• প্রথম পাতা
  • আন্দোলন
  • কৃষি ও গ্রাম
  • খবরে দুনিয়া
  • চলতে চলতে
  • পরিবেশ
  • শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
  • শিল্প ও বাণিজ্য
  • নাবালকথা

সংবাদমন্থন

পাতি লোকের পাতি খবর

  • আমাদের কথা
    • যোগাযোগ
  • পত্রিকার কথা
    • পাক্ষিক কাগজ
    • জানুয়ারি ২০০৯ – এপ্রিল ২০১২
  • মন্থন সাময়িকী
    • মন্থন সাময়িকী নভেম্বর ডিসেম্বর ২০১৪
    • মন্থন সাময়িকী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৪
    • সাম্প্রতিক সংখ্যাগুলি
    • সাম্প্রতিক পিডিএফ
    • পুরনো সংখ্যাগুলি
  • সংবাদ সংলাপ
  • বিষয়ের আলোচনা

চট্টার ফেড জিন্‌স কারখানায় আগুনে হত ঘুমন্ত শ্রমিক : ‘যতদিন আছি এভাবেই বেঁচে থাকতে হবে। তারপর একদিন মরে যেতে হবে’

April 26, 2016 Editor JN Leave a Comment

২৩ এপ্রিল, রাজীব দত্ত, সরোজ দাস, মহব্বত হোসেন এবং জিতেন নন্দী #

বাচ্চা ছেলেরা জিন্‌সের প্যান্ট শুকোচ্ছে রাস্তার পাশে। ২৩ এপ্রিল। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা।
বাচ্চা ছেলেরা জিন্‌সের প্যান্ট শুকোচ্ছে রাস্তার পাশে। ২৩ এপ্রিল। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা।

আজ আমরা চট্টায় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া জিন্‌স কারখানা দেখতে যাই। জায়গাটা হল চট্টা, পাঁচপাড়া মসজিদ, মাণিক দরগার কাছে, মাজেরপুর গ্রাম। আকড়া নোয়াপাড়ার মোড় থেকে একটা ম্যাজিক-গাড়িতে চেপে আমরা চারজন ওখানে গিয়েছিলাম। সামনে-পিছনে ১২-১৪ জন  যাত্রীতে ঠাসাঠাসি গাড়িটাতে যেতে যেতে কথা শুরু হয়। যেতে যেতেই আমরা ঘটনাটা সম্বন্ধ কিছু আভাস পাচ্ছিলাম। খবরটা লোকের মধ্যে ছড়িয়েছে, তা নিয়ে একটা আতঙ্ক আছে, আবার না-বুঝতে পারা অবস্থাটাও রয়েছে। আমরা গাড়ির হেল্পারকে বলেছি, যেখানে আগুন লেগেছে, সেই কারখানায় যাব। শুনে একজন বললেন, ‘চারজন মারা গেছে, বেশিও হতে পারে। ওখানে ৬০-৭০ জন ছেলেমেয়ে কাজ করত।’ একজন মহিলা — মনে হল তিনি ওই এলাকায় কাপড়ের বিনিময়ে বাসন বিক্রি করেন — নিজে থেকেই বললেন, ‘আমি তো ওই কারখানাতে গেছি প্যান্ট কিনতে, ওখানে ১২৫ জন কাজ করে …’। অস্পষ্টভাবে নিজের মনেই বলে চলেছিলেন, ‘কী একটা মেশিন আছে, তাতে পেট্রল লাগে, ওটা বার্স্ট করলে আর দেখতে হবে না’।

 এই কারখানার তিনতলায় আগুন লেগে চারজন শ্রমিক মারা যান। ২৩ এপ্রিল। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা।
এই কারখানার তিনতলায় আগুন লেগে চারজন শ্রমিক মারা যান। ২৩ এপ্রিল। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা।

