বি টি রোডে চলন্ত সাইক্লিস্টের সঙ্গে ক্ষণিকের আলাপ
অজয় বিশ্বাস। বি টি রোড। ১৮ নভেম্বর,২০২০।#
বুধবার সকাল সাড়ে আট-টা। বি টি রোড দিয়ে মদনপুর থেকে আসছি সাইকেলে, যাব কলকাতা। ব্যারাকপুর ছাড়িয়েই দেখছি, রাশি রাশি লোক সাইকেলে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, অফিসযাত্রী। কয়েকদিন আগে এই রাস্তাতেই “বিটিরোড সাইকেল সমাজ” বলে একটা সংগঠন সাইকেল র্যালি করেছিল এই রাস্তায় একটা সাইকেল লেন চেয়ে। আমিও আসব ভেবেছিলাম র্যালিতে, আসা হয়নি। তো রাশি রাশি সাইকেল দেখে ভাবছি, এদের কাছে সাইকেল লেন-এর দাবিটা পৌঁছে দেবার উপায় কী? সপ্তাহের মাঝামাঝি কোনো এক দিন যদি ডানলপ ব্রিজ বা এরকম কোনো জায়গায়, যেখানে সিগন্যালে সাইকেল দাঁড়ায়, সেখানে সকাল আট-টা থেকে ন-টা লিফলেট দিলে হয়ত তাদের কাছে পৌঁছবে দাবিটা। তাদের মতামত-ও শোনা যাবে। টেক্সম্যাকো কারখানার সামনে দেখেছিলাম কয়েক শ’ মিটার ডিভাইডার দিয়ে সার্ভিস রোড মতো বানানো হচ্ছে, যেমন কেষ্টপুর লেকটাউনের রাস্তাটায় আছে। এসব ভাবছি আর জোরে সাইকেল চালাচ্ছি।
— এটা কি রেসিং সাইকেল?
হঠাৎ ঘাড়ের কাছ থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করল। ডানদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখি, ছোটো বাংলা সাইকেলে সওয়ারি একজন রোগা মতো লোক, মাথায় সাদা রুমাল, আমারই বয়সী হবে, সাইকেলের সামনের রডে টিফিন কেরিয়ার ঝোলানো।
— না, হাইব্রিড সাইকেল। রেসিং সাইকেল হলে টায়ার সরু হতো।
— হ্যাঁ, এটা মোটা টায়ার। কোথায় যাবেন?
— ঢাকুরিয়ার ওদিকে।
— কোথা থেকে আসছেন?
— মদনপুর। আপনি?
— ও, আমি আসছি কল্যানী হাইওয়ে থেকে।
সাইকেল চালাতে চালাতেই কথা শুরু হল। ওই ব্যস্ত রাস্তায় পাশাপাশি সাইকেল চালিয়ে যাওয়া কঠিন। কথায় কথায় আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি কোথায় যাবেন?
— কাশিপুর গান ফ্যাক্টরির পাশে একটা টায়ারের কারখানায়। আমাদের টায়ারের কাজ।
— রোজ এই রাস্তা দিয়ে সাইকেলে যান?
— সপ্তাহে ছ’দিন। রবিবার বাদ। এই রাস্তা আমাদের কাছে পাড়ার রাস্তার মতো।
— কত কিলোমিটার চালান?
— চল্লিশ কিলোমিটারের বেশি আসা যাওয়া নিয়ে।
— কতক্ষণ লাগে রোজ?
