লাঁভোলি(l’envolée) পত্রিকা ও বেতারকেন্দ্রের তরফে বন্দীর সাথে কথোপকথনের অনুলিখন পাঠিয়েছেন আর্থার সেস্যু। ২৮ জানুয়ারি, ২০২১।#
ফ্রান্স তথা ইউরোপে বৈধ ভিসা ছাড়া কোনো বিদেশিকে নথিভুক্ত নয় বলে খালাস করে দেয় রাষ্ট্র ও তার প্রশাসন। তারা না পায় কাজ, না সামাজিক সুরক্ষা, এমনকি ঘরোয়া বাজারে কেনাকাটা করার অধিকারটুকু। বাসে-ট্রেনে-কাজের জায়গায় এমনকি ভিসা আবেদনের লাইন থেকে যে কোনো সময় তাদের গ্রেফতার করে শরণার্থী শিবিরে ঢোকানো কিম্বা জোর করে সীমানার বাইরে ফেরৎ পাঠানো চলতেই থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সীমান্তরক্ষীদের প্রথম লক্ষ্য থাকে অ-সাদা মানুষরা। ফি-বছর চল্লিশ হাজার এমন মানুষ গ্রেফতার হন যার অর্ধেককে ফেরৎ পাঠানো হয়। শরণার্থী শিবিরগুলিতে ক্যামেরা ও মিডিয়ার আড়ালে পুলিশি অত্যাচারই দস্তুর। এমনই এক শরণার্থী শিবিরের মহিলারা আমাদের বেতারকেন্দ্রে তাদের অভিযোগের কথা জানাতে যোগাযোগ করেন। ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গায় এই বেতারকেন্দ্রটি জেলখানা, শরণার্থী শিবির, অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিশেষ শিবির, মানসিক হাসপাতালের বন্দীদের আওয়াজ শুনিয়ে আসছে প্রায় বিশ বছর যাবৎ। এই সমস্ত জায়গায় তাদেরই ধরে রাখা হয় যারা একালের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় খাপ খায়নি ঠিকঠাক। হয় তাদের থেকে কাম্য উৎপাদন তারা যোগাতে পারেনি নতুবা তারা তা করতে চায়নি। প্যারিস বিমানবন্দরের পরেই মেলিন আমেলো’র শিবিরের এক মহিলা, পুলিশের দেওয়া স্যানিটরি ন্যাপকিন ব্যবহার করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বন্দীরা মরিয়া হয়ে জরুরী বিভাগের কাউকে তলব করতে থাকেন। দেশে ফেরার জন্য কোভিড টেস্ট করাতে না চাওয়ায় তাদের উপর বেজায় খাপ্পা পুলিশ প্রশাসন।
সুপ্রভাত ম্যাডাম। ফোন করার জন্য শুকরিয়া। সবকিছু ঠিকঠাক?
- যে চাপ টা গেল, তারপর আছি ওই একরকম…
আজ কি বিশেষ কিছু বলার জন্য ফোন করেছেন?
- হ্যাঁ, এই তিনদিন যে ধকল টা গেল! ঘটনাটা পরশু দিনের। কিন্তু এতটাই মুষড়ে গেছি যে ভাবলাম কয়েকজনের সাথে ভাগ করে নিয়ে একটু হালকা হই।
হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন। পুরোটা খুলে বলুন। আমরা শুনছি।
- আমাদের এই মেয়েদের রিটেনশন সেন্টারে নানারকম মেয়েদের সাথে আমরা মিলেমিশে থাকি। অনেকেই ফরাসী জানে না, যেমন ওই আলবেনিয়ান মেয়েটা, ইংরিজি জানে কিন্তু, দিন দুই আগে আমার কাছে আসে। আমিও খুব বেশি ফরাসী জানি না। তবে কাজ চলে যায়। মেয়েটা বলতে এসেছিল যে তার পিরিয়ড হয়েছে, কয়েকটা স্ট্রিপ দরকার, আমি যদি তার সাথে একটু পুলিশের কাছে যাই, কয়েকটা ন্যাপকিন চাইতে। ওর সাথে গিয়ে এক মহিলাকে ধরি। বলি যে, মেয়েটার মাসিক চলছে, কয়েকটা প্যাড যদি দেন। শুনে মোটে দুটো পটি দিল। আমার সাথের মেয়েটা খুব করে বোঝতে চাইল, মাত্র দুটো স্ট্রিপ দিয়ে সে কী করে চালাবে! কিন্তু মহিলা পুলিশ এমন ধমকালেন যে মেয়েটা ভয় পেয়ে গেল। আমরা ফিরে এলাম। একদিন পরে সে দুটো গামছা ছিঁড়েই কাজ চালাল। তাতেও কুলালো না। আবার এল আমার কাছে