আর একজন বৃদ্ধা বলছিলেন, ‘ওখানকার জল! নতুন পুকুর খুঁড়লেও ওই জল চলে আসে’। যাত্রীরা প্রায় সকলেই ঘটনাটা অল্পস্বল্প জানে, অথচ একটু চুপচাপ, স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে দু-একটা কথা বলছিল কেউ কেউ। আরেকজনের কাছ থেকে জানা গেল, আগুন লাগা কারখানাটায় মিনিম্যাক্স ব্র্যান্ডের জিন্‌স তৈরি হয়। অনেকটা যাওয়ার পর গাড়ির ভিতর থেকে দেখছি, দুপাশের মাঠে বাঁশের খুঁটির ওপর দড়ি টাঙিয়ে সদ্য তৈরি করা জিন্‌সের প্যান্টগুলো শুকোনো হচ্ছে। এমনকী, রাস্তার ধারে স্তূপীকৃত বালি, স্টোনচিপ্‌সের ওপরও নতুন জিন্‌সের প্যান্ট শুকোচ্ছে। বুঝলাম, আমরা একটা জিন্‌স-অঞ্চলের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। দুপাশে যেখানেই নালা আর পুকুরের দিকে চোখ পড়ছে, দেখছি বিষাক্ত গ্যাঁজলা ওঠা কালো নীলচে জল।

প্রতিটি কারখানার গা দিয়ে নালায় জমা হয়ে আছে দূষিত বর্জ্য জল। ২৩ এপ্রিল। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা।
প্রতিটি কারখানার গা দিয়ে নালায় জমা হয়ে আছে দূষিত বর্জ্য জল। ২৩ এপ্রিল। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা।
প্রতিটি কারখানার গা দিয়ে নালায় জমা হয়ে আছে দূষিত বর্জ্য জল। এটি আরেকটি। ২৩ এপ্রিল। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা।
প্রতিটি কারখানার গা দিয়ে নালায় জমা হয়ে আছে দূষিত বর্জ্য জল। এটি আরেকটি। ২৩ এপ্রিল। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা।

আমরা যখন ওই কারখানার সামনে গাড়ি থেকে নামলাম, দেখলাম জায়গাটা শুনশান। একে চড়া রোদে তেঁতে রয়েছে চারদিক, দুপুর পৌনে একটা বাজে, অনেকেই নামাজে গেছে। সামনেই দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া কারখানার জলপাই-সবুজ রঙের বাড়িটা, তার সামনে ডাঁই করা জ্বালানি কাঠ। তিনতলা বাড়িটা তালা বন্ধ, ফাঁকা। একপাশে রাস্তার ধার বরাবর বাঁশের খুঁটির ওপর দড়ি টাঙিয়ে জিন্‌সের প্যান্ট শুকোতে দেওয়া হয়েছে। আমরা সামনে কাউকে না পেয়ে কারখানার পিছন দিকে যাই। চারপাশে কোনো লোকই নেই। পিছনে পোড়া টিন আর আবর্জনা পড়ে রয়েছে। টিনের চালার নিচে একটা বারো-তেরো ফুট উঁচু ফার্নেস গোছের কিছু, এটাই হয়তো সেই বয়লার যাতে কাঠ পুড়িয়ে জল গরম করা হয়। পরে লোকের মুখে শুনলাম, সেই গরম জল দিয়ে রাসায়নিক গলাতে হয়, না হলে জিন্‌সের কাপড় ফেড করা যায় না। ভিতর থেকে বন্ধ একটা লোহার গেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি সার সার প্লাস্টিকের বড়ো বড়ো জার। আন্দাজ করা যায়, এগুলোতে জিন্‌স ওয়াশ করার কেমিকাল ভর্তি থাকে। ওপরে তিনতলার জানলার বাইরে আগুন লেগে যাওয়ার পোড়া দাগ। গাড়িতে আসার সময় জেনেছি, এখানে জিন্‌সের প্যান্ট সেলাই আর ওয়াশ দুই-ই হত।

কারখানার ভিতরে রাসায়নিকের জার এবং জ্বালানি কাঠ। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা। ২৩ এপ্রিল।
কারখানার ভিতরে রাসায়নিকের জার এবং জ্বালানি কাঠ। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা। ২৩ এপ্রিল।

