অলকেশ মন্ডল, বীরগঞ্জ-বদ্রীবাস, নেপাল থেকে ফিরে, ৭ অক্টোবর#
গত প্রায় দুই মাস ধরে নেপালে অশান্তির বাতাবরণ বিদ্যমান। নতুন সংবিধান কবে চালু হবে এই নিয়ে অনেক কল্পনা-জল্পনা ছিল। সংবিধানের খসড়া নিয়েই মধেসী বা তরাই অঞ্চলের জনগনের আপত্তি ছিল। দুটি দাবি লোকমুখে ফিরছে। তরাই এর যে সব এলাকা প্রাদেশিক বিন্যাস অনুযায়ী পাহাড়িরা নিজ অধিকারে রেখেছে তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এই প্রাদেশিক বিন্যাসের দাবি অনুযায়ী নতুন ‘মধেস প্রদেশ’ গঠন করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। অন্য একটি বিধান অনুযায়ী মধেসী পুরুষ ভারতীয় মেয়ে বিয়ে করলে নতুন প্রজন্মকে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হয়ে থাকতে হবে। সরকারী কোনও উচ্চপদে তাঁর আসীন হবার কোনও সম্ভাবনা রাখা হয়নি। মধেসীরা নতুন সংবিধানে তাঁদের আত্মজদের সমানাধিকার কেন নেই এই প্রশ্ন তুলেছে। এসবের মীমাংসা না করেই সদ্য সংবিধান পেশ হয়েছে। এইবার নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হতে চলেছে। কিন্তু মধেসীরা নাগরিকের সমানাধিকারের দাবিতে অটল। কাঠমান্ডুতে নেতাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চললেও সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি। সেই কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। ভারত থেকেই নেপালে সড়কপথে যাবতীয় জিনিষপত্র আমদানি হয়। এবং সমস্ত বর্ডার তরাই অঞ্চলে। সেই তরাইয়ে সড়ক অবরোধ চলছে। মাঝে কয়েকদিন কার্ফু জারি করে ট্রাক বা অন্য বাহন চালালেও তা মধেসী আন্দোলনকারীদের চাপে পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে। সমতলে বাস, ট্রাক, বা অন্য প্রাইভেট গাড়ি সম্পুর্ণরূপে বন্ধ। বীরগজ্ঞ বর্ডার থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে সিমরা থেকে কিছু যানবাহন চলছে। তবে তাও কেবলমাত্র কাঠমান্ডুর দিকে। অন্য বিভিন্ন দিকে যাতায়াতের সুযোগ প্রায় নেই। মানুষ মোটর সাইকেলে যাতায়াত করছে। মোটরসাইকেলে মানুষ পরিবহন এখন ভালো ব্যবসা। কুড়ি কিলোমিটার পৌঁছে দেবার বিনিময়ে দুশো থেকে পাঁচশো টাকা কামাচ্ছে। এদিকে তেল অমিল বলে রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যাও ক্রমহ্রাসমান। অন্যত্র ভারতীয় বর্ডার এলাকাগুলোতে একই চিত্র।
সম্প্রতি রক্সৌল-বীরগজ্ঞ বর্ডারের মাঝে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’এ মধেসী আন্দোলনকারীরা তাঁবু টাঙিয়ে তাদের লাগাতার বিরোধ প্রদর্শন জারি রেখেছে। অবস্থানকারীদের খানা-পিনার জন্য লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে ভারতের দিকে কাস্টম অফিসের পিছনে। সাইকেল মোটরসাইকেল ছাড়া খুব অল্প সংখ্যায় রিক্সা যাতায়াত করছে। কোনও রসদ ভারত থেকে নেপালে না যেতে পারে তার ব্যবস্থা পাকা। পাহাড়িরা মধেসীদের যতক্ষণ তাদের সমানাধিকার না দিচ্ছে ততক্ষণ এই অবরোধ চালাতে তারা বদ্ধপরিকর। এই অবস্থায় ভারত থেকে তেল গ্যাস সহ যাবতীয় কাঁচামালের যোগান বন্ধ। নেপালের অধিকাংশ কারখানা বন্ধ। এই অসহনীয় অবস্থাতেও দাঁতে দাঁত চেপে নিজেদের অস্তিত্বের লড়াই চালাচ্ছে মধেসীরা। মধেসীদের এই অবরোধকে অধিকাংশ টিভি চ্যনেলে ‘ভারত দ্বারা নাকাবন্দী’ বলে ব্যক্ত করা হচ্ছে। ভারতীয় টিভি চ্যানেল বন্ধ করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। পাহাড়ের নেতাগণ ভারতকে শত্রু বলে চিহ্নিত করতে শুরু করেছে। সেই সুর আমজনতার মুখেও ফিরছে। পাহাড়ী ও মধেসীরা এখন যেন পরস্পরের শত্রু। তরাইয়ের এফ এম চ্যানেলগুলো স্পষ্ট দু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। ন্যাশনাল চ্যনেলে সরকারী বয়ান। আবার ভোজপুরি সহ কয়েকটা চ্যানেল যা শুধু তরাইয়ে চলে- তারা মধেসী আন্দোলনের পক্ষপাতী। তার শ্রোতারাও সব মধেসী এবং ভারতীয়রা। সেখানে মধেসীদের অধিকারের পক্ষে আবিরাম কথা চলছে।
