সৈকত মিস্ত্রী, অশোকনগর, ১৫ নভেম্বর#
৯ নভেম্বর সোমবার এসপ্ল্যানেড মেট্রোতে চেপেছি। নামলাম দমদম। সাবওয়ে দিয়ে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম। দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেনের খবর হয়নি। রাত আটটা বেজে গেছে। উসখুস করছি। আমাকে অনেকটা যেতে হবে। হঠাৎ দেখি দুই তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের কোনার দিকে একটা জটলা। প্ল্যাটফর্মের মাথার দিকে, অর্থাৎ শিয়ালদার দিকে। যেখানে একটা বাথরুম আছে। ভিড়টা নড়ছে চড়ছেও না। ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে লাইনে নেমে পড়লাম। ট্রেন লাইন পার করে লাফিয়ে উঠলাম দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে। ভিড়টার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। দুই-তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের মাথার দিকে একটা শেড। শেডের পিলারে ঠেস দিয়ে একজন মহিলা বসা। পরিধেয় পোশাকটা মলিন, অপরিচ্ছন্ন। পায়ে জুতো নেই। গায়েও ধুলো বালির ছাপ। চোয়াল দুটো ভাঙা। চোখ দুটো কোটরাগত। দেখে মনে হলো প্ল্যাটফর্মেই সে থাকে। ভিক্ষাজীবী। কোলে একটি সদ্যজাত শিশু। ওর মলিন আঁচল দিয়ে জড়ানো। ভিড়ের মধ্যে থেকে নানা মন্তব্য ওর দিকে ছুটে আসছে। সে নীরব।
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন মহিলা এগিয়ে এলেন। পরনে সবুজ সালোয়ার। হাতে একগাছা চুড়ি। বিবাহিত কিনা বোঝা গেল না। সঙ্গে একজন পুরুষ। দু’জনেরই পরিধেয় বেশ মলিন। দুই-তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই কোনায় যারা রাত্রি যাপন করে, অনেকটাই তাদের মতোই এদের চেহারা। সালোয়ার পরা মহিলাটি বলে, ‘হাসপাতালে যাও। ওখানে খাওয়া পাবে, ইনজেকশন পাবে।’ বাচ্চা কোলে মহিলাটি চুপ করে থাকে। ভিড় থেকে কয়েকজন বলে ওঠে, ‘হাসপাতালে যাও। জিআরপিকে খবর দিই।’ মহিলাটির চোখ ছলছল করে ওঠে। সে ধীরে বলে, ‘না যাব না।’ সালোয়ার পরা মহিলাটি ওর দিক থেকে সরে আসে। সঙ্গের পুরুষটির সঙ্গে কথা বলে, ‘বাচ্চাটা মরেই যাবে। ওকি আর মানুষ করতে পারবে? নিজেরই খাওয়া নেই। হাসপাতালে যাচ্ছে না। কথাও শোনে না। ফূর্ত্তি করতে গিয়ে …’। তার দিকে এগিয়ে যাই। সবুজ সালোয়ার পরাকে জিজ্ঞেস করি, ‘কি হয়েছে? বাচ্চাটা কবে হয়েছে?’ মহিলা বলে, ‘ও কার সঙ্গে কী করেছে, এখন ভুগছে। আজই বাচ্চাটা হয়েছে।’ বলি, ‘কোথায়?’ ‘আশেপাশে কোথাও’ — সালোয়ার পরা জানায়। যোগ করে সে, ‘এখনও বসে বসে কাঁদছে।’ বলি, ‘কেন?’। ‘ওর মানুষটা ওকে ছেড়ে চলে গেছে’। মহিলাটি আরও দু-একজনের সঙ্গে গুঞ্জনে মুখর হয়ে ওঠে। ভিড়টা পাতলা হতে শুরু করে। এগিয়ে যাই সে শিশু কোলে থাকা মহিলার দিকে। ফুটফুটে এক সদ্যজাত শিশু। তার মায়ের শরীর ভেঙে গেছে। অনাহারে, লোকলজ্জার দহন তার সর্বাঙ্গে। অথচ এখনো প্রাণশক্তিতে, উৎপাদন শক্তিতে প্রাণবন্ত। ওর দিকে ঝুঁকে আসি। জিজ্ঞাসা করি, ‘বাচ্চাটা কি আজই হয়েছে?’ সে চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ‘হ্যাঁ’। আমিও একটু থামি। তারপর বলি, ‘ওর বাবা কোথায়?’ মহিলাটি ফুঁপিয়ে ওঠে। ওর চোখ ছলছল করে। চোখের কোণ ঘেঁষে জল গড়ায়। অস্ফুটে সে বলে, ‘সে চলে গেছে’। বলি, ‘তুমি ওকে রাখবে না কোথাও দিয়ে দেবে? কোনো হোম-এ বা কাউকে কি দেবে?’ সে বলে, ‘না … আমি রাখবো।’ আমি বলি, ‘ওকে মানুষ করতে পারবে না তো।’ বাচ্চাটাকে সে আরো গাঢ় আলিঙ্গনে বুকে টেনে নেয়। চুপ করে থাকে। আবারও একই প্রশ্ন করি। উত্তরে অস্ফুটে ও জানায়, ‘পারবো’।
ওপাশ থেকে এগিয়ে আসে সবুজ সালোয়ার পরা সেই মহিলা। শেডের থামের গোড়ায় উঁচু জায়গায় সে বসে পড়ে। ওর পুরুষ সঙ্গীটিও পাশে গিয়ে বসে। সালোয়ার পরা মহিলাটি ঝুঁকে পড়ে বাচ্চাটাকে দেখতে থাকে। হঠাৎ নিজের সালোয়ারের ওড়নাটা খুলে দেয় শিশুর মাকে। বলে, ‘বাচ্চাটাকে ভালো করে জড়িয়ে নাও। ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।’ একটু থেমে সে যোগ করে, ‘কিছু খাবে?’ নিজেই সে বলতে থাকে, ‘কাঁচা নাড়ী, ভাত দেওয়া যাবে না।’ ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন একটি দশটাকার নোট শিশুর মায়ের সামনে রাখে। প্ল্যাটফর্মের পেছনের দিক থেকে এগিয়ে এল একজন বৃহন্নলা। ভিড় সরিয়ে সে সামনে এল। ঝুঁকে পড়ল বাচ্চাটির দিকে। তারপর মুখ দিয়ে একটা শব্দ করে বলল, ‘আহা!’ ওর ব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে মহিলার সামনে সে রাখে। বলে ওঠে, ‘কেউ একটু চা নিয়ে আয় না’। আর একজন যুবক এগিয়ে এল। বাচ্চাটাকে দেখে থমকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে একশো টাকার একটা নোট তার সামনে রাখলো। আর একটু সময় দাঁড়িয়ে কিছু না বলে চলে গেল। ইতিমধ্যে একজন প্লাস্টিকের গ্লাসে চা নিয়ে এসে মহিলার হাতে দিল। মহিলা চা পান করল। সবুজ সালোয়ার আরও জোরাজুরি শুরু করল। ‘হাসপাতালে চলো। দুদিন খেতে পাবে। তবে তো বাচ্চাটা খেতে পারবে।’ মহিলা বাচ্চা কোলে নির্বাক থাকে। সালোয়ার পরিহিতা বলে চলে, ‘টাকাগুলো সাবধানে রাখো। বাচ্চাটাকেও সাবধানে রেখো। চারদিকে যা চোর।’ একশো টাকার একটা নোট ওর সামনে রাখি। মহিলার মধ্যে তবু কোনো হেলদোল নেই। শেষে সবুজ সালোয়ার নিজেই হাঁটু গেড়ে বসে টাকাগুলো গোছ করে মহিলার হাতে দেয়। সে মুঠো করে চেপে ধরে।
ধীর পায়ে মধ্যবয়সী একজন এগিয়ে আসে। বেশ কৌতুহলী। ধোপদুরস্ত পোশাক। কাঁধে ফিতেওয়ালা অফিস ব্যাগ। দেখে মনে হলো বেশ দামি। চোখে রিমলেস চশমা। ঝুঁকে পড়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’ ‘আজ ওর বাচ্চা হয়েছে। ওর লোকটা ছেড়ে চলে গেছে। এখন ও কষ্ট পাচ্ছে।’ ভদ্রলোকের মুখটা বিকৃতি আর বিরক্তিতে ভরে ওঠে। শিশু ও তার রুগ্ন মায়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে তিনি সরে যান। যেতে যেতে বলতে থাকেন, ‘এদের গুলি করে মারা উচিত। ফূর্ত্তি করবে আর বাচ্চার জন্ম দেবে।’ তরাক করে সোজা হয়ে যাই। লোকটার কাছে সরে এসে বলি, ‘ফূর্ত্তি কি শুধু ভদ্রলোকদের জন্য?’ লোকটা ঘুরে তাকায়, তারপর চলে যায়।