কারখানা বলতে জলা আর ধানজমির ওপর তৈরি হওয়া একটা বিচ্ছিন্ন বাড়ি। লাগোয়া কোনো বাড়ি নেই। সামনে আগাছায় ভরা ধূ ধূ মাঠ। আমরা নানান কাজে বিভিন্ন সময়ে এখানে এসেছি, জিন্‌স কিনতে কিংবা এপিডিআর-এর সমীক্ষায়। একটা চাষের জমির ওপর তার চরিত্র বদল করে দীর্ঘ সময় ধরে ধাপে ধাপে এই ফেড-জিন্‌সের শিল্প গড়ে উঠেছে, অথচ স্থানীয় প্রশাসন উদাসীন থেকেছে। এটা কারখানা, কারো থাকার জন্য নয়। গাড়িতেই লোকজন বলছিল, এটা সিল করে দেওয়া হয়েছে। কীসের সিল কে জানে! আমরা দেখলাম, তালা লাগানো রয়েছে সব গেটেই, হয় বাইরে থেকে, না হয় ভিতর থেকে; কোনো পাহারা নেই। যে কেউ পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে যেতে পারে। মনে হল, সে ব্যাপারে প্রশাসনের কোনো মাথা ব্যথা নেই।

কারখানার পিছনে আগুনে পোড়া টিন। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা। ২৩ এপ্রিল।
কারখানার পিছনে আগুনে পোড়া টিন। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা। ২৩ এপ্রিল।

ফেড মেশিন নিয়ে সমস্যাটা দীর্ঘদিনের, বহু পরিবেশবাদী মানুষ এ নিয়ে বহুবার প্রশ্ন তুলেছে, মামলা হয়েছে আদালতে। কিন্তু অবস্থাটা পাল্টায়নি। বরং ফেড কারখানা শিল্পের প্রসার ঘটেছে। দুর্ঘটনার সময় কারখানার মূল ফটকে বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল। বাইরের লোক ভিতরে যাওয়ার উপায় ছিল না। যদিও কোনো কোনো খবরের কাগজে বেরিয়েছে, তিনতলায় ঘরে কাপড়ের স্তূপ ছিল। শ্রমিকেরা মশার কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কয়েলের আগুন কাপড়ে লেগে যেতে চারজন ঘুমন্ত শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান, একজনকে চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন গভীর রাত, বাইরের লোকেরা খবর দিতে সকাল ছ-টা নাগাদ পাঁচটা দমকল এসে ওপরে উঠে তিনঘণ্টা ধরে আগুন নেভায়। এই কারখানার মালিক আনিসুর রহমান, থাকেন রায়পুরে। শুনলাম কারখানার ম্যানেজার গ্রেপ্তার হয়েছেন।

কারখানার পিছনে বয়লার এবং কাঠের স্তূপ। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা। ২৩ এপ্রিল।
কারখানার পিছনে বয়লার এবং কাঠের স্তূপ। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা। ২৩ এপ্রিল।

জায়গাটা জনমানবশূন্য। যে দু-একজন সাইকেল বা ভ্যান নিয়ে যাচ্ছে, তারা ঘটনা নিয়ে মুখ খুলতে চাইছে না। যারা জিন্‌সের প্যান্টের পাঁজা পিছনে নিয়ে মোটরসাইকেলে যাচ্ছে, দূর থেকে আড় চোখে দেখছে আমাদের, ভাবটা, এই আপদগুলো আবার কোথা থেকে এল!

আমরা পাশের কারখানায় এসে কথা বলার লোক খুঁজছি। ইতিমধ্যে ভ্যান নিয়ে যাচ্ছিল দুজন। তাদের দুর্ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই তারা বলল, আমরা অন্য ফ্যাকট্রিতে কাজ করি, এখানকার ব্যাপারটা জানি না। তবু আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে শুনেছি সব বাইরে থেকে এসে কাজ করে। কোথা থেকে আসে তারা?’ ওরা বলল, ‘এখানে বেশি শিলিগুড়ির লোক, আর কিছু আছে বর্ধমানের।’ — ‘হঠাৎ শিলিগুড়ির এত লোক কীভাবে এল?’ — ‘ওই চেন সিস্টেমে এসেছে একের পর এক। তাছাড়া শিলিগুড়ির কিছু লোক এখানে কারখানা লিজ নিয়েও চালায়।’

শ্রমিক বাচ্চাদের হাতের অবস্থা। ২৩ এপ্রিল ছবি প্রতিবেদকদের তোলা।
শ্রমিক বাচ্চাদের হাতের অবস্থা। ২৩ এপ্রিল ছবি প্রতিবেদকদের তোলা।

