বাবর আলী। বাগদিয়া, শান্তিপুর। ২৮ জুলাই, ২০২০।#
“আর ভাল্লাগছে না! ব’সে ব’সে আর দিন কাটছে না। কাজ-কাম নেই, পকোট ফাঁকা। কন্টোলের ওই ক-কেজি চাল তো পিরায় ফুইরে গেল।
(কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আবার বলতে শুরু করলো)
শালা আগেই ভালো ছিলাম রে ভাই। এরাম ঝম ঝম বৃষ্টির মদ্যে মাথায় বিচের আঁটি নিয়ে এভুঁই ও ভুঁই ক’রে ছুটে বেইরিছি। সন্ধেবেলা গেরস্থর কাছে পয়সা নিয়ে বাজার করে বাড়ি। জ্বর-জ্বালা ছাড়া কিছু হতো না। এখন করোনা, লক ডাউন —-বাপেরকালেও এসব শুনিনি। খালি টেনশান! “
মসজিদের মাইকে তখন জোহরের আজান হচ্ছিল। পুবদিকের আকাশে প্রচণ্ড মেঘ দেখে একটু জোরেই পা চালাচ্ছিলাম। কিছুটা আসতে না আসতেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হল। একটু দৌড়ে আশ্রয় নিলাম পুকুর পাড়ের মাচায়। ওপরে টালির ছাউনি। একটা বৈদ্যুতিক পাখাও ঘুরছে। সেখানে বসে বসে আত্তাব পাকা, সামসুর শেখ, ছিদাম বিশ্বাসের সাথে বছর পঞ্চান্ন-ষাটের খোয়াব আলি ও ঝড়ু শেখরা এইভাবেই নিজেদের সুখ- দুঃখের কথা ভাগ করে নিচ্ছিলেন। শারীরিক দূরত্ব ও মাস্কের বালাই ছিল না। সকালে বিকেলে এবং স্নান করতে যাবার আগে অনেকেই নাকি এখানে একটু আধটু বসে। ওরা মজা করে বলেন- “সারাদিন তো অনেক কাজ সারলাম এট্টু জোত নিয়ে যাই “।
এরা সকলেই এই গ্রামেরই মানুষ। এই গ্রাম মানে বাগদিয়া। শান্তিপুর ব্লকের আড়বান্দী – ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ সমৃদ্ধ গ্রাম। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক চলে গেছে এই গ্রামের বুক চিড়ে। যাঁরা মাচায় বসে ছিলেন সবারই বয়স পঞ্চাশের বেশি। কারও ষাট ছুঁই ছুঁই। এদের মধ্যে আত্তাব পাকা এখন ভ্যানে ক’রে বিচালি নিয়ে শান্তিপুর, ফুলিয়া, হবিবপুর, বীরনগর, বাদকুল্লায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন। ছিদাম বিশ্বাসের লছিমন মানে ইঞ্জিন ভ্যান আছে। মালপত্র ও মানুষজন বহন করে দিন চালান। লক ডাউনের মধ্যে মানুষের এখানে ওখানে যাবার তাগিদ কমেছে ব’লে ভাড়াও কমেছে। তার ওপর এখন আবার টোটো গাড়ির ‘দৌড়াত্ম্য’ । মাঝে মাঝে সারাদিন বসে থেকেও ভাড়া হয় না। সামসুর এখনও মাঠে ক্ষেতমজুরের কাজ করেন। অনেকদিন থেকেই ঘরে বসা। মাঠে কাজ নেই। আর খোয়াব আলি ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ ( মিডিয়া ও রাষ্ট্রের দেওয়া নাম) । নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কখনও কেরালা কখনও ব্যাঙ্গালোরে জোগাড়ের কাজ করেন। আর ঝড়ু শেখ হরিয়ানায় একটি অফিসে গাড়ি দেখাশোনার কাজ করেন। লক ডাউনের আগেই এঁরা বাড়ি এসেছেন। শুধু খোয়াব আলি বা ঝড়ু শেখ নন, এ গ্রামের নবীন- প্রবীণ মিলিয়ে প্রায় ৬০০- ৭০০ জন মানুষ বা তার থেকেও বেশি ভিন রাজ্য ও ভিন দেশে কাজ করতে গিয়েছিলেন। সবাই ফিরতে পেরেছেন এমন নয়। অনেকেই সেখানে এখনও আছেন। কেউ কেউ আবার কাজও করছেন বলে তাঁরা জানান।
