সিরাজুল ইসলাম। কিলখানা, মেটিয়াবুরুজ। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০।
এ সপ্তাহে কোনো খরিদ্দারই ছিল না। লকডাউন বলে বাইরের খরিদ্দাররা আসেনি। শুক্রবারে একদম লাস্ট আওয়ারে লকডাউন তুলে নিল। ততক্ষণে সব খরিদ্দার টিকিট ক্যানসেল করে নিয়েছে। মোটামুটি ৯০% ব্যাবসায়ী শূন্য হাতে হাট থেকে ফিরে এসেছে। বাংলার দু-চারটে খরিদ্দার ছিল। তারাই যার কাছ থেকে নিয়েছে ছ-পিস কি বারো পিস বউনি-বাট্টা করেছে। তার আগের সপ্তাহে চেন্নাইয়ের খরিদ্দার ছিল, বিহার নাগপুর থেকেও এসেছিল।
আমার কারবারে দু-সপ্তাহ বাজার নেই। যখন পুরো লকডাউন ছিল, তখন একরকম বাজার ছিল। খরিদ্দাররা ট্রান্সপোর্টে মাল নিচ্ছিল। এখন না লকডাউন হচ্ছে, না পুরোপুরি খুলছে বাজার। খরিদ্দার ভাবছে, আমি ওখান থেকে মাল কিনব না, ফোনে অর্ডার দিচ্ছে না। আবার আসতেও পারছে না। খরিদ্দার চিন্তাভাবনা করেছে যে গিয়ে দেখে মাল নেব। এ সপ্তাহে লকডাউন হয়ে সেটাও হল না।
কেরালার ওনাম হয়ে গেল। খুব একটা বাজার ছিল না। ওরা ফোনে ফোনে মাল নিয়েছে যাদের সঙ্গে জানাশোনা তাদের কাছ থেকে। হোয়াট্স অ্যাপে বাজার করেছে।
একদম ছোটো ব্যাবসায়ী, যারা ২০-৪০ হাজার টাকা নিয়ে ব্যাবসা করছে, তারা শেষ। আবার একদম বড়ো ব্যাবসায়ী তাদের ব্যাবসাও পুরো বন্ধ। মাঝারি ওস্তাগর যারা আছে, তাদের কম দামি মালটাই এইসময় চলেছে। ৫০০-৭০০-১০০০ টাকার মালের বাজার নেই। মোটামুটি ১০০-২০০-৩০০ টাকার মালগুলো চলেছে। অনলাইনে ওয়ার্ডস অ্যাপের মাধ্যমে দেখে খরিদ্দাররা কিনছে। বেশি দামের মাল খরিদ্দাররা কিনতে সাহস পাচ্ছে না। যেমন, আমার মাল, কুর্তিটা, দেড়শো টাকার মালটা খরিদ্দার রিস্ক নিয়ে হোয়াট্স অ্যাপের মাধ্যমে কিনে নিচ্ছে। কিন্তু একটা নতুন ডিজাইন, দামি মাল তো ছবি দেখে অনুমান করা যায় না কেমন হবে। কুর্তি, লেগ-ইন্স, ছোটো বাচ্চাদের ফ্রকের মার্কেটটা টুকটাক করে চলছে।
ছোটো ওস্তাগররা কেউ কেউ টিকে আছে। কেউ কেউ মাল যা ছিল বেচে কারবার খেয়ে ফেলেছে। এখন লোকের কাজ এনে সেলাই করবে। আমাদের এখানে একটা ছেলে লেগ-ইন্স কাটত। লকডাউনের পর থেকে কারবার তুলে দিয়ে এখন অন্যজনের লেগ-ইন্স সেলাই করছে। আমার কুর্তির কাজে নিজের দলিজে দুজন লেবার আছে। আমি শুধু নিজে কাটি। সেলাইটা বাইরে হয়।
ভারতবর্ষের অর্থনীতি যে নেমে গেছে তার একটা বড়ো সাফারার আমরা
আসগর আলি রাজা। মিঠা তলাব, মেটিয়াবুরুজ। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০।#