আর একটা তথ্য এদের কাছ থেকে জানা গেল, বছর খানেকের মধ্যে এই কারখানায় আর একটা দুর্ঘটনায় আরও দুজন মারা গেছে। তারও বছর খানেক আগে অসুখ হয়ে একজন মারা যায় — মালিক তাকে ছুটি দিচ্ছিল না, সামনেই ছিল ঈদ, চিকিৎসাও করানো হয়েছিল, কিন্তু ছেলেটা মারা যায়। এই দুজনের মধ্যে একজনের বয়স বছর বারো হবে, আর একজন প্রাপ্তবয়স্ক। এরা বলব না বলব না করেও বলল, ঘটনার দিন পুলিশ, দমকল এসেছিল। ফিরহাদ হাকিম, শোভন চট্টোপাধ্যায় আর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও এসেছিলেন। আর যারা মারা গেছে, তাদের একজন ছিলেন কারখানার ওয়াশ-মাস্টার, শিলিগুড়ির লোক।

পাশে জাহাঙ্গির হাজির কারখানায় নামাজ ঘর। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা। ২৩ এপ্রিল।
পাশে জাহাঙ্গির হাজির কারখানায় নামাজ ঘর। ছবি প্রতিবেদকদের তোলা। ২৩ এপ্রিল।

পাশের ফ্যাকট্রিটার মালিক জাহাঙ্গির হাজি। ওঁর বাড়িও রায়পুরে। কারখানাটার সামনে দেখি ওজু করার জন্য পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা রয়েছে। বয়সে তরুণ একজন এসে পরিচয় দিলেন, তিনিও শিলিগুড়ির লোক। আমরা বললাম, ‘ওই কারখানাতে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে তো একজন ছিলেন ওয়াশ-মাস্টার, আপনাদের শিলিগুড়ির লোক, আপনি নিশ্চয় ওঁকে চিনতেন?’ উনি বললেন, ‘না আমি চিনি না। আমি তো বেশিদিন এখানে আসেনি। ছ-মাস এসেছি। আগে বম্বেতে জিন্‌সের কাজ করতাম। এখানে জাহাঙ্গির হাজির কারখানায় ওয়াশের মাস্টার হিসেবে এসেছি।’ মাইনে কীরকম, জিজ্ঞেস করাতে পাশ থেকে একজন বললেন, দশ হাজার মতো। আর বাচ্চাদের মাইনে চার হাজার। কারখানার ভিতরে নজর যেতেই দেখলাম, ৭-৮ জন অল্পবয়সি ছেলে কাজ করছে। এরা কেউ শিলিগুড়ি, কেউ মেদিনীপুর, ঝাড়খণ্ড বা পাকুর থেকে এসেছে। এই কারখানায় ১৪-১৫ জন কাজ করে, ছোটো ফ্যাকট্রি। দোতলায় নামাজ-ঘর। সেখান থেকে অনেকে নামাজ পড়ে নেমে আসছিল। শুনলাম, কাছেই একটা মসজিদ তৈরি হচ্ছে।

সামনের কাটিং ঘরে মেশিনে কাপড় কাটা চলছে। ২৩ এপ্রিল ছবি প্রতিবেদকদের তোলা।
সামনের কাটিং ঘরে মেশিনে কাপড় কাটা চলছে। ২৩ এপ্রিল ছবি প্রতিবেদকদের তোলা।

আমরা দেখছিলাম, কারখানার গা দিয়েই নালাতে নীলচে কালো ফেনা ওঠা বর্জ্য জল জমাট বেঁধে রয়েছে। এই দূষিত জল তো সব ওয়াশ কারখানা থেকেই বার হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কোথায় ফেলা হয়? একজন নামাজ-ফেরতা টুপি মাথায় যুবক জানালেন, এই নালা টানা মহিষগোট পর্যন্ত গেছে, সেখান থেকে নদী হয়ে জলটা সমুদ্রে চলে যাচ্ছে। যেন সমুদ্রে চলে গেলেই ব্যাপারটা চুকে যায়! — এই বিষাক্ত জলটা চুঁইয়ে মাটির নিচে যায় না? যুবক এই প্রশ্নে নিরুত্তর থাকলেন। পাশ থেকে আর একজন নিচু স্বরে বললেন, হ্যাঁ, তা তো কিছুটা যায়।