এঁদের সাথে কথায় কথায় আরও জানা গেল যে, প্রবীণদের মধ্যে প্রায় সবাই ভিন রাজ্যে গেছেন ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। এর আগে প্রায় সবাই মাঠেই কাজ করতেন। কেউ সরাসরি ক্ষেতমজুর, কেউবা বড় – মাঝারি – ছোটচাষীদের কাছ থেকে জমি ভাগে, বছর চুক্তিতে নগদ খাজনায় অথবা বন্ধক নিয়ে চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। অথচ এখন এঁরাই সেই মাঠ ও মাটি ছেড়ে, দেশ ছেড়ে পরবাসী হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। আত্মীয় স্বজন কেউ মারা গেছেন, কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে অথবা আপনজন কারো বিয়ে হচ্ছে কিংবা পুজো-পরব এইসব খবর পেয়েই তাঁরা দীর্ঘদিন পরে বাড়ি ফিরে আসেন। আর এঁদের ঘরের ছেলেরাই বেশিরভাগ ভিন দেশে ও ভিন রাজ্যে নির্মাণ শ্রমিক, হোটেলের কর্মী, সোনার গহনা তৈরি প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজ করছেন এখন। তাঁদের জীবিকার এহেন পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে যে তথ্য উঠে আসে তা সমাজ-অর্থনীতির তাবড় তাবড় বিশেষজ্ঞ-গবেষকদেরকেও বিস্মিত করে তুলবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
পৃথক তিন তিনটি বুথ ( প্রায় ৩,৫০০ ভোটার) নিয়ে প্রায় ১,৩০০ পরিবার ও হাজার পাঁচেক জনসংখ্যা নিয়ে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন জনপদ। ৮২ বছরের বৃদ্ধ আব্দুল গনি মণ্ডলের কথায়, “এত মানুষ এই গ্রামে আগে ছিল না। বেশির ভাগটাই পরে আসা। পার্টিশনের পরে আস্তে আস্তে লোক সংখ্যা বাড়তে থাকে। আমি যখন দশ-বারো বছরের তখন সারা গ্রাম মিলিয়ে ষাট ঘর মতো মুসলিম এবং পাঁচঘর আদিবাসী বসবাস করতো। হিন্দু মানুষজন কেউ ছিল না। তারপর হিন্দুস্থান-পাকিস্থান হলে এখান থেকে মুসলিমদের অনেকে ওদেশে চলে গেল। আর ওদেশ থেকে বিনিময় করে অনেকগুলো পরিবার এই গ্রামে এল। গ্রামে বেশিরভাগ অংশেই ঝোর-জঙ্গল আর বাগান ছিল।”
যাইহোক যখন এ গ্রামের ক্ষেত মজুররা বাইরে না গিয়ে গ্রামেই কাজ করতেন অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ বছর আগের সঙ্গে এখনকার জনসংখ্যার বা পরিবারের খুব বেশি হেরফের নেই। সেইসময় গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের জীবিকার প্রথম ও প্রধান অবলম্বন ছিল কৃষি। কৃষি-নির্ভর এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন ভূমিহীন। যাদের জমি ছিল, তাদের উপরই এঁরা কোন না কোন ভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। সরাসরি কৃষি নির্ভরতা ছাড়াও রাজমিস্ত্রী, জোগাড়ে, ঘরামী, ধান-চালের খোলাপাটি এবং কৃষিজাত দ্রব্য মজুতের ব্যবসা, ছুতোর, গোয়ালা, ব্যাপারি ( ছাগল-গরু ক্রেতা), হাঁস-মুরগিপালন, চর্মকার, জোলা ( বেতের ধামা-কাঠা-কুলো প্রস্তুতকারক), তাঁতি, শিউলি, ভ্যান-রিক্সাচালক, ঘোড়ার গাড়ি ও ভ্যানে করে বিচালি বিক্রেতা, ছোট-খাটো মুদি ও অন্যান্য দোকানদার – এই রকম নানা পেশার মানুষ ছিলেন। যাদের উপার্জনেরও পরোক্ষ অবলম্বন ছিল এই কৃষিই। কৃষি জমির পরিমাণকে মাথায় রেখে গ্রামের চাষিদের বিন্যাস ছিল এই রকম – বড়ো চাষি (যাদের জমির পরিমাণ ৫০ বিঘার বেশি) ছিল ২০ ঘরের কাছাকাছি, মাঝারি চাষি (যাদের জমির পরিমাণ ৫০বিঘার কম কিন্তু ৩০ বিঘার বেশি) ছিল ৩০/৩৫ ঘর মতো, ছোট চাষির (৫ থেকে ২০ বিঘার মতো জমির মালিক যারা ) সংখ্যা ছিল ৪০-৫০ ঘর। আর ৬০-৭০ ঘর ছিল প্রান্তিক চাষি (যাদের জমির পরিমাণ ১ থেকে ৫ বিঘা)। সব মিলিয়ে এই গ্রামে প্রায় ২,০০০ বিঘার কাছাকাছি জমি চাষ হতো। তার মধ্যে আবার অনেকটা অংশ বিল। গ্রামের প্রান্তিকচাষি ও ক্ষেত মজুররা দু এক মাস বাদ দিলে প্রায় সারা বছরই কাজ করতেন। তখন তাদের জীবন যাপনে এত পরিবর্তন বা বাইরের চাকচিক্য না থাকার দরুণ খেয়ে পরে বেশ চলে যেত। অভাব যে ছিল না তা নয়, তবে আনন্দ ছিল। জীবন ছিল অনেক সহজ সরল। ঝড়ু শেখ জানান, “এখনকার যে জীবন তা ওই উপায় ( উপার্জন) দিয়ে চালানো যেত না। এখন কারেন্ট, টিভি, মোবাইল সব নিয়ে জীবন অনেকটাই আলাদা রকম। ক্ষেতমজুরির পয়সায় এত খরচ চালানো মুশকিল ছিলো। যা বা হচ্চিল টুকটাক তাও তো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল”।
![](https://songbadmanthan.com/wp-content/uploads/2020/07/116266830_2573726999605060_3383547206855541_n-1-1-1024x768.jpg)
কী রকম উপার্জন হতো তখন মাঠে কাজ করে। ওঁদের দেওয়া এক হিসেব থেকে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে,
যেমন — একবিঘা জমিতে দুবার ধান চাষ হতো আর একবার হতো রবিশস্য। আউশ ধান চাষ হতো কম, বেশি হতো আমন ও বোরো। আর রবিশস্যের মধ্যে পাট, সরষে, রাই, তিল, কলাই, মুগ, মুসুর, ছোলা। আর ছিল উচ্ছে, বেগুন, পটল, মুলো, টম্যাটো এবংনানা ধরনের মরশুমি শাক সবজি। ধান চাষ থেকে ক্ষেত মজুররা যে আয় করতেন তা যদি এখনকার হিসাবে ধরা হয় তাহলে এমন দাঁড়ায়, বিঘা প্রতি ধান চাষের জন্য বীজতলা তৈরি করতে ৫০০ টাকা (লাঙল, মই, বীজ ছড়ানো ইত্যাদি), ধান রোপনের জন্য জমি তৈরি করতে লাঙল, মই বাবদ প্রায় ১,৪০০ টাকা, ধান রোপনের খরচ ৮০০-১,০০০ টাকা, ধান ঘাটার জন্য খরচ ৬০০-৮০০ টাকা, ফাঁরি দেওয়ার জন্য খরচ ৪০০ টাকা। ধান কাটা-বাঁধার খরচ প্রায় ২,০০০ টাকা, গাড়িতে করে ধান বওয়ার খরচ হতো ৮০০টাকা, ঝারার খরচ ১,০০০ টাকা। বিচালি গাদা দেওয়ায় খরচ ৪০০-৫০০ টাকা। সবমিলিয়ে একবিঘা জমি থেকে এক সিজনে কৃষক -ক্ষেত মজুররা উপার্জন করতেন প্রায় ৭,০০০ থেকে ৭,৫০০টাকা। দু সিজনে দাঁড়াত কমবেশি ১৫,০০০ টাকার মতো। সরষে বা রবিচাষ থেকে ক্ষেত মজুররা কাজ করতেন ৪,০০০-৪,৫০০ টাকার মতো। আর পাটচাষ থেকে আসতো ১০,০০০-১১,০০০ হাজার টাকা মতো। সুতরাং একবছরে একবিঘা জমি থেকে ক্ষেতমজুরদের ঘরে আসতো ২২,০০০ থেকে ২৪,০০০ টাকা মতো। এবার এই গ্রামে মোট চাষের জমির পরিমাণ যদি মোটামুটি ২,০০০ বিঘা হয় তাহলে কৃষক – ক্ষেত মজুররা কাজ করতেন ২,০০০×২৪,০০০= ৪,৮০,০০,০০০ (প্রায় পাঁচ কোটি) টাকার মতো (হিসেবটা বর্তমানকালের বাজারমূল্য হিসাবে)। যা দিয়ে গ্রামের মধ্যে থেকেই মানুষ তার জীবনযাপনের সব খরচ চালিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু গ্রামের গরীব মানুষদের এই আঞ্চলিক নির্ভরশীলতা কমে গেল কেন?