মাঝে বাজার বন্ধ থাকলেও এখন বিকেলের দিকে বীরগজ্ঞে সব্জির বাজার বসছে। দোকানপাট অল্প সময় হলেও খুলছে। জিনিষপত্রের দাম ক্রমশঃ লাগামছাড়া হচ্ছে। অনেক কিছুই ক্রমশঃ অমিল হচ্ছে। দোকানের সামনে খালি গ্যাস সিলিন্ডার জমা হচ্ছে। তবে নেপালে জ্বালানীর অভাব নেই। কিন্তু বড়লোকেদের অসুবিধা। ব্যবসাদারদের মধ্যে ভয়ও রয়েছে। মিছিল আসতে দেখলে দোকানের সাটার বন্ধ করে দিচ্ছে। মধেসীরা অনেক দল মিলে এই বন্ধ-অবরোধ চালাচ্ছে। তার মধ্যে কোনও এক দল যদি হামলা করে? হামলাও চলছে বিক্ষিপ্তভাবে। দোকান বা গাড়ি ভাঙচুরের খবর আসছে। সদ্য কেনা ব্যটারিচালিত গাড়িকেও রাস্তায় লোকবহনের অপরাধে ভেঙে দিয়েছে। সুতরাং আতঙ্কেরও পরিবেশ বিদ্যমান।
গত ২ অক্টোবর মোটরসাইকেলের পিছনে বসে বীরগজ্ঞ থেকে সিমরা যেতে গিয়ে বাধা পেলাম। দুটো প্রধান রাস্তা সহ সমস্ত ছোটো অলিগলি দিয়ে যাতায়াত বন্ধ। মধেশীরা কয়েক কিলোমিটার মানববন্ধন করে দাঁড়িয়ে গেছে। এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হল। মাঝে মাঝে এইরকমভাবে অথবা মোটরসাইকেল এবং ট্রাক্টরের ট্রলিতে লোকজন চেপে মিছিল করে ‘জয় মধেস’ ধ্বনি দিয়ে বিরোধ প্রদর্শন চালাচ্ছে। সমতলের স্কুল-কলেজ বন্ধ। আমজনতার দিনমজুরির সুযোগও নেই। যাদের সুযোগ বা সামর্থ্য আছে তারা কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে ভারতে নিজের বা আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গেছে।
আগের বারের মতো সিমরা থেকে ট্রাকে বদ্রিবাস রওনা দিলাম। এবারের ট্রাক ড্রাইভার পথের মানুষদের লিফট দিয়ে ভালোই হাতখরচা ওঠালেন। পড়ন্ত বিকেলে ফুলজোর জঙ্গল থেকে এক যুবক হেলমেট হাতে গাড়িতে উঠল। কান্নামুখে ড্রাইভার ও ট্রাকে সওয়ার অন্য যাত্রীদের জানালো যে তার বাইক ছিনতাই হয়ে গেছে। তিনজন যুবক পিস্তল দেখিয়ে বাইক নিয়ে একটু আগেই বেরিয়ে গেছে। এই অঞ্চলেই মাসখানেক আগে ট্রাকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে এখনও সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ জঙ্গলের দুই দিক থেকে ‘এসকর্ট’ করে ট্রাক বাস বা অন্য গাড়ী পার করানো হয়। একা এই রাস্তায় চলা উচিত হয়নি বলে সবাই যুবকটিকে দোষারোপ করল। থানায় অভিযোগ দায়ের করা ছাড়া অন্য কিছু করার নেই। বাইক পাবারও আশা নেই বলেই বেশিরভাগের অভিমত। বন্ধের সুবাদে এইরকম চুরি-ছিনতাই এর ঘটনা বাড়ছে। পুলিশ প্রশাসনও অনেকটা নিস্ক্রিয়। এর আগে ‘থারু’ আন্দোলনকারীরা পুলিশকেও পিটিয়ে মেরেছে। তাই তারাও সতর্ক হয়ে দল বেঁধে নাম কা ওয়াস্তে ডিউটি করছে।
অসুবিধা সকলেরই। ভারতীয় বা নেপালী যত গাড়ী রাস্তায় অবরোধের কারণে দাঁড়িয়ে আছে তার ড্রাইভার খালাসীদের বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা নেই। বিদেশ থেকে যারা বিমানে কাঠমান্ডুতে নামছে গ্রামের বড়িতে ফিরতে খুবই অসুবিধা হচ্ছে। আমজনতার রোজগার নেই। সামনে দশেরা দ্বীপাবলি মহরম ও ছটপুজো। আর কতদিন এইভাবে চলবে তার উত্তর কারও জানা নেই। আন্দোলনকারিদের দাবি না মানলে বন্ধ-অবরোধ চলতে থাকবে। উৎসবের মরশুমটা আদৌ আনন্দে কাটবে কি না তা এখনও অনিশ্চিত। আর কয়েকদিনের মধ্যে নতুন সংবিধান মোতাবেক নতুন সরকার গঠন হবার কথা। নেপালি জনগন এখন নতুন সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
Editor SRC says
খবরতা পড়ে একপেশে লাগল। পাহাড়ের কথাটাও সমানভাবে আসা জরুরী। আর সাধারণ নেপালী জনতার এই লাগাতার বন্ধকে নিয়ে বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতার কথা আলাদা করে জানাতে পারলে ভালো হয়