- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

হাবড়ায় বীরপুরুষদের রেল অবরোধ : ‘হাতে তুলে দেওয়া’র দাবির মধ্যেই পোশাক বদলে পালিয়ে বাঁচল মেয়ে

রীনা মণ্ডল, হাবড়া, ২৪ আগস্ট ২০১৫#

ট্রেনের গায়ে 'লেডিস হাটাও'  পোস্টার ঝুলিয়ে দিয়েছে অবরোধকারীরা। ২৪ আগস্ট হাবড়া।
ট্রেনের গায়ে ‘লেডিস হাটাও’ পোস্টার ঝুলিয়ে দিয়েছে অবরোধকারীরা। ২৪ আগস্ট হাবড়া।

আজ সকাল থেকেই বনগাঁ শেয়ালদা লাইনে রেল অবরোধ চলছে। পুরুষদের অবরোধ — মাতৃভূমি লোকালে জেনারেল কম্পার্টমেন্ট চালু করতে হবে। সারা প্লাটফর্ম ভর্তি অসংখ্য পুরুষ। রেললাইনে পুরুষ (তারা সকলেই ট্রেনযাত্রী কি?) চিৎকার চেঁচামেচি হৈচৈ গণ্ডগোল ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। আজ হাবড়া স্টেশনে সকাল সাতটা ঊনপঞ্চাশের মাতৃভূমি লোকাল প্লাটফর্মে ঢুকতে দেয়নি পুরুষরা। কোনোরকমে মাত্র দুটি কম্পার্টমেন্ট প্লাটফর্মে ঢুকতে পেরেছিল। ট্রেনের গায়ে লিখে দিয়েছে ‘পিতৃভূমি লোকাল’, ট্রেনের সামনের বোর্ডে অভিনেতা জিতের রঙিন ছবি টাঙিয়ে দিয়েছে বীরপুরুষেরা। প্লাটফর্মে নামতে না পেরে অবরুদ্ধ মেয়েদের লাইনে আটকে কী অবস্থা হয়েছে তারা কি করেছে সেই মজাই দেখেছে এইসব পুরুষরা।
আজ একটু দেরি করেই হাবড়া গিয়ে প্লাটফর্মে প্রায় কোনো মহিলা যাত্রী দেখতে না পেয়ে অত পুরুষের মাঝে যেতে যেতে বান্ধবী বলছিল — যাওয়া ঠিক হবে? তবুও ফাঁকা বগির ভেতরে উঠে বসলাম। জিআরপি ট্রেনের ভেতরে ও বাইরে পাহারা দিচ্ছে। ভেতরে কয়েকজন মহিলা যাত্রী আর কয়েকটি ছাত্রীও আছে। তখন বেলা নটা পনেরো কুড়ি হবে বোধহয়। একটা মেয়ে, বয়স তেইশ চব্বিশ হতে পারে, পরণে চুরিদার, গলায় ওড়না, শান্তশিষ্ট, ট্রেনের তার ব্যাগটি রেখে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে একটু ট্রেন থেকে নেমেছে। ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি ছেলে আচমকা মেয়েটিকে থাবা মারে। মুহুর্তের মধ্যে মেয়েটি ঘুরে ছেলেটির পিঠ চাপড়ে চিৎকার করে প্রতিবাদ করে ওঠে। এমন সময় ছেলেরা একটি মেয়ে মেরেছে বলে একটা শোরগোল তোলে। মেয়েটি দ্রুত কম্পার্টমেন্টে ঢুকে পড়ে। অতি দ্রুত পুরুষ যাত্রীরা এককাট্টা হতে থাকে। সেই সময় উত্তেজিত পুরুষরা হিংস্র আক্রোশে তেড়েফুঁড়ে আসে। আমি ওদের বলার চেষ্টা করি, ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি ছেলে মেয়েটির গায়ে হাত দিয়েছে, টিজ করেছে…।
