টুইট, সাক্ষাৎকার ও আদালতের রায় অনুবাদ করে সাজিয়ে দিয়েছেন জীতেন নন্দী। ২০ অগাস্ট, ২০২০।#
আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের আদালত অবমাননার অভিযোগের ওপর ১৪ আগস্ট ২০২০ রায়ের ভিত্তিতে সাজা ঘোষণার কথা ছিল আজ। জাস্টিস অরুন মিশ্রের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির একটি বেঞ্চ, সুপ্রিম কোর্ট ও প্রধান বিচারপতিদের বিরুদ্ধে প্রশান্ত ভূষণের সমালোচনামূলক টুইটকে আপত্তিকর বলে মেনে নিতে পরামর্শ দিয়ে আগামী ২৪ তারিখ অবধি সময় দিলেন বিবৃতি ফিরিয়ে নিতে। দুর্নীতিমুক্ত বিচারব্যবস্থার জন্য দীর্ঘ লড়াইয়ের শরিক ভূষণ অবশ্য তাঁর অবস্থানে অনড়ই থাকলেন। উল্লেখ্য, তেহলকা ম্যাগাজিনের ২০০৯ সালের সাক্ষাৎকারের বয়ানে প্রশান্ত ভূষণের ওপর আদালত অবমাননার অভিযোগে আর একটি মামলার পরবর্তী তারিখ ২৪ আগস্ট ২০২০।
প্রশান্ত ভূষণ টুইটারে কী লিখেছিলেন
২৯ জুন ২০২০
প্রধান বিচারপতি রাজভবন নাগপুরের এক বিজেপি নেতার ৫০ লক্ষ টাকার মোটরসাইকেলে চেপে রয়েছেন, মাস্ক বা হেলমেট ছাড়া, এমন এক সময়ে যখন তিনি সুপ্রিম কোর্টকে লকডাউন করে রেখেছেন যার জন্য নাগরিকেরা বিচারের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
২৭ জুন ২০২০
যখন ভবিষ্যতে ঐতিহাসিকেরা গত ৬ বছরের দিকে তাকিয়ে দেখবেন যে কীভাবে কোনো আনুষ্ঠানিক জরুরি অবস্থা ছাড়াই ভারতে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে, বিশেষত তাঁরা এই ধ্বংসে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা এবং আরও নির্দিষ্টভাবে সর্বশেষ ৪ জন প্রধান বিচারপতির ভূমিকা চিহ্নিত করবেন।
তেহলকা ম্যাগাজিনের ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সংখ্যায় সোমা চৌধুরি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের একটি সাক্ষাৎকার নেন। সেখানে তাঁর বক্তব্যের কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ :
- জুডিসিয়াল অ্যাকাউন্টেবিলিটির প্রশ্নে তর্ক যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, সেক্ষেত্রে চরম মুহূর্তের কোনো ঘটনা কি সেই তর্ককে উসকে দিয়েছে?
এর জবাবে প্রশান্ত ভূষণ দুটি ঘটনার উল্লেখ করেন — ‘প্রধান বিচারপতি সভরওয়াল মামলা (যেখানে একটা অভিযোগ ছিল যে প্রধান বিচারপতি ওয়াই এস সভরওয়াল-এর অর্ডারে দিল্লির কমার্শিয়াল আউটলেটগুলি ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ সরাসরি তাঁর ছেলেদের সুবিধা করে দেয়, যাঁরা কিছু মল-ডেভলপারের পার্টনার ছিলেন) এবং গাজিয়াবাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড দুর্নীতি। এই দুটি ঘটনা ব্যাপক মিডিয়ার নজরে এসেছিল। ২০০৬ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভারতের বিচার ব্যবস্থা পুলিসের পরেই সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান।’
- জুডিসিয়াল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ক্যাম্পেনে আপনি কেন সামনের সারিতে আছেন?
