জিতেন নন্দী, রবীন্দ্রনগর মহেশতলা, ২০ অক্টোবর#
[কেনার সঙ্গে যখন বছর দুয়েক আগে পরিচয় হয়েছিল, তখন আমাদের পাড়ার পটানদার মুরগির দোকানে মাংস কাটার কাজ করত ফিরোজ, তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল কেনা। ছোটোখাটো চেহারার কেনা পড়ত সাতঘরা মাদ্রাসায় ক্লাস সেভেনে। ক্লাস এইটে ওঠার পর ও পড়া ছেড়ে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোর নাম কেনা কেন রে? ও বলেছিল, ‘আমার নাম শাহনওয়াজ খান। আমার যখন তিন বছর বয়স, আমার একশিরার ব্যথা উঠেছিল। আমার নানা রেললাইনের কাছে কেনা হাজীর কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। সে বলেছিল, এই ছেলেটার নাম কেনা হাজী দিয়ে দাও, ওর রোগ সেরে যাবে। সেইজন্য আমার নাম হল কেনা। ব্যথাটা কমে গেছিল, কিন্তু ফোলাটা রয়ে গেছে।’ আরও বলেছিল, ‘আমার ওপরে সবচেয়ে বড়ো ভাইটা মরে গেছে। ওর জন্ডিস হয়েছিল। পুঁইশাক খাওয়া বারণ ছিল। রাত্রিবেলা লুকিয়ে শুকনো পুঁইশাক খেয়ে নিয়েছিল। তার থেকে শরীরে পোকা হয়ে গেল।
তারপরে বড়োদিদি। আকড়া হাই মাদ্রাসায় পড়ে। তারপরের বোনটা পড়া ছেড়ে দিয়েছে। আমার নিচে দুই ভাই পড়ে ক্লাস ওয়ানে। তার নিচে তিন বছরের ছোটোবোন। বড়োদিদির কাছে আমি পড়ি। ওর কাছে আরও অনেকে ফ্রিতে পড়ে। আর ও আরবি পড়ায় দশ-এগারোজন ছেলেমেয়েকে। তাদের কাছ থেকে একশো টাকা করে নেয়। আব্বা ওস্তাগরের ম্যানেজারি করে। আমার জন্ম এখানে। কিন্তু আগে আমাদের ঘর ছিল নন্দীগ্রামে, গড়চক্রবেড়িয়ায়। ওখানে আমার দিদু, একটা বেটি আর চাচি আছে। আব্বারা ছয় ভাই।
সবাই দিল্লি, বোম্বাই আর বাইরে বাইরে থাকে। আমার আব্বা দর্জির কাটিংয়ের কাজ করতে এখানে আসে। এখানে সাতঘড়ায় বিয়ে করে থেকে গেছে। আমার জন্ম এখানে। আমাদের বাড়ি আর নানাদের বাড়ি পাশাপাশি।’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুই মুরগির দোকানে কী করে কাজ পেলি? — ‘বকরঈদের সময় মোর আব্বা এয়েছিল ফিরোজের দোকানে মুরগি কিনতে। ও একটা বাচ্চা ছেলের খোঁজ করছিল। আব্বা আমাকে লাগিয়ে দিল।
তখন থেকে মুরগির দোকানে কাজ করছি। ডেলি দুবেলা কাজ, বৃহস্পতিবার ছুটি। হপ্তায় তিনশো টাকা ফিরোজ দেয় আব্বা হাতে। আর ফিরোজ আমাকে রোজ দশ টাকা দেয়। ওই টাকা নিয়ে পার্টি করি। পার্টি মানে সবাই মিলে কিছু খাই, এই মশলা-মুড়ি।’ রোজ কেনাকে দেখতে পেতাম রবীন্দ্রনগরের রাস্তার ধারের মুরগির দোকানটাতে। অল্পদিনের মধ্যেই ও বেশ কাজ শিখে নিয়েছে। ফিরোজ দোকানে না থাকলে ও কাটা-মুরগি পিস পিস করে কেটে ওজন করে খরিদ্দারকে দেয়, পয়সাও বুঝে নিতে পারে। সকাল সাড়ে আটটা থেকে বেলা বারোটা, আবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা অবধি ওর হেল্পারি চলত। তারই ফাঁকে চলত ওর স্কুলের পড়াশোনা, খেলাধুলা আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। ম্যাটাডোরে চড়ে দল বেঁধে চলে যেত সল্টলেকে মহামেডান স্পোর্টিংয়ের খেলা দেখতে।
