সৌভিক গুহ। হাবড়া।#
আমার পায়ের তলায় নাকি চাকা লাগানো আছে , ছুটতে ছুটতে একদিন হঠাৎ নাকি একটা চাকুরি পেয়ে যাবো । হ্যাঁ , সেই বয়সটাও হয়েছে । যোগ্যতা বলতে , ওই ছুটে বেড়ানো ( রাষ্ট্র বিজ্ঞানের স্নাতক স্তরের ছাত্র অথচ রাষ্ট্রের কথা তেমন করে বলতে পারিনা , অবার এমন অযোগ্যতাকে যোগ্যতা বলে চালাইও না )। ওই ছুটে চলা… সবসময় কে আর ছোটে! মাঝে মাঝে হাঁটি , সাইকেল চালাই , পিছু নিই চুপি চুপি , পৌঁছে যাই , হারিয়ে যাই, থমকে দাঁড়াই , অবার ফিরে ফিরে আসি । কমবয়সে বন্ধুদের সাথে মেয়েদেরও পিছু নিয়েছি , তবে হারিয়ে যাইনি কোনোদিনও । হারিয়ে গেছি সেইদিন , যেদিন পিছু নিলাম , উম্ হু , রূপসী অথবা সুন্দরীর মোহে নয় , এক ডোমের , – মধু। তিনি স্বয়ং এক বিস্ময় ।
সেদিনও যেন কোথাও একটা পৌঁছানোর ছিল কিন্তু হারিয়ে গেছিলাম অন্য কোথাও – অন্য কোনোখানে । বড়ো রাস্তায় উঠে সেই বিস্ময় , মধু কাকাকে দেখে আর স্থির থাকতে পারিনি , পিছু নিয়েছি চুপিচুপি । এরম পিছু নেওয়া আমি অচেনা এক বন্ধুর থেকে শিখেছিলাম , যে পিছু নেওয়ার নাম , শেষযাত্রা –। আমার বয়সী এক ছেলে ভারী বৃষ্টি ভিজে একটি ভ্যানের পিছন পিছন সাইকেল নিয়ে চলছে , ভ্যানটির পুরো পরিধি চকোলেট রঙের বিছানার চাদর দিয়ে , বেশ ভারী নরম কিছু , দড়ির সাথে কষে বাঁধা । কেবল একটি মানুষের একটি পায়ের পাতা , ভগবান না করুক , ধরুন আমি ঠিক ওরকম ভাবে যদি তাঁর পাশে শুয়ে থাকতাম , তাহলে ওটি বাঁ পা হয় , ভ্যানটির ডান অংশ থেকে চাদর ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে , ভিজছে এবং চাদর লেপ্টে গিয়ে তিনটে অদ্ভুত মুখাবয়বের অবভাস , হয়তো বাবা-সন্তান-মা অথবা মা-সন্তান-বাবা এই ক্রমে সাজানো আছে । মধু কাকা বললো– বাচ্চা ছেলেটারে বিষ দিয়ে , বাপটারে বিষ খাইয়ে , শালি ফ্যানে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে … লকডাউন , খেতে পাচ্ছিলনা , ক্ষিদে … লাশ কাটার পর সেলাই দেওয়ায় সময় ভিতরে কিছু রুটি ঢুকিয়ে দেব , লকডাউন চলছে না !
আমিও সেই অনন্য যাত্রার সাথি হয়েছি ভর দুপুরে ভরা বৃষ্টিতে ।
যারা মনে করে , ডোমের কাজ মানে কেবল লাশ কাটা ঘরের কাজ , গ্রাম – মফস্বলে সেটা সত্য নয় । আমাদের মফস্বলে ডোমকে গাছের মগডালে পর্যন্ত উঠতে হয় – ন্যাশনাল হাইওয়েতে বেলচা দিয়ে এক শিশু ও তার মায়ের অবশিষ্ট অস্তিত্ব স্বরূপ মাংস পিণ্ড চেঁছে তুলতে হয় , এমনকি বালতি ভরে জল ঢেলে কালো রঙের স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা … প্রশ্ন জাগে যেই পরিযায়ী শ্রমিকেরা রেল লাইন ধরে চলতে চলতে ক্লান্তিতে খিদেয় তৃষ্ণায় অবসাদে অনিশ্চয়তায় রেললাইনের উপর অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল , পরদিন সকালে ট্রেনে কাটা দেহগুলি কে উদ্ধার করেছিল ?