টানা লকডাউন চলাকালীন ব্যাবসা পুরোপুরি স্তব্ধ ছিল। লকডাউন যখন শিথিল হল, যারা মধ্য বা নিম্ন-মধ্য ব্যাবসায়ী, একটু কাজটা শুরু হল। মানুষ সেইসময় যে পোশাক পরেছে সেটা ফ্যাশনের জন্য নয়, একটা কাপড় পরতে হবে সেইজন্য কিনেছে। কম দামি পোশাক তৈরি করে যে ওস্তাগর, তারা কিছু মার্কেট পেয়েছে। বড়ো ওস্তাগররা কিন্তু কাজটা পুরো বন্ধ রেখেছিল। তাদের এক-একটা ইউনিটে প্রচুর লেবার কাজ করত, সেটা পুরো বসেছিল।
আজ রবিবার আমরা যে মার্কেটে ঘুরে এলাম, ওয়েস্ট বেঙ্গলের সামান্য কিছু কাস্টমার রয়েছে। বাংলা, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা এবং বিহার থেকে কিছু কাস্টমার ট্রেন বন্ধ থাকায় নিজেদের গাড়ি নিয়ে চলে আসছে। তারা সামনের দেওয়ালিটাকে টার্গেট করছে। ভারতবর্ষের অর্থনীতি যে নেমে গেছে তার একটা বড়ো সাফারার আমরা। মানুষের হাতে লিকুইড মানি নেই। যারা আসছে তারা পনেরো দিন বা এক মাসের চেক কেটে দিচ্ছে। এখানকার মানুষকে রিস্ক নিয়ে তাদের সঙ্গে ব্যাবসা করতে হচ্ছে, কিছু করার নেই।
দিল্লি, মুম্বই বা সাউথে কিছু মাল এইভাবে যাচ্ছে, তারা হোয়াট্স অ্যাপ করছে, কিছু মাল অর্ডার করছে। এখান থেকে মালটা পাঠালে তারা অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে। এইভাবে ২৫% মার্কেট সচল হয়েছে। ৭৫% বসে আছি আমরা। মার্কেট না থাকায় আমাদের এলাকায় লোকে বিয়ে বা অন্য সামাজিক অনুষ্ঠান ছোটো করে নিয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীটা প্রচুর সাফার করছে।
দুর্গাপুজোর মার্কেটটা এখনও চালু হয়নি। আমার মোতিহাট আর জব্বারহাটে স্টল আছে। সামান্য কিছু কাস্টমার আসছে মূলত বাংলা, উড়িষ্যা আর ঝাড়খণ্ডের। বাংলা লাগোয়া, টাটা সুমো করে যারা আসতে পারছে, তারাই আসছে। আমরা মূলত ফ্রক তৈরি করি। আমার পাশের ওস্তাগর জেন্টস মাল বাবাস্যুট তৈরি করে। ১২০ থেকে ১৫০-এর ভিতর মালটা, ১৫০-এর ওপর কোনো মাল বিক্রি হচ্ছে না। আমার কাছ থেকে যে মালটা ১৫০ টাকায় কিনছে, সেটা রিটেলারের কাছে গিয়ে তিনশো টাকা হয়ে যাচ্ছে। কাস্টমার সেটা অ্যাফোর্ড করতে পারছে না। সেইজন্য বড়ো ওস্তাগররা ইউনিটগুলো বন্ধ করে রেখেছে।
ভোর চারটে থেকে হাট খুলে যায়। মার্কেটটা খুবই খারাপ। হাটে স্টলওয়ালারা কোনোরকমে বউনিটা করছে, তারপর বসে থাকছে। দলিজগুলোয় দু-তিনদিন সেলাইয়ের কাজ হচ্ছে, তারপর বন্ধ থাকছে। আমাদের এখানে কিছু কারিগর বসে কাজ করে। আবার ক্যানিং, বসিরহাট, জয়নগর, মগরা থেকে কিছু গাড়ি এখানে আসে, আমরা তাদের কাঁচামালটা কেটে দিয়ে দিই, তারা ওটা কমপ্লিট করে দেয়। সেই গাড়িগুলো যেভাবে আসত, সেইভাবে আসছে না। কারণ মালের চাহিদা নেই। অস্বীকার করার উপায় নেই যে অবস্থাটা শোচনীয়।
Leave a Reply