প্রিয় সম্পাদক,
সংবাদ মন্থন,
গত ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সংখ্যায় ‘মাতৃভূমি স্পেশ্যাল’ সম্পর্কে আপনারা যে খবরগুলি প্রকাশ করেছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমাদের দেশে নারীর প্রতি পুরুষের অপরাধপ্রবণতা কোন গভীর স্তরে ও কী মাত্রায় রয়েছে মাতৃভূমি স্পেশ্যালের ঘটনাগুলি তা এক ঝটকায় আবার সামনে এনে দিয়েছে। সবচেয়ে যেটা ভয়ঙ্কর তা হল মেয়েদের উপর সংগঠিত হিংসার প্রবণতা। যে হিংস্র পুরুষরা একটি প্রতিবাদী মেয়েকে তাদের ‘হাতে তুলে’ দেবার দাবী করেছিলো অথবা যে ‘দাদা-কাকুরা’ একটি ছোট্ট মেয়ের ওপরে পরিকল্পিত ভাবে যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল তারা দলমত নির্বিশেষে সংগঠিত ভাবেই আক্রমণ করেছিল। তাদের আক্রমণের লক্ষবস্তু ছিল নির্দিষ্ট এবং আক্রমণের একমুখীনতা-ও ছিল স্পষ্ট। অপরাধীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধও ছিল না। – এর শিকড় অনেক গভীরে।
আমাদের দেশে শিশুপুত্ররা পারবারিক প্রশ্রয়ে অপরাধী হয়ে ওঠে। প্রথম নির্যাতনগুলো তারা চালায় বোন বা দিদির ওপরে। মা-বাবা-ঠাকুমা-ঠাকুরদার দৈনন্দিন প্রশ্রয়ে তারা এই মানসিকতা নিয়েই বড়ো হয় যে মেয়েদের সঙ্গে যা-খুসি করা যায়। – অন্য দিকে, আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী নির্যাতিত হওয়াকেই স্বাভাবিক ভেবে মেনে নেন। সম্ভবত ৬০\% নারী এখনও মনে করেন যে স্বামীদের বউ-পেটানোর ‘অধিকার’ আছে। শিশুরা এই পরিবেশেই বড়ো হয়ে ওঠে। তারা এটাকে নিয়ম হিসেবেই ধরে নেয় যে বাবা এসে মা-কে গালাগালি করবে, মারধোর করবে আর মা কাঁদবে ও দেয়ালে মাথা ঠুকবে (যদিও অনেক সময়েই শিশুরা এটা মেনে নিতে পারে না)।
আমাদের দেশে এমন বহু পুরুষ আছে যারা সঙ্গমের আগে স্ত্রীকে গালিগালাজ করে, মারধোর করে – কারণ অবমানিতের স্তরে নামিয়ে আনতে না পারলে তাকে ভোগ্য ভাবা যায় না। তার আত্মমর্যাদাকে ধ্বংস করতে না পারলে নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আইন স্ত্রী-ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে না, কারণ তাতে ‘পারিবারিক কাঠামো ভেঙে পড়বে’ অর্থাৎ নারীর প্রতি পুরুষের যৌন-নির্যাতনের ‘অধিকার’ রক্ষার মধ্য দিয়েই পরিবারিক কাঠামো টিকে থাকে। ফলত, নারী নির্যাতন এক অপরাধবোধহীন অপরাধ হিসেবে রাষ্ট্রীয় সমর্থনেই টিকে থাকে এবং দেশ ও জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে দিনের পর দিন চলতে থাকে। – এরকম একটি দেশের মেয়েরা ট্রেনে-বাসে কি ধরনের যৌন হেনস্থার শিকার হতে পারেন তা সহজেই অনুমান করা যায়।
ইতিহাস থেকে জেনেছি যে দাসব্যবস্থার সময় থেকে চলে আসা নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে মেয়েরা ‘রিঅ্যাক্ট’ করতে শুরু করে ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে। সমাজজীবনে নারীর অংশগ্রহণ যে পরিমাণে বাড়তে থাকে সেই পরিমাণেই বাড়তে থাকে “রিঅ্যাক্ট’ করার পরিমাণও। এবং এই দুটোই পাশাপাশি চলতে থাকবে যতদিন না নারী-পুরুষ বৈষম্যের অবসান হয়।
সাম্প্রতিক কালে যেটা বেশি করে মনোযোগ আকর্ষণ করছে তা হল অপমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনেকটা সামাজিকভাবেই নারীর উঠে দাঁড়ানো। বিগত বছরগুলিতে ব্যক্তি-নারীর মানসিকতায়ও একটা বড়ো পরিবর্তন এসেছে।
২৫ বছরের একটা পরিবর্তন উদাহরণ হিসেবে এনে বলা যায়, কলেজে পড়তে আমার পাঁচজন বান্ধবীর মধ্যে চারজনই স্বেচ্ছায় নিছক গৃহবধূর জীবন বেছে নিয়েছে (এবং তারা সকলেই যে খুব সম্মানিত জীবন যাপন করছে এমনটা নয়)আর এখন আমার দশজন ছাত্রীর মধ্যে একজনও নিছক গৃহবধূর জীবন বেছে নিতে চায় না। তারা কেউই চায় না যে তাদের বর ‘স্বামী’ হোক, তারা চায় বর হবে প্রেমিক ও বন্ধু।
অপরপক্ষে পুরুষদের একটা বড়ো অংশের মধ্যে এই ধরনের পরিবর্তন আসেনি। তারা এখনও সেই প্রভূত্বকারী অবস্থান ছাড়তে নারাজ। তাদের মধ্যে সবচেয়ে নোংরা অংশটা ভয়ঙ্কর হিংস্রভাবে ‘পাল্টা রিঅ্যাক্ট’ করছে যা প্রায় মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আবার, পুরুষদের মধ্যে বড়ো একটা অংশ আছে যারা কৈশোর থেকে (যৌন অবদমন, জীবনযাপনের অনিশ্চয়তা, ঊর্ধ্বতন শক্তির কাছে প্রতিনিয়ত পরাজিত ও অপমানিত হওয়ার ফলে?)এক গোপন অসুখ বয়ে বেড়াচ্ছে; এরা সরাসরি নির্যাতনে অংশগ্রহণ করছে না, কিন্তু মেয়েদের ওপর লাঞ্ছনাকে উপভোগ করার মধ্য দিয়ে কোনও অসুস্থ ইচ্ছাকে পরিতৃপ্ত করছে।
আমার মনে হয় সংলাপ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে অসুস্থকে কিছুটা সুস্থ করে তোলা যায়; যারা এখনও অসুস্থ হয়নি তাদের সুস্থতা বজায় রাখার জন্যও সংলাপ জরুরি (সংবাদ মন্থন-এর এই সংবাদগুলো এই কারণেই প্রয়োজনীয় এবং সত্যতার নিরিখে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ)।
সবশেষে, এইটুকুই বলতে চাই, নারী নির্যাতনকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়ার যে মানসিকতা চলে আসছে তার বিরুদ্ধে তীব্র ও ধারাবাহিক আক্রমণ চালানো জরুরি – যাতে অপরাধীরা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে।
– জয়ন্তনাথ সরকার
সম্পাদক
মানবী : নারীভাবনার উজানপত্র ( কোচবিহার)
Leave a Reply