এরমধ্যে দেখি দু-জন জিআরপি এসে হাজির হয়েছে। মহিলা। দুজনেই অবিবাহিত। মনে হলো সদ্য চাকরি পেয়েছে। বাচ্চার মাকে দেখে একজন বলল, ‘স্যারকে ফোন করছি।’ সরে গিয়ে সে ফোন করল। ফোন শেষ করে মহিলার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘হসপিটাল চলো’। মহিলাটি আরো কুঁকড়ে গেল। আবারও ভিড় জমে উঠল এখানে। কমবেশি সবাই বলল, ‘ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান’। সবুজ সালোয়ার আপত্তি জানায়, ‘ও তো ব্যাথায় দাঁড়াতেই পারছে না। যাবে কী ভাবে?’ জিআরপি মহিলাটি বললেন, ‘গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হবে।’ কিন্তু মহিলাটি নড়তে চায় না। বোঝা গেল সে যাবে না। শেষে জিআরপি মহিলাটি বললেন, ‘উনি যখন চাইছেন না, তখন থাক। আমরা আছি।’ আমি প্রশ্ন করি, ‘এভাবেই পড়ে থাকবে?’ জিআরপি মেয়েটি জানায়, ‘আমরা আছি, কোনো সমস্যা হবে না। চিন্তা করবেন না।’ বলি, ‘ঠিক আছে’।
ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একজন পুরনো চাদর নিয়ে এল। মহিলাটি সেটি দিয়ে ভালো করে বাচ্চাটাকে ঢেকে দিল। জিআরপি মেয়েটি বললেন, ‘ওর নাকটা যেন খোলা থাকে। না হলে শ্বাস নিতে পারবে না।’ অদূরে একজন ভিক্ষাজীবী বৃদ্ধ শুয়ে ছিলেন। উঠে বসলেন তিনি। তার শোয়ার প্লাস্টিকটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওকে দিন’। একজন প্লাস্টিকটা এগিয়ে দিল। আপ ট্রেনের খবর হলো। দেখি তিন নম্বরে ট্রেন ঢুকছে। নয় বগি। সামনে এগোতে হবে। ওই মা আর শিশুকে ফেলে এগোতে থাকলাম। এগোনোর মুখে পেছন ঘুরি। ভিড়টা একটু পাতলা হয়েছে। সেই মা যত্ন করে শিশুকে কোলে নিয়ে বসা। ওর চোখে মুখে যন্ত্রণা আর বিধ্বস্ততার ছাপ। তবু এক অনাবিল তৃপ্তি ওর শীর্ণ মুখটাকে ছড়িয়ে আছে। ট্রেনটা ঢুকলো। ছুট দিলাম। সবটা পেছনে ফেলে ট্রেনে চেপে এগিয়ে গেলাম বাড়ির দিকে।
পরের কথা : চারদিন বাদে যেতে হয়েছিল দমদম। ব্যস্ততা ছিল। তবু ২-৩ এর প্ল্যাটফর্মের ঐদিকটা ঘুরে এলাম। সেই মা-শিশুকে খুঁজে পেলাম না। তারা কোথায় আছে জানি না? কেউ কি জানে?
saikat mistry says
gata 21 tarik dum dum giya khoj niya janlam bacha ta k or ma bikri kora kotha o chola galo
Shamik Sarkar says
বলো কি গো?
Prodyut Sarkar says
সবে গুনতে সেখা শিশুর উপযুকত সংখক মানুষ এরকম অনবরত ঘটে চলা ঘটনায় সাড়া দেয়। বাকি সবাই কটু comments করে চলে যায় অথবা নজর পড়ে না বা দিতে চায় না। সেই কম সংখক সাড়া দেওয়া মানুষরাও আবার এটাকে out of sight out of mind করে ফেলে। কিছু সংখককে মাঝেমাঝে খোচা মারে কিছু না করতে পারার জনন, চটকে যায় তাদের তথাকথিত সুখ(আসলে সবাই মিলে সুখে থাকাটাই যে সুখ সেটা অনুভব করে বলেই)। কেউ কেউ কিছু দান করে দায় এড়াতে চায়। rarest of rare কিছু করতে পারে। আসলে আমাদের tolerable limit কে দিন কে দিন বাড়িয়ে চলেছি। তবুও যেন সে limit এর saturation হচছে না। চাই, তাড়াতাড়ি সেই saturation আসুক । আর চটকে যাক একক সুখে থাকা।