সৈকত মিস্ত্রী, অশোকনগর, ৯ নভেম্বর#
দূর্গাপূজায় মিডিয়ার সুন্দরী সন্ধান কলকাতার বিভিন্ন মণ্ডপ পার করে রাত দশটায় এসে ঠেকল ম্যাডক্স স্কোয়ার। এই সেই ম্যাডক্স স্কোয়ার পুজোর দিনগুলো মেতে ওঠে অন্যরকম আনন্দে। যতীন দাস পার্ক ও মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন এক চিলতে পার্ক। এখানে মণ্ডপ ছাড়াও একটা খোলা মাঠ, এই ফাঁকা জায়গাতেই জমে আড্ডা। রাতভোর আড্ডা চলে ম্যাডক্সে। পুজো আসার আগে থেকেই ট্রেনে বাসে মুখে মুখে শুনেছি, ‘এবার ম্যাডক্সে যেতে হবে’। শুধু শহর নয়, শহরতলী থেকেও আজকাল অনেকে এখানে ভিড় জমায়, চলে রাতভোর হুল্লোড়।
ম্যাডক্সের মাঠের একটু কোণ ঘেঁষে মণ্ডপ, আপাত বৈচিত্রহীন, থিমের কোনো আইটেম নেই এখানে। বাসন্তী রঙের কাপড় দিয়ে তৈরি প্যাণ্ডেল। মাঠের চারদিকে শানবাঁধানো পায়ে চলার পথ। মাঠের ডানদিক বাঁদিক ঘেঁষে খাবারের স্টল, মাঠজুড়ে আলো আর আলো। মাঠের চারপাশে বেশকিছু গাছ, ডালে ডালে আলোর মালা মাঠের পিছন দিকটায় চোখ মেলে তাকাই — ওখানে একটা আলো আঁধারি খেলা করছে। শান বাঁধানো প্যাসেজ দিয়ে মাঠে নেমে আসি। ঘাস নেই, সদ্য ফেলা বালি মাটি কিট কিট করছে। এখানে ওখানে ছড়ানো দলা পাকানো কোঁচকানো খবরের কাগজ। খবরের কাগজ পেতে দলবাঁধা তরুণ তরুণীরা বসা। নানা রঙের পোশাক। শরীরী ভাষাগুলো একের থেকে অপরকে আলাদা করেছে। থেকে থেকে হাসি খুশি হুল্লোড় উঠছে। দলগুলো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসা। মাঝে মাঝে দলা পাকানো পুরনো কাগজ।
দেখতে দেখতে এগোচ্ছি, হঠাৎই একটা ছোট্ট ছেলে কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, দাদা কাগজ নেবেন? চারটে দশ টাকা। একটা খবরের কাগজ। কাগজের পাতাগুলো আলাদা আলাদা করে চারটে পৃষ্ঠা একত্রে দশটাকায় বিক্রি করছে এই হকার ছেলেটি। চেহারা দেখে মনে হলো আশেপাশেই ফুটপাথে থাকে।
এখানে ম্যাডক্সে বেশ উচ্চবিত্ত লোকেরা ভিড় করেছে, তাদের পোশাক আসাক ও অলঙ্কার বুঝিয়ে দেয় তাদের বিত্তের বৈভবের পরিচয়। আমি তো বেসরকারি একটা স্কুলে পড়াই আর টিউশন পড়িয়ে আমার দিন চলে, এখানে দাঁড়িয়ে টের পাই, ম্যাডক্সে আমি বড়ো বেমানান। ‘কিরে তুই এখানে?’ — চমকে পেছন ঘুরে দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত মুখ। বলি — ‘এই তো খবরের কাগজের দরকারে এসেছি। তোরা? বাড়ি থেকে?’ ওরা উত্তর করে, ‘আমরা বালিগঞ্জে একটা মেস-এ থাকি, এখানে থেকেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ ওদের কারো বাড়ি বাঁকুড়া, কারো বা কাটোয়া, কেউ বা থাকে দুর্গাপুর; কারো পৈত্রিক ব্যবসা। কারো বা বাবা মা স্কুল টিচার। ফলে বেশ নির্ভাবনায় আছে ওরা! একজন বলল, ‘আয় বসা যাক’। উত্তর করি — ‘আমার কাজ আছে একটু’। সে জানায়, ‘আমরা এখানেই আছি, ওই কোনার দিকে। কাজ সেরে আসিস। আজ আর তোকে ফিরতে হবে না, আমাদের সঙ্গেই না হয় মেস-এ থাকিস।’ আমি এগিয়ে যাই।
সামনে একটা দল। গোটা চারেক ছেলে। তিনটে মেয়ে। একটি মেয়ে এলিয়ে বসে আছে একজন সুদর্শন পুরুষের গায়ে। বয়স বোধ করি বাইশ তেইশ। পোশাকটা নজর কাড়ে, বুকখোলা স্কিনটাইট টপ, ডিজাইনের কারিকুরিতে বানিয়ে তোলা পোশাকের অনাবৃত বক্ষে কোরকদুটি বিজয়ী ভঙ্গীতে উন্মুখ। পথচলতি সকলেরই নজর ওর দিকে। ওর শরীরি ভাষা যেন আমাকে দেখো। অদূরেই এক সুদর্শন যুবা স্থির হয়ে গেল। দুচোখ দিয়ে যেন চেটে খাচ্ছে। মেয়েটির চোখ তার দিকে পড়তেই মেয়েটি কুন্ঠিত না হয়ে বরং বুক টান করে নিজেকে মেলে দিল। ছেলেটি আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অন্যত্র চলে গেল। মেয়েটি আবারো তার পুরুষ সঙ্গীদের গায়ে এলিয়ে পড়ল। আমাদের চিত্র সাংবাদিক ওদের কয়েকটা ছবি ক্যামেরা বন্দী করল। ওরা বেশ খুশি হলো।
সময় এগোয়। রাত্রি নামে। ম্যাডক্সের পরিবেশ আরো কলরবে ভরে ওঠে। ক্যামেরার লেন্স এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ঘুরতে থাকে। মাঠের এক পাশে দাঁড়ানো তিনজন তরুণী। একজন দীর্ঘাঙ্গী, ফরসা, হাঁটুর ওপর পর্যন্ত শর্ট ঝুলের জামা ওর পরনে। ভি কাটের বুক চেরা জামা বক্ষ সৌন্দর্যকে উন্মুক্ত করেছে। হাতে একটা দামি সেলফোন। সঙ্গের দুজনের বেশভূষার একই রকমের। একজন ফ্ল্যাশ দিয়ে মোবাইলে নিজস্বী (সেলফি) তুলল। চারদিকে এমন সব নারী পুরুষের ভিড়, কেউ বা বন্ধুর জন্য অপেক্ষমান। মোবাইলে মোবাইলে ফ্ল্যাশ দিয়ে নিজস্বী তুলছে আর পাঠিয়ে যাচ্ছে। একটু দূরে তিন চারজন দাঁড়ানো। ওদের বয়স তেইশ চব্বিশের মধ্যে। একজনের হট জিন্স পড়া। তার ওপর টি শার্ট। হেলেদুলে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে — আঃ ডিসগাস্টিং, আর পারি না। অপরজন বলছে — ‘ওই টোনাটা (সুন্দর যুবা) দেখ!’ হট প্যান্ট পড়া তরবরিয়ে বলে ওঠে — ‘কী দেখব? ওর লিকাম (লিঙ্গ)।’ ‘হ্যাঁ দেখার মতো। ওর লিকাম টা আরিয়াল (বড়ো লিঙ্গ)’। রিমলেস পড়া বলল, ‘ওকে পরীখ কর না। কতদিন পরীখ খাই না।’ হট প্যান্ট পড়া হেসে ওঠে, বলে, ‘কতিরা (মেয়েলি স্বভাবের পুরুষ, যে নিজেকে মেয়ে ভাবে) পরীখ পরীখ (পুরুষ যৌনসঙ্গী) করে মরল।’ অন্যরা হেসে উঠল।