কিন্তু কে কার কথা শোনে? উল্টে দু-জন মাঝবয়সী মহিলা ওইসব পুরুষদের হয়ে আমার সাথে ঝগড়া শুরু করে দেয়। পুরুষদের মধ্যে কেউ আবার তেড়ে আমায়ই মারতে আসে। মারমুখী পুরুষদের হাত থেকে গুটিকয় মহিলাকে রক্ষা করতে দ্রুত কম্পার্টমেন্টের দরজা জানলা বন্ধ করে ফেলা হয়। ওরা উন্মত্তের মতো দরজা জানলা পেটাতে থাকে। ওইসব হিংস্র পুরুষরা হুঙ্কার দিতে থাকে, ওই মেয়েটিকে আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে। আরো অনেক জিআরপি এসে যায়। এমন একটা পরিস্থিতিতে জিআরপিদের কেউ কেউ ওই মেয়েটিকে পুরুষদের কাছে ক্ষমা চাইতে বলে। মেয়েটি বলে, একটি ছেলে আমায় টিজ করল, আক্রমণ করল, আর আমি কেন উল্টে ওদের কাছে ক্ষমা চাইব? জিআরপিদের সাথে সহযাত্রী মহিলাদের অনেকেই ওই আক্রান্ত মেয়েটির বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে লাগল — তুমি কেন এমন করলে? কেন প্রতিবাদ করতে গেলে? এমন তো কতই হয়ে থাকে। এমন এক পরিস্থিতিতে একজন মহিলা ক্ষোভের সঙ্গে ওই মেয়েটির কাছে দাবি করল, তুমি আমার রোজের দাম দাও। তোমার জন্যই ট্রেন চলছে না, আমি কাজে যেতে পারছি না। দু-একজন অবশ্য বলল, ট্রেন তো অবরোধ করেছে ওইসব ছেলেরা। বিশ্রি একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে লাগল।
এমন দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে মেয়েটির মোবাইল ফোনটা ঠিক কাজ করছিল না। ও কাছের এক সহযাত্রী মেয়ের মোবাইল ফোন থেকে একটা মিসড কল করে বাড়িতে খবর দিতে চাইল। ওই মেয়েটি মোবাইলটি দিল না। আমি আমার মোবাইলটা মেয়েটিকে দিলাম। মেয়েটি ওর দিদির সাথে কথা বলল। আমিও কথা বললাম। ইতিমধ্যে একজন বয়স্ক জিআরপি অফিসার ঢুকল। তিনি মেয়েটিকে বললেন, আপনি আমার মেয়ের মতো। আপনার আপত্তি না থাকলে তুমি করেই বলি। তোমাকে আমি ওদের কাছে ক্ষমা চাইতে বলব না। বলতে পারিও না। তোমাকে আমরা গার্ড দিয়ে তুমি যেখানে যেতে চাও সেখানে পৌঁছে দেব। আর আরও দরকার হলে, আমার গাড়িতে করে তোমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেব। মেয়েটিকে আশস্ত করার চেষ্টা করে চলে গেলেন। বাইরে পরিস্থিতি প্রচণ্ড উত্তপ্ত। আবার কয়েকজন জিআরপি আর মহিলা যাত্রীরা মিলে মেয়েটির ওপর চাপ তৈরি করল ক্ষমা চাইবার জন্য। কয়েকজন জিআরপি মেয়েটিকে নিয়ে ক্ষমা চাইবার জন্য কম্পার্টমেন্টের গেটের দিকে যেতে গেলে আমি দ্রুত মেয়েটিকে ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে নিতে বললাম। মেয়েটি উন্মত্ত পুরুষগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কোনোরকম সরি বলেছিল, ওরা চিৎকার করে মেয়েটির ওড়না সরাতে বলে। পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে ভেবে জিআরপি-রা দ্রুত ওকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ওরা আবার দরজা জানলা পেটাতে থাকে। জিআরপি রা বলে তুমি ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে লুকিয়ে থাকো।
