- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘কীটনাশক থায়োমেট-এর অপব্যবহারে বিকলাঙ্গ শিশু জন্মাচ্ছে কাছাড়ের ভুবন ভ্যালি চা বাগানে’

তানিয়া লস্কর ও প্রশান্ত কুমার রায়, শিলচর, ৯ নভেম্বর#

২০১২ সালে ভুবন ভ্যালি চা বাগানের শ্রমিক বস্তির ছবি। ছবিটা এখনও বদলায়নি। ছবি প্রতিবেদকদ্দের সূত্রে পাওয়া।
২০১২ সালে ভুবন ভ্যালি চা বাগানের শ্রমিক বস্তির ছবি। ছবিটা এখনও বদলায়নি। ছবি প্রতিবেদকদ্দের সূত্রে পাওয়া।

কাছাড় জেলার দক্ষিণ প্রান্তের একটি শান্ত স্নিগ্ধ চা বাগান ভুবন ভ্যালি। গত ২০১২ সালে হঠাৎ করে শিরোনামে উঠে আসে এই আপাত অখ্যাত বাগানটি। সংবাদ মতে বাগানটি হঠাৎ করে লক আউট হয়ে যাওয়ার ফলে চা শ্রমিকদের মধ্যে অভাব অনটন বাড়ছে এবং অনাহারে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। বেসরকারি সংস্থা বরাক হিউমেন রাইটস কমিটির রিপোর্ট মতে সে বছর অনাহারে এবং এর ফলে উদ্ভুত রোগের ফলে মারা যায় প্রায় ৩০ জন মানুষ। পরে সংস্থার তৎপরতায় ভারতীয় মানবাধিকার কমিশনের হস্তক্ষেপে প্রায় ১৩ জন লোক ক্ষতিপূরণ লাভ করে। এবছর ফের আরেকবার বাগান শ্রমিকদের তাড়া করেছে ক্ষুধা আর অপুষ্টির ভূত। ইতিমধ্যে প্রায় ৪ জন লোক মারা গেছে এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আরো পাঁচজন। এছাড়াও প্রতিদিন বহু লোক নতুন করে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
বাগান শ্রমিকদের মতে গত অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে হঠাৎ করে বাগান ম্যানেজার ওমপ্রকাশ তিওয়ারিকে পাওয়া যাচ্ছিল না। দুর্গাপুজোর সময় বাগানে বোনাস তলব কিছুই হয়নি। এমনকি শ্রমিকদের বকেয়া পাওনাও অনেক জমেছে।

এমতাবস্থায় শ্রমিকরা মালিকের ওপর আর ভরসা রাখতে পারছেন না। যদিও খবরটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর চা মজদুর ইউনিয়নের নেতারা, জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিবর্গ তথা রাজনৈতিক নেতারা বাগানে ছুটে গেছেন এবং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় গ্রাম সরোজগার যোজনার অধীনে কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু চেংজুর ডিবিশন এর শ্রমিকদের অভিযোগ, তাদের এলাকায় কাজটি এস্কেলেটর জাতীয় মেশিন লাগিয়ে করানো হচ্ছে এবং শ্রমিকরা কাজ পাচ্ছেন না। এছাড়া বাগান পরিদর্শনে গিয়ে কর্তৃপক্ষের আরো একটি অন্যায় আচরণ নজরে পড়ে। দেখা যায়, বাগানে শারীরিক তথা মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা প্রচুর।

শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা জানান, বাগান কর্তৃপক্ষ কীটনাশক হিসেবে ‘থায়োমেট’ নামে এক ওষুধ ব্যবহার করে। এই ওষুধটি ব্যবহারের প্রকৃত বিধি হলো, ভূস্তরের কমপক্ষে আঠারো ইঞ্চি গভীরে প্রয়োগ করতে হবে। অথচ ভুবন ভ্যালি বাগানে এটি চারাগাছের ওপর প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার করা হয়। গরু ছাগল ইত্যাদি গৃহপালিত জন্তুর আক্রমণ থেকে চারাগাছকে রক্ষা করতে এই পন্থা অবলম্বন করেছে কর্তৃপক্ষ। কারণ এই ওষুধযুক্ত চারাগাছ খেলে জন্তুজানোয়ারের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এই সুযোগেই কর্তৃপক্ষ খেলছে এই ভয়ানক মৃত্যুর খেলা। যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া স্বরূপই বাগানে ব্যাধিগ্রস্ত শিশু জন্মাচ্ছে বলে শ্রমিকদের সন্দেহ। শ্রমিকরা আরো জানালেন, তারা কর্তৃপক্ষের কাছে এর বিরোধিতাও করেছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের কাছে এই প্রয়োগের পারমিশন আছে, যা টি-বোর্ড থেকে পাওয়া।
বাগানের পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতারা এবার তুলনামূলকভাবে বেশি সক্রিয় হলেও এর কিছু কিছু জরুরি বিষয় রাজনৈতিক ডামাডোলের আড়ালে ঢাকা পরে যাচ্ছে।
প্রথমতঃ বাগানে একশ দিনের কাজ (নরেগা বা মনরেগা) শুরু করে সাময়িকভাবে শ্রমিকদের খাদ্যের অধিকার সুরক্ষিত করা গেলেও তাদের রোজগারের সুরক্ষা কিন্তু দেওয়া হচ্ছে না। ফলে চা শ্রমিকরা মানসিক অবসাদে ভুগছেন।
দ্বিতীয়তঃ একটি বাগানের স্থায়ী মজুরদের খালকাটা, পুকুর খোঁড়ার মতো কাজে লাগিয়ে দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত? এবং এর ফলে অন্যান্য মজুরি শ্রমিকদের রোজগারের যে সমস্যা হচ্ছে তা কী করে সমাধান করা হবে? তাছাড়া বাগানের এই অস্থির অবস্থার ফলে বহু অল্পবয়সী শ্রমিক বাগান ছেড়ে অন্য রাজ্যে পালিয়ে যাচ্ছে।
চতুর্থতঃ বাগানে যে রাসায়নিক প্রদূষণের অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
এমতাবস্থায় বাগান শ্রমিকরা এক চরম হতাশায় ভুগছেন। প্রতিবছরই একই লড়াই লড়তে হচ্ছে শ্রমিকদেরকে। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর অমানবিক কার্যকলাপের ফলে প্রায় হাজারখানেক পরিবারের ভবিষ্যৎ প্রবল প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।