঘোষণার দিনই রাতে ঝাড়গ্রামে রাজবাড়িতে এসে থাকলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাকে দেখার জন্য বা তার কাছে আব্দারের জন্য আগের ক’বার যে ভিড় লেগেছিল, এবারে সেসব কিছু চোখে পড়ল না।
Leave a Reply