মেয়েটা, যদি আমার কাছে দুটো স্ট্রিপ মেলে। আমার কাছে একটাও ছিল না। ফলে মেয়েটা নিজের জামাকাপড় ব্লাউজ ছিঁড়ে ব্যবহার করতে শুরু করল। তখন তার মাথায় ছিল না যে ওগুলো থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। যা হবার তা’ই। তলপেট আর কোমর জুড়ে যন্ত্রণা শুরু হল। ভয়ানক কান্নাকাটি জুড়ে দিয়ে মেয়েটা আমায় এসে বলে, খুব ব্যথা করছে, আর পারছি না। মেঝেয় পড়ে আছাড়িপিছাড়ি কাঁদতে থাকে মেয়েটা। এখানকার সব কটা বাড়িতেই একটা করে বোতাম থাকে, চাপ দিলে থানায় ঘন্টি বাজে। আমরাও ওটা বাজিয়ে পুলিশ ডাকতে চেষ্টা করলাম। পুলিশ জবাব দিল, ‘ওসব আলফাল কাজ করতে আমরা আসিনি। চুপ করে বসে থাক’। মেয়েটা আবার কাঁদতে শুরু করল। ভাবলাম, এরকম তো হয়ই, হয়তো কমে যাবে। তাছাড়া আমাদের কাছে পেইনকিলারও ছিল না। মেয়েটা কাঁদতেই থাকে। যত সময় যায়, দেখতে পাচ্ছিলাম, যন্ত্রনায় ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। চোখের জ্যোতি হারাচ্ছে। সেই সাথে ধুম জ্বর। সবাই ভয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না কেউই। ওদিকে মেয়েটা মেঝেয় শুয়ে ছটফট করছে। কিছুক্ষণ বাদে শুরু হয়ে গেল…ওই কী যেন বলে তোমাদের ভাষায়…
খিঁচুনি?
- হ্যাঁ হ্যাঁ…এমন সময় আমার এখানকার এক বন্ধু আমায় ফোন করে, যাকে বেশ কিছুদিন আগে আমি ঘরে ফিরিয়ে এনেছিলাম, সবটা শুনে বন্ধুটি আমায় বলে, দাঁড়াও, তোমাকে জরুরী বিভাগের একটা নাম্বার দিচ্ছি। এক দমকল কর্মী ফোন ধরলেন। তাকে সবটা জানিয়ে এটাও বললাম যে, আমরা ফোন করেছিলাম- একথা যেন এখানকার পুলিশকে না বলে । নইলে ভোগান্তি আছে কপালে। যথারীতি এলেন দমকলপুলিশ। ঢোকার মুখে ওদের সাথে খানেক কথাবার্তা হয়ে গেল। বোঝা যাচ্ছিল যে জেল-পুলিশ চাইছে না, এরা ভেতরে যাক। শেষমেশ ভেতরে আসতে পারল, কেননা, এর মধ্যেই একজন এসে দেখে গেছিল, মেয়েটার অবস্থা খুবই সঙ্গীন। মেঝেয় পড়ে। রক্তচাপ কমে গেছে। আর খুবই জ্বর। মেয়েটাকে ওরা নিয়ে যাবার পর আবার পুলিশ এল। আমার ঘরের দরজাটা আগে থেকেই ভাঙা। এই ঠান্ডায় ওই ঘরে শোয়া…পুরো জমে যাই যেন…একে তো ভালো করে খেতে পাই না, তারপর এই ঠান্ডার মধ্যে শোয়া, আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে কী যে হবে…ভাবতে ভাবতেই অসুস্থ লাগছিল। পুলিশ এসে বিড়বিড় করছিল, দমকলে ফোন করা, না? ঠিক আছে, দেখা যাক। তারপর সোজাসুজি আমাকেই প্রশ্ন, ‘তুই তো সবার থেকে একটু ভালোই ফরাসী জানিস। তুইই করেছিলি ফোনটা, না?’ আমি বললাম, ‘মোটেই না। মেয়েটা নিজেই করেছিল। ওর শরীরের মধ্যে কী হচ্ছে আমি বুঝব কী করে?’ একটা মেয়ে পুলিশ তেড়ে এল। এক চড় কষাতে। আমি চুপ করে যাই। ঘরে ঢুকে পড়ি। ‘-বেশ। কোভিড পরীক্ষা না করালে তিন মাস জেলে থাক’। ভোর চারটের দিকে ওরা ফের আমার ঘরে ঢোকে। দরজা যেহেতু ভাঙা, জানিয়ে ঢোকার প্রশ্নই নেই। আমি ধড়ফড় করে জেগে উঠি বিছানায়। ইতিমধ্যে ওখানে তখন…(টেলিফোন সমস্যা)। আমি ঠাওর করতেই পারছিলাম না ওরা আমার সাথে এখন কী করতে চাইছে। একজন পুলিশ বাইরে। মেয়ে পুলিশটা ভেতরে। ‘কাল তোকে ট্রান্সপ্লান্ট অফিসে যেতে হবে’। -‘কিন্তু কেন?’