প্রশান্ত ভূষণ : ‘আদালতগুলোতে বিচার ব্যবস্থার দুর্নীতি আমি বহু সময় ধরে দেখে আসছি। আমি জানি বাইরের নানা বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিন্তু সেগুলোর সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া কঠিন। হাইপ্রোফাইল ইমপিচমেন্টের চেষ্টা হয়েছে, যেমন, বিচারপতি রামস্বামী, বিচারপতি পুঞ্চি এবং বিচারপতি আনন্দের ক্ষেত্রে। যদিও এঁরা সকলেই প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। আমার নজরে, সর্বশেষ ১৬ থেকে ১৭ জন প্রধান বিচারপতির মধ্যে অর্ধেক দুর্নীতিগ্রস্ত। আমি এটা প্রমাণ করতে পারব না, যদিও পুঞ্চি, আনন্দ এবং সভরওয়ালের বিরুদ্ধে প্রমাণ আমাদের কাছে ছিল, যার ভিত্তিতে আমরা ওঁদের ইমপিচমেন্ট চেয়েছিলাম।’
- বিচার ব্যবস্থার দুর্নীতি কি অন্যভাবেও প্রতিভাত হয়?
প্রশান্ত ভূষণ : ‘এরকম অনেক রয়েছে। বিচারপতি কাপাডিয়া উড়িষ্যার নিয়ামগিরিতে মাইনিং লিজের মামলায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বেদান্ত লিজ পেতে পারে না, কারণ নরওয়ের সরকার ওদের ব্ল্যাকলিস্টেড করেছে। কিন্তু বেদান্তের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি স্টারলাইট লিজ পেতে পারে, কারণ তারা সরকারি তালিকাভুক্ত কোম্পানি। বিচারপতি কাপাডিয়া এটাকে সরকারি তালিকাভুক্ত বলেছিলেন কারণ এই কোম্পানিতে ওঁর নিজের শেয়ার ছিল আর তাই তিনি স্টারলাইটের পক্ষে একটা অর্ডার পাশ করে দিলেন! যেখানে স্বার্থের সংঘাত রয়েছে সেক্ষেত্রে বিচারপতিদের মামলা শোনার বিষয়ে একটা আইন আছে। কিন্তু ওঁরা সেটা এড়িয়ে গেলেন এবং আপনি সেটা নিয়ে অভিযোগ করতে পারবেন না। কারণ সেক্ষেত্রে কনটেম্পট বা আদালত অবমাননা হয়ে যাবে।
১৪ আগস্ট ২০২০ আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের আদালত অবমাননার অভিযোগের ওপর রায়ের কিছু অংশ :
১। প্রশান্ত ভূষণের টুইটারে মন্তব্যের ওপর মাহেক মাহেশ্বরী সুপ্রিম কোর্টের কাছে একটি আবেদন/পিটিশন করেন।
২। যেহেতু মাহেশ্বরী অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমোদন ছাড়াই এই পিটিশন করেছেন, আদালতের প্রশাসনিক বিভাগ বিচার বিভাগের কাছে এই আবেদন তালিকাভুক্ত করার জন্য নির্দেশ দেয়। ২২ জুলাই ২০২০ এই আবেদন বিচার বিভাগে আসে। বিচার বিভাগ এই আবেদন আদ্যপান্ত দেখে আদালত অবমাননাকারী হিসেবে অভিযুক্ত প্রশান্ত ভূষণ এবং টুইটার-কর্তৃপক্ষের ওপর অর্ডার দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ৫ আগস্ট এটি লিস্টে আসে। আদালত অবমাননাকারী হিসেবে অভিযুক্ত প্রশান্ত ভূষণ ৪৬৩ পৃষ্ঠার অ্যানেক্সার সমেত ১৩৪ পৃষ্ঠার লিখিত জবাব পেশ করেন।
৩। প্রশান্ত ভূষণের পক্ষে লেখা হয় : ‘গণতন্ত্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হল জুডিসিয়ারি সহ সমস্ত প্রতিষ্ঠান নাগরিক এবং দেশের জনসাধারণের জন্য কাজ করে এবং যে কোনো প্রতিষ্ঠানের বিষয় নিয়ে তাদের মুক্ত ও অবাধ আলোচনার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে এবং সেই প্রতিষ্ঠানের সংস্কারসাধনের জন্য জনমত গঠনের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। … এছাড়া প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্ট নয়। … যেহেতু মি. মাহেশ্বরীর পিটিশনের ওপর এই মামলা, এটা সুও মোটু কনটেম্পট পিটিশন হিসেবে নেওয়া যায় না। অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমোদন ছাড়া মাহেশ্বরীর অভিযোগের ভিত্তিতে প্রসিডিং শুরু করা যায় না।