আমাদের এখানে অপমৃত্যু অথবা বেওয়ারিশ লাশের শেষ ভরসা – মধু কাকা এবং তার চেলারা , করোনার সময় তাকে কোনোদিন দেখিনি মুখে মাস্ক লাগিয়ে , পকেটে স্যানিটাইজার নিয়ে , হাতে গ্লাভস পরে কাজ করতে । তাড়া খেয়ে বেশ কিছুদিন একটা সবুজ কাপড়ের মাস্ক কপালে ফেট্টির মতন বেঁধেছিল । অথচ অসংখ্য মৃত দেহ সেই সময় মধু কাকা স্ট্রেচারে করে বয়ে এনেছে , পেয়েছে সামান্য কয়েকটাকা ! গভীর মানবিকতায় শেষবারের মতন পরিবারের লোকদের ছুঁতে দিয়েছে নিথর দেহগুলো। শান্তনা যুগিয়ে বলেছে , আমারে নেয় কেনো বলতো ! থাক , আর ওই নতুন গামছা – সাবান দিতে হবেনা । কী করবো এত এত গামছা – সাবান নিয়ে? সাহস হয়নি কথা বলার , বিনা কারণে ঘন্টার পর ঘন্টা তার কথা শুনেছি , চেলাদের সঙ্গে ঝগড়া খিস্তি খেউড় শুনেছি , কখনও বিড়ি চাইলে দৌড়ে গিয়ে সিগারেট এনে দিয়েছি । জিজ্ঞেস করেছে , কী হয়েছে ( হসপিটালে এসেছিস কেন ? ) – মিথ্যে বলি । একটি মিথও তৈরি হয়ে গেছে হাবড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতাল জুড়ে – ওই মধু কাকা , পাঁচ ফুটের মতন উচ্চতা , দাঁত ফোকলা , সারাক্ষণ বসন্তের মতন মৃদু হাসি লেগে আছে , কখনো টাক কখনও গুড়ি গুড়ি কাঁচা – পাকা কদম ছাঁট চুল , একটি মলিন লুঙ্গি , ঢিলে গেঞ্জি , রাতের দিকে আকন্ঠ বাংলা গিলে থাকা মানুষটির একটি ফোন নম্বর যা হাসপাতালের ভিতর দেওয়ালে সাটানো , তার মৃত্যুর পরেও নাকি সেই নম্বরে ফোন আসলে মধু কাকা পৌঁছে যাবে । বিশ্বাস করতে ভালো লাগে , পথ চলার সময় অথবা বিষন্নতায় ভুগলে।
সেদিন বেলা সাড়ে দশটা হবে । মধু কাকার ভ্যান হনহন করে আমাকে টপকে গেলো । পিছু নিলাম । মধুর চলার রেশ রয়ে যায় পিছে , যেমন করে স্থির জলে ঢিল ছুড়লে তার ঢেউ পাড়ে এসে ধাক্কা খায় । রাস্তার দুপাশে মানুষজন তেমনি বলাবলি করে , কোথায় মরলো কে জানে ! ও মধু দা কোথায় … আমি বেশ খানিক দুরত্বে তার পিছন পিছন , আমাদের দুজনের মাঝে অনেকই আসছে অবার মিলিয়ে যাচ্ছে , যেনো কেউ টের না পায় পিছু নেবার , এটাই পিছু নেবার নিয়ম । কতদূর যাচ্ছি ঠিক নেই , যে মফস্বলে বেড়ে উঠেছি এখনও তার শেষ সীমা চিনিনা । হাঁকাহাঁকি চলছেই , কেউ প্রণাম ঠুকছে , মৃতের শান্তির উদ্দেশ্যে । অন্যদিকে আমি এবং মধু অস্থির হয়ে উঠছি । ছোট্ট ফোনটা তুলে মধু কাকা বলছে — এইখানে , ওইখানে । আমার চেনা রাস্তা শেষ হয়ে আসে একসময় , হারিয়ে যেতে শুরু করেছি । আড়ালে চলতে চলতে চরম এক একাকিত্ব – ভয় বাসা বাঁধছে দুপায়ে । মাইলস্টোন দেখতে দেখতে বুঝি ১২ কিমি দূরে চলে এসছি । মাইলস্টোন একসময় শেষ হয়ে , এক গ্রামের গলিতে ঢুকলাম , জানলাম হাবড়ার পূর্বে সীমানায় এটাই শেষ গ্রাম – পঞ্চায়েত । রাগ হলো , এই মানুষটিকে এতদূর ভ্যান ঠেলে ঠেলে আসতে হলো ! অথচ অ্যাম্বুলেন্স