একদিন দেখলাম কেনা মুরগির দোকান থেকে উধাও হয়ে গেছে। পটানদা বললেন, ‘ও দিল্লি চলে গেছে’। এবছর বকরঈদের পর আবার কেনার সঙ্গে দেখা হল। ওর মুখ থেকেই জানতে পারলাম ওর দিল্লিবাসের বিবরণ। — জিতেন নন্দী]
সোবরাতের দুদিন পর আমি দিল্লি চলে গেছি। ওখানে মুরগির কাজে গেছি। আমার চাচারা ওখানে থাকে, মেজোচাচা বলল, চলে আয়। চাচা ওখানে পাঁচ-ছ বছর মুরগির কাজ করে। আমার চারটে চাচাই ওখানে কাজ করে। ওরা মুরগির ঠেকেদারি করে। জাহাঙ্গির, সামসুল, কালাম আর শাহআলম। ওদের পরিবার থাকে আমাদের দেশে, নন্দীগ্রামে। দিল্লিতে ওরা সীমাপুরিতে রুম ভাড়া নিয়ে থাকে। গাজিপুর লালবাত্তিতে মুরগির কাজ হয়। ওখানে কোটি কোটি মুরগি কাটা হয়। প্রথমে হালাল হচ্ছে, তারপর দুজনা পাঞ্জা দেগে দিচ্ছে, চারজনা খাল খিঁচছে, দুজনা প্যাট সাফ করছে, একজনা মুরগির গলার কাঁটা বের করছে, একজনা সিনার বোনলেস বের করছে, একজনা বাজু কাটছে, একজনা লেগ কাটছে, একজন লেগের বোনলেস করছে, একজনা থাইয়ের বোনলেস করছে, একজনা পায়ের গুড্ডি কাটছে। যেখানে কাটিং হচ্ছে, ওই জায়গাটা ঢাকা, বাইরেটা খোলা, বিরাট জায়গা। ওখানে মাল কাটা হচ্ছে, কেটে বোনলেস হচ্ছে, সব আলাদা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। হাড্ডিটা আলাদা বিক্রি হচ্ছে।
অনেক রকম কোম্পানি আছে। গোল্ডেন আছে, সাহিদ আছে, সোহেল আছে। মাল কাটা হয়, বাইরের দোকানদাররা আসে। ভিতরে এসে মাল তুলে নিয়ে চলে যায়। ওখানে মুরগি গোটা বিক্রি হয় না। সিনা-টিনা সব আলাদা আলাদা বিক্রি হয়। দোকানদাররা গাজিপুর মান্ডি থেকে কিনে নিয়ে যায়। আমাদের এখানে যেমন বাজার, ওখানে হিন্দুস্তানিরা বলে মান্ডি। সেখান থেকে সব জায়গায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। গোটা মুরগিও বিক্রি হয়, একশো টাকা একশো দশ টাকা পিস, যখন যেমন বিক্রি হয়। কাটা মাল আজকের কাটা হচ্ছে, কালকের বিক্রি হচ্ছে। বরফে রাখা হয়। মুরগির চামড়াগুলো ড্রেস করে বিক্রি হয়। খাল আলাদা, বাজু আলাদা, পুঁট আলাদা। আমার প্যাট সাফ করার কাজ। খাল খিঁচে আমার কাছে বাচ্চাটা আসবে। প্যাট সাফ করে ওপরে তুলে দেব। নিচে কাটাইয়ের কাজ হচ্ছে, ওপরে বোনলেস হচ্ছে। ওখানে হাজার হাজার লেবার। যেখানে দু-হাজার কিলো মাল কাটে, সেখানে ঠেকেদারকে পাঁচটা লেবার দিতে হবে। কসাই ঠেকেদারকে রোজ পাঁচশো টাকা দিয়ারি দেবে। সাথে ছাল-চামড়া আর ছাঁটন দেবে। সেটা বিক্রি হচ্ছে ভালো দামে। লেবারকে ঠেকেদার আড়াইশো টাকা তিনশো টাকা রোজ দিচ্ছে। আমাকে কাটিং করতে হয়, ড্রেস করতে হয় না। সকাল থেকে আমার কাজ শুরু, যতক্ষণ হবে। সকাল ৬টা-৭টা থেকে শুরু হয় কাজ। কোনোসময় পাঁচটা থেকেও শুরু হয়ে যায়। শেষ হতে এগারোটা-বারোটা বেজে যায়, কোনোদিন নটাতেও শেষ হয়ে যায়, ম্যাক্সিমাম এগারোটা।