— সওয়া এক ঘন্টা দেড় ঘন্টা। কোনো কোনো দিন তো পঁয়তাল্লিশ মিনিটেও হয়ে যায়। আমরা জোরে চালাই। আমার ছেলে ভি জোরে চালায়।
এগিয়ে যাচ্ছিল আমায় ছেড়ে। অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, চলন্ত মানুষ, সে ট্রেনে হোক, বাসে হোক, মেট্রোয় হোক কিংবা সাইকেলে — কখন যে ধাঁ হয়ে যাবে তার কোনো ঠিক নেই। তাই প্রথমেই ফোন নাম্বার চেয়ে নিতে হয়, যদি আলাপ রাখতে হয়। তারপর ফটো তুলতে হয়। সেলফি। আমি তাই বললাম,
— দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনার ফোন নাম্বারটা নিয়ে রাখি।
একটা পেট্রোল পাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে আমায় দাঁড় করালেন। তারপর ফোন নাম্বার নিলাম। নাম জিজ্ঞেস করতে বললেন, আজাদ। আমি বললাম, বিটি রোডে সাইকেল চালায় যারা, তাদের একজোট করে একটা সাইকেল লেন তৈরি করার জন্য কিছুদিন আগে একটা সাইকেল র্যালি হয়েছে এখানে। আজাদ হেসে বললেন, ‘আমি আজ কুড়ি বছর ধরে এই রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছি। প্রথমে এইটুকু রাস্তা ছিল, তার মধ্যে দিয়েই চালিয়েছি।’ সরাসরি সাইকেল লেন নিয়ে কিছু বললেন না। আমিও আর ওই কথায় গেলাম না। শুধু বললাম, ওই সাইকেল র্যালি যারা করেছে, তাদের দিয়ে দেব আপনার ফোন নাম্বারটা। এবারেও কিছু বললেন না আজাদ। ফের সাইকেলে চেপে বসলাম আমরা। দ্রুত গতির সাইকেল চালক আজাদের সঙ্গে চালিয়ে পেরে ওঠা সত্যিই দুষ্কর। আরো দুষ্কর চালাতে চালাতে গল্প করা। তার মধ্যেই আজাদ একটু একটু করে বলে চললেন —
“টায়ার চারশ’ সাত-এ চাপিয়ে খাদিমের ফ্যাক্টরিতেও নিয়ে যাই। পাঁচ ছয় বছর আগে তপসিয়ায় একটা জুতো ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছিলাম সাইকেলে। কলকাতা পুলিশ ধরল সাইকেল। দশ টাকা নিল। একটা স্লিপ দিয়ে ছেড়ে দিল।”
— দশ টাকা? একশ’ টাকা নেয় তো। আমরা তো এই ফাইনের জ্বালাতেই অতিষ্ট হয়ে সাইকেল সংগঠন তৈরি করেছিলাম কলকাতায়।
— না, আমার কাছে দশ টাকা নিয়েছিল। … এই সপ্তাহে হিন্দুদের একটা পরব আছে না। আমাদের মালিক হিন্দু, তিনদিন ছুটি দিয়েছে। তার মধ্যে একদিন পড়েছে রবিবার। … সাইকেলে আমি গড়িয়া ভি গেছি। এই সাইকেল কীভাবে কীভাবে যে চলে যাবে, কুছ ভি বুঝতেও পারবে না। …”
ডানলপ ব্রিজের কাছে সিগন্যাল। আজাদের সাইকেল দাঁড়াল। পেছনে আমি। এই ফাঁকে ছবিটা তুলে নিই ভেবে পকেটে হাত দিতে গেছি, ওমা, ওই সিগন্যালের পরোয়া না করে এইটুকু ফাঁক দিয়ে সাইকেল গলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল আজাদ। পেছন ফিরে আমার দিকে একবার দেখল। তারপর ছোটো হতে হতে মিলিয়ে যেতে লাগল সামনে। শুধু মাথার সাদা রুমালটা নজর আসছিল। সিগন্যাল সবুজ হতে আমি স্পিড নিলাম, কিন্তু কোথায় আজাদ! সাদা রুমাল-ও গায়েব। ছবি তোলা আর হলো না। কিন্তু মনে গেঁথে গেছে ছবিটা। তাই ভাবলাম, যাক গে, বাড়ি গিয়ে স্কেচ করে ফেলব একখানা।
Leave a Reply