সরে আসি। মাঠের ওদিকে ওপাশ থেকে এগিয়ে আসছে দু-তিনজন বৃহন্নলা। একজনের পুরুষ্ট গড়ন। দীর্ঘাঙ্গী। চোখে পড়ার মতো। পরনে দামি শাড়ি। কপালে গাঢ় চওড়া সিঁদূর। শরীরে বহুমূল্যবান গহনা ঝকঝক করছে। সঙ্গে একজন যুবা পুরুষ। সাথি অপর বৃহন্নলার বয়স বোধহয় কুড়ির মধ্যে। মাঝারি গড়ন। ঊর্ধাঙ্গে শুধু কালো কাঁচুলি। একটা পাতলা সিল্কের নীল শাড়ি তার বুকের ওপর কোনোমতে এলানো, ফর্সা শরীর, বেশিরভাগটাই অনাবৃত। শরীর থেকে চুইয়ে চুইয়ে পিছলে পরছে একধরনের শ্রী। এই রাত্রে ম্যাডক্সের মাঠে শরীরি উপস্থিতি টের পাই।
মাঠের দিক থেকে এক পা দু-পা করে সরে আসি, পায়ে চলা শান বাঁধানো পথে দাঁড়াই। কানে আসে সুখী মানুষদের হাসি হুল্লোড় প্রগলভ কথা। ভিড়ের মাঝে একা একা হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে আলো আঁধারির কোনটাতে পৌঁছে যাই। একটা ভ্যাট, মাঠের কোনায়। সমস্ত জঞ্জাল এনে জড়ো করা হয়েছে এখানে। দু-তিনটে বড়ো গাছ এই কোনায়। বেশ উঁচু। গাছের ডালে টিউব লাইট। তবু নিচে আলো আঁধারি। দুজন লোক ভ্যাটের মধ্যে ঢুকে কাজ করছে। বেলচা দিয়ে ছড়ানো জঞ্জাল এক জায়গায় করছে তারা। একটু ঘুরে দেখি, ভ্যাটের পেছনে আলো আঁধারিতে দু-তিনজন মহিলা। শীর্ণ মলিন শতছিন্ন পোশাক ওদের। একজনের কোলে একটি নগ্ন রুগ্ন শিশু। চেয়ে থাকি ওদের দিকে।
দু-তিনটে কণ্ঠ কলকল করে এগিয়ে আসে। ঘুরে দেখি তিনজন হেলেদুলে এদিকে আসছে। ওদের মিহি গলা। হাত নেড়ে তালি দিয়ে কথা বলছে। ওদের একজনের পরনে হট প্যান্ট। অনাবৃত নির্লোম পা। আরেকজনের ন্যারো জিন্স, মাথাভরা বড়ো বড়ো চুল। দু-কানে দু-জোড়া দুল আছে। আরেকজনের পরনে শাড়ি — পুরুষালি দেহে নারীত্বের ছাপ ফুটে উঠেছে। তার বুকের কাছে হাত এনে হট প্যান্ট বলে — ‘দ্যাখ, মাগির লিল্কি (স্তনটা)। কলকল করে ওঠে শাড়ি পরিহিতা — মর মর! নিজেরটা বানাতে পারিস না, আমারটা নিয়ে …। মর …। এখনো তো পুরো হয়নি।’ সঙ্গী অপরজন বলে — ‘আর কবে হবে রে?’ কালো শিফন শাড়ির হালকা আবরণ সরিয়ে বুকটা উন্মুক্ত করে দীপ্ত ভঙ্গীতে গর্বের সঙ্গে বলে — ‘আর একটা ইঞ্জেকশন বাকি, তাহলেই আমারটা …।’
চিকিৎসার কারিকুরিতে গর্বিত এক মানব(ী)। বানিয়ে তোলা প্রত্যঙ্গের অনুভূতিতে তৃপ্ত এক মানব(ী)। আমি শ্লথ হয়ে পড়ি। অদূরে দেখি, সেই শীর্ণ মা তার কোলের অপুষ্ট শিশুটিকে নেতিয়ে পড়া স্তন দিচ্ছে। শিশুটি শেষ শক্তি দিয়ে শুষে নিচ্ছে প্রাণসুধা। ধুলায় বসা মলিন মা।
Leave a Reply