- জানতে চাইলাম আমি। ‘আমায় প্রশ্ন করার কে তুই? কাল তোকে রেজিস্ট্রিতে যেতে হবে। ব্যস’। মেয়ে পুলিশ বলে চলে, ‘কালই করাতে হবে, কারণ তোর জন্য একটা বিমানের ব্যবস্থা হয়েছে’। আমি বললাম, ‘না, আমি টেস্ট করাতে যাব না’। -‘দ্যাখ, না যাওয়ার হিম্মত যদি থাকে, দ্যাখ ওরা কী করে তোর সাথে’। সকাল দশটার দিকে হাসপাতাল থেকে ফোন আসে। আমি যাইনি। অন্যান্য শরণার্থী শিবিরে থাকা আমার ছেলে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি ফোনে। ওরাও জানায়, না, কিছুতেই আমরা টেস্ট করাতে যাব না। কয়েক মিনিট বাদে ওরা চারটে পুলিশ পাঠায়। আমি যাব না বলায় ওদের একজন বলে, ‘বেশ, যদি না যাস, তিন বছরের জেল’। রাতে এরাই এসেছিল আমায় চাপ দিতে। মেয়ে পুলিশটা তো রীতিমত ধাক্কাধাক্কিও করছিল। বলছিল, ‘এই নিয়ে দু’বার তুই ফেরার বিমান ধরলি না। এবার তোর পাহারার ব্যবস্থা করছি। কারণ টেস্ট তোকে করাতেই হবে’। আমি বলি, ‘কিছুতেই না। আমার শরীর, আমি বুঝব। তাছাড়া কোভিডের কোনো লক্ষণও নেই আমার শরীরে’। যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছিল ওরা। আজ সন্ধে ছটা নাগাদ অন্যদিনের মতই খেতে যাই। লাইন দাও, কার্ড দেখাও, খেতে বসো। সেই মেয়ে পুলিশটা খাবার ঘরে আমায় দেখতেই বলে ওঠে, আজ তোদের গান গাইতে হবে খাওয়ার আগে। -‘গান গাইব! সে আবার কোন গান!’ জবাব আসে, ‘আজ আমাদের রাঁধুনিকর্তার জন্মদিন। এক এক করে ভেতরে গিয়ে তিনবার করে হ্যাপি বার্থডে গাইবি, তবে এসে খেতে পাবি। যদি না গাস, খাবার বন্ধ’। সেই অসুস্থ মেয়েটিও ছিল আমাদের সাথে, যাকে আজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পুলিশ মেয়েটির দাবী ওকেও গাইতে হবে। অসুস্থ মেয়েটি বলে, ‘খুবই যন্ত্রণা করছে। গান গাইতে পারছি না’। সাথে সাথে ওরা ওর খাবার কেড়ে নেয়। এমনিতেই তো যা ছাইপাশ খেতে দেয়, মুখে দেওয়া যায় না। আমরা রুটি ঘরে নিয়ে আসি। রাতে খিদে পেলে জল খেয়ে রুটি খেয়ে ঘুমিয়ে রাত কা্টিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আজ আর কাউকে ঘরে রুটি নিয়ে যেতে দিল না, যদি ওই অসুস্থ মেয়েটিকে দিয়ে দিই! সেই সকাল থেকে খায়নি মেয়েটা, তার উপর নাকি গান গাইতে হবে! আমাদের কাছে টাকাকড়ি নেই। কোথায় যাব, কী করব কোনো নিশ্চয়তা নেই। হ্যাঁ, আমরা ভুল করেছি। সবাই জীবনে কখনো না কখনো ভুল করে। দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়ারও অধিকার আছে আমাদের। (টেলিফোন সমস্যা) …আরো দুজনের সাথে আছি।
কেমন আছেন তারা?
- শক্ত থাকার চেষ্টা করছি। চেষ্টাই করছি। ওই মেয়েটা খুবই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। ওকে আমরা কিছু ওষুধ দিয়েছি, যেগুলো ওকে রাতে খেতে বলেছে। কিন্তু কিছুই তো পেটে পড়েনি সারাদিন। রক্ত নেই শরীরে কিচ্ছু। এদিকে আমার কাছেও কোনো সোয়েটার নেই। দুটো জামা গায়ে দিয়ে সেই বেরিয়েছিলাম, আড়াই মাস হয়ে গেল। ছিঁড়ে গেছে। শরীর ঢাকা যায় না, সেই দুটোই গায়ে জড়ানো এখনো। আমাদের ওখানে যুদ্ধ লেগে যাওয়ায় দুটো জামা গায়ে দিয়েই ঘর ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। আর এই হাড় কাঁপানো ফ্রান্সের ঠান্ডা। কী করে যে বেঁচে আছি কে জানে!
Leave a Reply