এমত পরিস্থিতিতে মেয়েটি মাঝে মাঝেই বলছে, আমার বাবা জানতে পারলে আমাকে ভীষণ বকবে। ও যেন ওর বাবার ভয়তেই কাবু। ইতিমধ্যে ওর বাবার সঙ্গে ফোনে কথা হলো। উনি এই পরিস্থিতির মধ্যে আসতে চাইছেন। উনাকে ফোনে বোঝাবার চেষ্টা করছি, আপনি এই পরিস্থিতিতে এইসব পুরুষদের মাঝে হাজির হলে মেয়েটার আরো বিপদ ঘটবে। ওরা মেয়েটাকে চিনে ফেলবে, আর মেয়েটার রক্ষা থাকবে না। এখন জিআরপি পুরো কম্পার্টমেন্ট গার্ড দিয়ে রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতে ওনাকে বোঝানো আরেকটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। এমন করে বোধহয় ঘন্টাখানেক কাটল। এতক্ষণে পুরো ট্রেনটাকে প্লাটফর্মে ঢোকানো সম্ভব হয়েছিল। ট্রেনটা প্লাটফর্মে ঢুকতেই কিছু উন্মত্ত পুরুষ পাথর ছুঁড়তে লাগল। জিআরপিদের একজনের হাতেও পাথর লাগল। ওইসব হিংস্র পুরুষদের মধ্যেও চিৎকার করে মেয়েটিকে ওদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলতে লাগল।
কিছুটা স্থিতাবস্থা ফিরতে হঠাৎ দুজন জিআরপি মহিলা এসে একটা বুদ্ধি দিল, মেয়েটিকে দ্রুত পোশাক বদলে একটা শাড়ি পড়ে নিতে। দ্রুত একজন সহযাত্রীর কাছ থেকে একটা শাড়ি জোগাড় হলো। জিআরপি মেয়েটি এবং আমি তৎপরতার সঙ্গে চুরিদারের ওপরে শাড়িটা গিট দিয়ে ওকে পরিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিলাম। চুরিদারের প্যান্টটা পাছে শাড়ির নিচে বেরিয়ে যায়, তাই তাড়াতাড়ি গুটিয়ে দেওয়া হলো। এরপর একটা সুযোগ বুঝে জিআরপির সহায়তায় একজন যাত্রী অসুস্থ হয়েছে বলে ওর মাথায় জল দিতে দিতে ওকে ট্রেনের বাইরে এনে আমি ধরতে ধরতে ধীরে ধীরে রেল চত্বরের বাইরে বেরিয়ে গেলাম। জিআরপি-রা আমাদের পার করে দিয়ে মেয়েটিকে বলল — আপনি এখন আর কয়েকদিন বাড়ি থেকে বেরোবেন না। আমরা জান হাতে করে পথে নামলাম। পথে যেতে যেতে মেয়েটি শাড়ির তলা থেকে বেরিয়ে পরে প্যান্টটা তুলে নিতে চেষ্টা করছে। চলতে চলতে মেয়েটির ভয়ার্ত জিজ্ঞাসা — পরে যদি ওরা আমায় চিনতে পারে। আমাকে ধর্ষণ করবে না তো…।
ওর আত্মীয় বাড়ি পৌঁছলাম, মেয়েটির মামী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। বাবাও এলেন। উনি কিন্তু বকতে ছাড়লেন না। আমি তো তোকে বারবার বাড়ি ফিরে আসতে বললাম। তুই তো শুনলি না। এরপর ওর বাবা আমায় মোটরবাইকে এগিয়ে দিতে এলেন। গলির মোড়ে অপর একটা মোটরবাইকের সাথে এক্সিডেন্ট-এ আমরা দুজন পড়ে গেলাম। বেশ ব্যাথা পেলাম। ওনার কেটে ছড়ে গেল। তবু উনি আমায় এগিয়ে দিলেন। বাড়ি এসে জানলাম, আমার এলাকায়ও খবর রটেছে দু-একজনের কাছে, আমি ট্রেনে আটকা পড়েছি। পুরুষ যাত্রীরা আমার ওপর চড়াও হয়েছে …।

সাক্ষাৎকার ও অনুলিখন : বঙ্কিম