রাস্তার দিকে এসে দেখি, দুজন ছেলে — নিতান্তই বাচ্চা — দড়ি থেকে শুকিয়ে যাওয়া জিন্‌সের প্যান্টগুলো তুলে কাঁধের ওপর জড়ো করছে। এদের মধ্যে যে একেবারেই বাচ্চা, বছর আষ্টেক বয়স হবে, সে বলল, ‘ওইদিন আমি আগুন দেখেছি। তবে বেশি লোক মরেনি। ভোট ছিল তো মুর্শিদাবাদে, অনেকে বাড়ি চলে গিয়েছিল।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুই এখানে কবে এসেছিস, কীভাবে এলি? ও তখন অন্য ছেলেটার দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওর মায়ের বাপের বাড়ি এখানে। ও এখানে একা থাকতে চাইছিল না, তাই আমাকে সঙ্গে করে রেখে দিয়েছে।’ কথায় কথায় জানলাম, ওদের বাড়ি ডায়মন্ড হারবারের হটুগঞ্জে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোরা জাহাঙ্গির হাজির কারখানায় কাজ করছিস? — না, আমরা মান্নানের ওখানে কাজ করি। — তোদের মাইনে কত? বাচ্চাটা বলল — ‘এখনও ঠিক হয়নি, সবে তো দুদিন হল এসেছি। ওর মায়ের সঙ্গে মালিকের কথা হবে।’ ওর কাছ থেকেও জানতে পারলাম, এই কারখানায় ১২৫ জন কাজ করে। তবে ঘটনার দিন মুর্শিদাবাদে ভোট থাকায়, কিছু ছেলে আগেরদিন বাড়ি চলে গিয়েছিল। নাহলে আরও মানুষ মরতে পারত। চারিদিকে একটা থমথমে পরিবেশ। অনেকে আমাদের সামনে অল্পক্ষণের জন্য জড়ো হল বটে, কিন্তু কেউই কথা বলতে আগ্রহী নয়। আন্দাজ করলাম, এই কারখানাগুলোতে বাইরে থেকে খাটতে আসা প্রায় নব্বই শতাংশ ছেলেমেয়ে নাবালক। তারা ফালতু ঝামেলায় জড়াতে চায় না।

রাস্তার উল্টোদিকে একটা বড়োসড়ো কাটিং ঘর। সেখানে একজন প্রবীণ মানুষ তাঁর পরিবারের লোকেদের নিয়ে মেশিনে কাটিং করছেন। এখন পুরু টেরিকটনের থান ফেলে মেশিনে কাটার তোড়জোড় চলছে। এই কাপড়টার নাম চায়না বেলুন। পিছনে দাঁড় করানো আছে জিন্‌সের থান। জানলাম, এখন আর কাঁচি দিয়ে কাপড় কাটা হয় না, মেশিনে কাটা হয়। যেদিকেই তাকাই, নালা-নর্দমা-পুকুরে সেই কালো নীলচে জল। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, একটা জায়গায় আগুন লাগলে লোকে তো প্রথমে জল নিয়ে আগুন নেভাতে ছোটে, আপনারা কেউ যাননি? প্রবীণ মানুষটি বললেন, ‘জল কোথা থেকে দেব? জল আছে কোথাও? আমরা খাবার জল কি পাই?’ — তাই তো, আপনাদের খাবার জলের কী ব্যবস্থা? উত্তর পেলাম, জাহাঙ্গির হাজির ডিপ টিউবওয়েল আছে, সেখান থেকেই খাবার জল নিয়ে আসতে হয়। পাইপের জলের লাইন, নলকূপ, হ্যান্ডপাম্প কিছুই নেই। আরও জানলাম, এখানে অতীতে চাষ হত। বহুদিন তা বন্ধ। এই পরিমাণ ভারী ধাতু সম্বলিত ফেড মেশিনের জল মাটিতে দীর্ঘদিন যেতে যেতে জমি তার জৈবগুণ হারিয়েছে।