ওঁদের নির্দেশ মতো চাষের মাঠে গিয়ে দেখলাম মাঠকেমাঠ তিন ফসলি জমিগুলোতে এখন আমবাগান। হিসেব করে দেখা গেল সব মিলিয়ে প্রায় ৪০থেকে ৪৫ শতাংশ অর্থাৎ ৬৫০-৭৫০ বিঘা জমিতে এই বাগান। কোথাও আম, কোথাও লিচু, কোথাও পেয়ারার বাগান। কেননা যারা বড়ো, মাঝারি চাষি, তাদের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেদের চাষের কাজে অনীহা এর একটা বড়ো কারণ। এর পাশাপাশি আছে চাষীদের ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া এবং তার জন্য রাষ্ট্রের মাথাব্যথা না হওয়া। এদেশে চাষি ও কৃষকদের অর্থনৈতিক লাভ-লোকসান নিয়ে সঠিক কোনো রাষ্ট্রীয় নীতি-নিয়ম তৈরি না হওয়ায় জমি ও কৃষিকাজের উপরে মানুষের নির্ভরশীলতা ক্রমেই কমতে শুরু করলো। তাই তারা বিঘা বিঘা তিন ফসলি জমিতে বাগান তৈরি করলো। তাতে তাদের যে লোকসান হলো এমন নয়। বরং বাগান দু বছর তিন বছর চুক্তিতে জমা দিয়ে একটা মোটা টাকা তারা একসাথে হাতে পেয়ে গেল। আর তাদের জমির পাশে ছোটো খাটো চাষিদের থাকা জমিও চাষের অযোগ্য হয়ে পড়লো আওতা বা আবডালের কারণে। ফলে সেই জমিতেও এইভাবে গড়ে উঠলো বাগান। নিজের গ্রামের নিজেদের শ্রম বিক্রির মধ্যে দিয়ে উপার্জিত যে অর্থ নিজেদের মধ্যেই যেভাবে থেকে যেত এবং পারস্পরিক আত্মনির্ভরশীলতার যে জায়গাটা ছিল, তার বুনিয়াদ ক্রমশ নষ্ট হয়ে গেল। গ্রামের বাগানগুলি শহরের ঠিকেদাররাই জমা নেন। গ্রামের দু একজন হয়তো আমের সময় বাগান পরিচর্যা ও পাহারাদার হিসেবে সামান্য বেতনে কাজ পেলেন। কিন্তু শত শত ক্ষেত মজুর, যাদের লাঙল-গাড়ি আছে তারা – এই রকম আরও বহু মানুষ কাজ হারালো। আর যারা অন্যের জমি ভাগে অথবা নগদ খাজনায় নিয়ে চাষবাস করতেন, মরসুমি নানা রকম ফসল ও শাকসবজি চাষ ও বিক্রি করে সংসার চালাতেন, গৃহস্থরা সেইসব জমিতে বাগান করার ফলে এইসকল ভাগচাষীরাও সংকটে পড়লেন।
আর একটা কথাও ওদের মুখ থেকে শোনা গেল যে, মাঠের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কাজ আমাদের ঘরের অনেক ছেলেরাই করতে পারতো না। তার বদলে তারা অনেকেই তাঁতের কাজের সাথেও যুক্ত হয়েছিল। জমিজমা নেই আবার ক্ষেতমজুরও নয় এমন বহু মানুষ মহাজনের কাছ থেকে তাঁত ও তানা এনে ব্যবসা করতেন, তাঁদের বাড়িতেও অনেকে তাঁত বুনে দিন চালাতেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেই তাঁতের বাজার নষ্ট হয়ে গেলে গ্রামের শ্রমজীবী বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়লো। সামসুরশেখ জানালেন,
“একসময় দ্যাখতাম গ্রামের পুরুষমানুষরা মাঠে বেইরে গেলেও গ্রাম গমগম করতো তাঁতিদের জন্য। বাড়ি বাড়ি তাঁতের খট খট শব্দ হতো। আমাদের মুনিশের পয়সার সাথে সাথে বাড়ির বউ ছেলেদের তাঁতের পয়সা মিলে ভালোই চলতো। সেসব দিনও ফুইরে গেল!”