কসাই যত মাল চালাবে, তত কাটতে হবে। আমার চাচার কাজ থেকে আমি একবারে পয়সা নিই, যখন বাড়ি আসি। পাঁচ হাজার টাকা মাসে পাই। থাকা-খাওয়া চাচার কাছে। খাওয়া মোটামুটি ভালো, এনিটাইম খাওয়া। একটাইম হোটেলে খেতে যাই চাচার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে। মঙ্গলবার করে ছুটি থাকে, খাই আর ঘুরি। কোথাও গিয়ে টিভি দেখলাম, মোবাইলে কিছু ভিডিও আপলোড করলাম।
আমরা যে জায়গাটায় থাকি পুরো বাঙালি। এবারে চাচা গাদ্দারি করে দিল, পনেরো হাজার সাতশো টাকা চাচা মেরে দিল। ওই টাকাটা পেলে আর দিল্লি যাবার জরুরত থাকত না, এখানেই ভালো ব্যবসা হয়ে যেত। দিল্লিতে আর যেতাম না। ওস্তাগরি করতাম। ঘরে তিন-চারটে সেলাই মেশিন আছে, আব্বা ভাড়ায় দিয়ে রেখেছে। আমার বাবা ম্যাটজি, সেলাইয়ের কাজও জানে। আপনি যেরকম ডিজাইন বলবে, সেরকম ডিজাইনের একটা প্যাটার্ন তৈরি করবে, তারপর কেটে দেবে। আমি মেশিন চালাতে পারি। মাল কেটে সেলাই করলে হপ্তায় হাজার-বারোশো টাকা ইনকাম করা যেত। ডাইরেক্ট বড়তলা থেকে কাপড় কিনে এনে কাটিং করিয়ে সেলাই করিয়ে ইস্তিরি করিয়ে প্যাক করে হাটে গিয়ে বিক্রি করতাম। আমার বাবা কাটতে জানে। জ্যাকেট বলো, লেডিজ জামা বলো, সব কাটিং জানে। মেজোচাচার কাছে আর থাকা যাবে না। ছাল-চামড়ার টাকাটা মেরে দিল। বলছে, বাজার খুললে দেব। এবারে গিয়ে ছোটোচাচার কাছে কাজ ধরব। সীমাপুরিতে আমার মতো অনেক ছেলে আছে। কেউ ভ্যান চালায়, কেউ কাজ করে। অনেক রকম কাজ।
আমি যে পনেরো হাজার টাকা দিল্লি থেকে নিয়ে এসেছিলাম, মেজোদিদির বিয়ে হল, ঘরে টাকাটা দিয়ে দিলাম। বড়োদিদি পড়াশুনা করছে। তাই এখনও বিয়ে হয়নি। মেজোটা পড়ে না। ছেলে মুদিখানা করে, নন্দীগ্রামে থাকে। আমি এখানে ফিরে আসার চেষ্টা করব। এখানেই আমার সব কিছু, খালি পয়সাটাই ওখানে। এখানে পটানদার মুরগির দোকানে প্রথমে দেড়শো টাকা করে দিত। তারপর একশো টাকা করে দিল, তখন ছেড়ে দিলাম। দিল্লিতে সকাল এগারোটা পর্যন্ত কাজ করে দুশো টাকা পাই। তারপর ছাল-চামড়া বিক্রি করে আরও কিছু ইনকাম হয়। চার-পাঁচশো টাকা এমনিতে হয়ে যায়। এখানে ডেলি কা ডেলি বাড়িতে টাকাটা দিয়ে দিতাম। ওখানে টাকাটা জমে যাচ্ছে। চাচার কাছে রাখি। এবারে গিয়ে আর চাচার কাছে আর রাখব না। একটা বাঙালি লোক লটারি করে, তার কাছে লটারি করে নেব ছ-মাসের।
লোকের কাছে রাখলে পরে কিছু হলে তাকে বলা যাবে। নিজের চাচাকে আর কী বলা যাবে?
……………………
একটা খারাপ খবর
দিল্লিতে ঘর থেকে ফোন গেল, বলল মিস্টার মারা গেছে। ট্রেনে আর একটা বন্ধুর সঙ্গে ইয়ার্কি করে ধাক্কাধাক্কি করছিল। ব্রেসব্রিজের কাছে পড়ে গিয়ে মরে গেছে। গেটের কাছে রডটা ধরে বাইরে ঝুঁকেছিল, পোস্টে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছে আর শেষ। ওর বাবার হোটেল আছে আমরিতলায়। ওরা বিহারী। ওর বডিটা দেশে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়েছে। মিস্টার আমার বন্ধু ছিল। ওর মা পাগলের মতো হয়ে গেছে।
Leave a Reply