ফেরার সময় ম্যাজিক-গাড়িতে দুজন বলছিলেন, জমা রাসায়নিক থেকেই এত বড়ো অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। আমাদের একজন বললেন, ‘সেটা তো বেআইনি?’ শুনে একজন উত্তেজিত মন্তব্য করলেন, ‘বন্দুক-পিস্তলও জমা করা বেআইনি। কিন্তু তা কি বন্ধ রয়েছে? যারা সেইসব জিনিস জমা করে, তাদের কিছু না বলে আপনারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কেন কথা বলছেন? এদের কাছ থেকে আপনারা কখনই সত্য জানতে পারবেন না। তাছাড়া, এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট, আর অ্যাকসিডেন্ট হতেই পারে যে কোনো জায়গায় …’। বুঝলাম, এই ওয়াশ কারখানার বিষয়ে কারো নাক গলানোতে ওঁর আপত্তি রয়েছে।

আমরা ম্যাজিক গাড়ি থেকে আকড়ায় নেমেছি, কাঁধে কাপড়ের ঝোলা নিয়ে একজন নামলেন, তিনি আমাদের ডেকে বললেন, ‘আপনাদের ধন্যবাদ জানাই, আপনারা এই বিষয়ে কাজ করছেন। আমি ষোলো বছর ধরে এই রাস্তায় যাতায়াত করছি, শাঁখপুকুর স্কুলে পড়াই। এই ওয়াশ কারখানাগুলোতে আট থেকে একুশ বছর বয়সের মানুষ কাজ করতে আসে।’ আমরা রেকর্ডার অন করতেই তিনি অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। আর কথা বাড়াতে চাইলেন না।

একদল মানুষ ওয়াশ কারখানাগুলো এবং ওই অঞ্চলের দুর্দশা আর দূষণ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু মুখ ফুটে আপত্তির কথাগুলো বলতে পারছে না। আর একদল মানুষ — যারা এই শিল্পের বিশাল কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে রয়েছে — চোখের সামনে ভয়াবহ দূষণ আর দুর্ঘটনা দেখতে পেয়েও তা নিয়ে কোনো কথাবার্তা পছন্দ করছে না। পরিবেশগত বা অন্যান্য ক্ষতির প্রভাব ও মাত্রা সম্বন্ধে লোকে ওয়াকিবহাল নয়, কিছুটা গা সওয়া হয়ে গেছে। কাটিং ঘরের প্রবীণ মানুষটি এখানকার ভয়াবহ অবস্থার প্রতিকার নিয়ে কী ভাবছেন জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ‘কিছুই ভাবছি না। যতদিন আছি এভাবেই বেঁচে থাকতে হবে। তারপর একদিন মরে যেতে হবে।’

শিল্প ও বাণিজ্য অ্যাসিড, আগুন, কারখানা, জিন্‌স, দুর্ঘটনা, ফেড কারখানা, ফেড জিন্‌স, মেটিয়াবুরুজ, শিশুশ্রমিক, শ্রমিক

এই প্রতিবেদনটি প্রিন্ট করুন এই প্রতিবেদনটি প্রিন্ট করুন

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অনুসন্ধান করুন

সংবাদ মন্থন

  • ছিটমহল
  • মাতৃভূমি লোকাল

খবরের মাসিক সূচী

মেটা

  • Log in
  • Entries feed
  • Comments feed
  • WordPress.org

সাম্প্রতিক মন্তব্য

  • TG Roy on লোককবি গুরুদাস পালের আত্মজীবনী : জীবন ও শিল্প
  • Subrata Ghosh on স্বনির্ভরতায় উজ্জ্বল ‘শিশু কিশোর বিকাশ মেলা’
  • সুমিত চক্রবর্তী on ‘গুণগত মেশিন একটা মানুষকে মানসিক রোগী বানিয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিচ্ছে’
  • তীর্থরাজ ত্রিবেদী on লোককবি গুরুদাস পালের আত্মজীবনী : জীবন ও শিল্প

ফোরাম

  • আড্ডা
  • বিষয়ের আলোচনা
  • সংবাদ সংলাপ
  • সাংগঠনিক আলাপ

লে-আউট সহায়তা

সংবাদমন্থন প্রিন্ট >>
 
নমুনা ল্যাটেক>>

songbadmanthanweb [at the rate] gmail.com · যোগাযোগ · দায়দায়িত্ব · Log in