৪। ২২ জুলাইয়ের অর্ডারের পর টুইটারের কর্তৃপক্ষ প্রশান্ত ভূষণের ওই টুইট দুটি ব্লক করে দেয়। ফলে অভিযুক্ত কনটেমনার-২ টুইটার-কর্তৃপক্ষকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
১০৮ পৃষ্ঠার এই অর্ডারে বিচারপতি অরুণ মিশ্র, বি আর গাভাই এবং কৃষ্ণ মুরারির পক্ষ থেকে রায় দেওয়া হয় :
৫। অভিযুক্ত কনটেমনার-১ নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি গত তিরিশ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্ট এবং দিল্লি হাইকোর্টে প্র্যাকটিশ করছেন এবং আমাদের গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য ও তার প্রতিষ্ঠান বিষয়ক বহু জনস্বার্থের ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করেছেন, বিশেষত আমাদের বিচার ব্যবস্থার ক্রিয়াকলাপ এবং আরও নির্দিষ্টভাবে তার অ্যাকাউন্টেবিলিটির বিষয়ে। অভিযুক্ত কনটেমনার বিচার ব্যবস্থার পরিচালনের অংশ হওয়া সত্ত্বেও আইনের মর্যাদা রক্ষার পরিবর্তে তিনি এমন এক কাজে যুক্ত হলেন যা বিচার ব্যবস্থার পরিচালনের প্রতিষ্ঠানকে অসম্মান করার দিকে যায়। … অমার্জিত সব অভিযোগ, যা বিদ্বেষমূলক এবং যা আদালতকে কলঙ্কিত করার ঝোঁক সম্পন্ন, তা কখনোই ৩০ বছরের প্রতিষ্ঠিত একজন আইনজীবীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। … এই টুইট ভারতীয় গণতন্ত্রের এই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের ভিতটাকেই নড়িয়ে দিতে পারে। টুইটটি স্পষ্টভাবে এমন এক ধারণা দিতে উদ্যত যা দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক আদালত সুপ্রিম কোর্ট গত ছয় বছরে ভারতীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে এক অত্যাবশ্যক ভূমিকা পালন করেছে। … আমাদের বিবেচনাপূর্ণ দৃষ্টিতে, এই টুইট ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠানটি এবং প্রধান বিচারপতির মর্যাদা ও কর্তৃত্বের হানি ঘটিয়েছে এবং আইনের মর্যাদাকে সরাসরি মুখের ওপর অপমান করেছে। … যারা নির্ভয়, পক্ষপাতহীন এবং অনমনীয় বিচারের উচ্চ মান বজায় রাখতে চায়, তাদের শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। যদি যথাযথ দৃঢ়তা নিয়ে এই ধরনের আক্রমণের মোকাবিলা না করা হয়, তাহলে তা হয়তো বিভিন্ন জাতির মধ্যে পরস্পরের আইন ও আচারব্যবহারের সৌজন্যমূলক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সম্মান ও মর্যাদার ক্ষতি করতে পারে। নির্ভয় এবং পক্ষপাতহীন বিচারের আদালতগুলি এক স্বাস্থ্যকর গণতন্ত্রের প্রাকার এবং তাদের ওপর বিদ্বেষমূলক আক্রমণের দ্বারা তাদের ওপর আস্থাকে দুর্বল করে দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে না। … টুইটগুলি যে বিকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে, আমাদের বিবেচনায় তা ‘অপরাধমূলক অবমাননা’র কাজের সমতুল্য।
Leave a Reply