ডাকলে অসুবিধা কি হতো ! কিন্তু মধু তো রিফিউজ করেনা । গ্রামের এক পাশে সবুজ ধানের মাঠ , পুকুর , অন্যদিকে এক মাদকতা লাগানো মানুষের ঔৎসুক্য দৌড়ে রাস্তায় উঠে আসছে , মধু কাকা এগিয়ে গেছে , তাই তারা আমার রাস্তা আটকে তাকে দেখার চেষ্টা করছে। আমি ভেবে চলেছি – বিষ খেয়েছে , গায়ে আগুন দিয়েছে , খুন হয়েছে বীভৎস ভাবে , ফ্যানের সাথে গলায় দড়ি অথবা গোয়াল ঘরের মাচার সাথে ! জিজ্ঞেস করতে করতে মধু কাকা গ্রামীণ সড়ক যোজনার রাস্তা ছাড়িয়ে বালি মাটির সাদা রাস্তায় নেমে গিয়েছে । গ্রামবাসী অমনি হই হুল্লোড় শুরু করে দিয়েছে । সোজা তাকালে দুপাশে ঝোপঝাড় রেখে দূরে একটি বিশাল আমবাগান , পুলিশের গাড়ি । পাশেই ঘোমটা দেওয়া মহিলারা বলাবলি শুরু করেছে – এই লোক ওই গাছে উঠবে কী করে ! ওই ঝড় জলের রাতে কিভাবে যে মগডালে উঠলো ভাবা যায় ! আমার সমস্ত অনুমান – অভিজ্ঞতা নিমেষে উবে গেল । মগডালে মধু কাকা ! পরলাম না আর । সাহসে কুলালো না পাড়া পড়শীর ভিড়ে মিশে যেতে। থেমে গেলাম , আফশোশ রাগ বিষণ্ণতা গালাগাল ক্রমেই আমার দু’পা অবশ করে দিতে লাগলো । এতদূর এসে তাকে একা রেখে চলে যাবো । এই ১২ – ১৩ কিমি মধু কাকা একা একা ওই মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাবে । এই ভাবতে ভাবতে পুলিশ গাড়ি আমায় অতিক্রম করে চলে গেলো। তখনও হয়তো মগডালে মৃতদেহ ঝুলছে । তৃষ্ণায় বুক ফেটে গলা চিরে আসছিল । তবুও ক্ষোভে কোথাও জলের খোঁজে দাড়ালাম না । এইটুকু সাহস হলো না , কাছে যাবার … গভীর অনুশোচনায় ওই ১৩ কিমি পথ একা একা ফিরে এসেছিলাম । বসে পড়েছিলাম মাটিতে । মা জল এগিয়ে দিয়ে বলেছিল – কি রে , পড়াতে যাসনি ? …
তখনও ভেবে যাচ্ছি মধু কাকা কি ফিরলো ! চিন্তা হচ্ছিল , ওই অত দূরের রাস্তায় মধু কাকা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটা্লো না তো !
সেদিন বেলা অব্দি অপেক্ষা করে অবশেষে সন্ধ্যায় আবগারির সামনে তাকে খুজেঁ পেলাম ।
৫০০ টাকা পেয়েছে , একটা বডি ৫০০ , মধু কাকার এই বিপুল পরিশ্রম , এই জার্নি …! মৃতদেহরা কি মধুর সাথে কথা বলে , নইলে ওভাবে আসা যায়না । মধু কাকা বহুবার আমায় দেখেছে , সেদিনও দেখেছে । বাংলা গিলে সেদিন আমায় প্রথম সম্মোধন করলো – কিরে কোথায় চলে গেলি হঠাৎ ? – আমি মাথা নিচু করে বলেছি , আমার সেই নার্ভ নেই মধু কাকা । অট্টহাসিতে মধু কাকা হেসে ওঠে। ” লাশ নিয়ে অনেক প্রাক্টিকাল হলো …”
লাশ নিয়ে অনেক প্রাক্টিকাল হলো …
আজ যদি মধু কাকার চেলারা শোনে , খবরের হেডলাইন – ডোমের চাকরির লাইনে স্নাতক , ইঞ্জিনিয়ার , গবেষক, গোল্ড মেডেলিস্ট … ,
নিশ্চয়ই প্রধান চেলা বাবু উদাত্ত কণ্ঠে বলে উঠবে — বাইশ বছর ধরে আমি গাঢ় মাড়িয়ে চলেছি এইখানে , এই মধু, ওরা কতদিনের? …
Leave a Reply