৩৫-৩৬ বছর ধরে তাঁতের কাজের সাথে যুক্ত এই গ্রামের বাসিন্দা ইসমাইল মণ্ডল খুব আক্ষেপের সাথে জানান, “একসময় আমি নিজে তাঁত বুনেছি, তারপর ৭০-৮০ টা তাঁত করেছি। কিছুটা নিজের বাড়ি আর বাকিটা সারা গ্রামেই বাড়ি বাড়ি দেওয়া থাকতো। অনেকেই মাঠের কাজ পারতো না। নারী-পুরুষ বিশেষ করে স্কুলে না পড়া বা পড়া ছেড়ে দেওয়া কম বয়েসি ছেলে-মেয়ে এবং বাড়ির বউরা খুব সম্মানের সাথে সপ্তাহে চার-পাঁচ শ টাকা করে কাজ করতো। কিন্তু কাপড়ের মুনাফা বড়ো মহাজনেরা পেলেও আমরা পেতাম না। সুতোর দাম বাড়লো, কিন্তু মজুরি বাড়লো না । সংসারের খরচ বাড়তে লাগলো। তাঁত ছেড়ে ছেলেরা ভিন রাজ্যে চলে গেল। প্রোডাকশন কমে গেল। আমরা ধরে রাখতে পারলাম না। এখন আমি মুদিখানা চালাই।”
![](https://songbadmanthan.com/wp-content/uploads/2020/07/55764308_2307372826215452_152445332981022720_n-1.jpg)
ক্ষেতমজুরদের অনেকেই এখন ভিনরাজ্যের কাজ থেকে ফেরৎ এসে কাজের খোঁজে রয়েছেন। ছবি- প্রতিবেদক
গ্রামের কাজ হারিয়ে এইভাবেই ঝড়ু শেখ, খোয়াব আলিরা পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হলেন। এ শুধু বাগদিয়া গ্রামেই নয় এই জেলা এই রাজ্যের অনেক গ্রামেই এই বাস্তবতার প্রতিফলন আছে। এঁদের কথা শুনতে শুনতে শরৎচন্দ্রের “মহেশ” গল্পের কথা মনে প’ড়ে গেল। সেখানেও জমির উপর নির্ভরশীলতা কমে যাবার ফলে একবুক যন্ত্রণা নিয়ে দরিদ্র গফুর ছোট্ট মেয়ে আমিনাকে নিয়ে পা বাড়িয়েছিল ফুলবেড়ের চটকলে। যে ছিল কৃষক, সে শ্রমিক হতে চলে গেল। আর ঝড়ু শেখ, খোয়াব আলি, আত্তাব পাকারা জমির কাজ হারিয়ে বহুরকমের জীবিকা বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু করোনার প্রকোপ ও লকডাউনের এই আবহে সেই জীবিকাও ক্রমে ক্রমে হারাতে বসেছেন। কাজ না থাকা এই একঘেঁয়েমি আনন্দহীন জীবনের এই দীর্ঘ যন্ত্রণা ও ‘টেনশনে’র কথা তাঁরা কাকে বলবেন? কোথায় বলবেন ?
Leave a Reply