- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

সুন্দরবনের সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির ঐতিহ্য জয়নগরের রক্তাঁ খাঁ প্যারার বিবিমা পুজো

সঞ্জয় ঘোষ, জয়নগর, ১০ ফেব্রুয়ারি#

জয়নগর বিবিমার থানের ভিতরে সাদা শাড়ি পরিহিতা মুসলিম মহিলা পুরোহিত। বাইরে পুজো দেবার অপেক্ষায় বিভিন্ন উপাচার হাতে হিন্দু মহিলা ভক্তগণ।
জয়নগর বিবিমার থানের ভিতরে সাদা শাড়ি পরিহিতা মুসলিম মহিলা পুরোহিত। বাইরে পুজো দেবার অপেক্ষায় বিভিন্ন উপাচার হাতে হিন্দু মহিলা ভক্তগণ।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও কলকাতার বিভিন্ন স্থানে বিবিমা বা ওলাবিবি নামে এক লৌকিক দেবী দীর্ঘদিন ধরে পূজিত। কলেরা, ডায়েরিয়া এবং পায়খানা বমি অর্থাৎ ওলাওঠার মতো রোগ থেকে পরিত্রাণ পাবার আশায় মানুষ এই দেবীর পুজো দেয়।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর রেল স্টেশনের পশ্চিম দিকে মিনিট চারেক হাঁটলেই কুলপি রোড ও আদি গঙ্গার অবশেষ রূপে অবস্থিত বিবিমা। গঙ্গার পশ্চিম তীরে ২৫০ বছরেরও আগে থেকে বিবিমা পূজিত। সাধারণত পৌষ, মাঘ, ফাল্গুনের শনি বা মঙ্গলবার দল বেঁধে দূর দূরান্ত থেকে মহিলারা উপোস করে এই পুজো দিতে আসে গলায় খড়ের মালা বা বদি পরে। তার আগে মহিলারা বাড়ি বাড়ি মাঙ্গন অর্থাৎ ভিক্ষা করে পয়সা ও চাল সংগ্রহের প্রথা পালন করে। এই পুজোয় ন-টি আস্ত ফল দেওয়ার রীতি আছে।

বিবিমা পুজোয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী তথাকথিত উচ্চ, মধ্য, নিম্ন সব বর্ণের মানুষ পুজো দিতে এলেও নিম্নবর্ণের প্রাধান্য দেখা যায়। এই থান-এ (অর্থাৎ লোকদেবদেবীর পুজোর স্থান) গোড়া থেকেই একজন মুসলিম পুরুষ বা মহিলা পুরোহিতের কাজ করে। বর্তমানে একজন প্রৌঢ়া মুসলিম মহিলা গত প্রায় ১৫-২০ বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। হিন্দু যেসব মহিলারা পুজো দিতে আসে তারা সবাই তাঁকে মা বলে সম্বোধন করে। বর্তমানে সমতল ছাদের চতুষ্কোণ পাকা থানের ভিতরে দুটি মাটির ছোটো স্তূপ প্রতীকে বিবিমা ও রক্তা খাঁ হিসেবে পূজিত হয়।

এই রক্তা খাঁ ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা ছিলেন বলে কথিত আছে। এই পাড়াটি রক্তা খাঁ পাড়া নামেই পরিচিত। তবে কলকাতায় ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় রক্তাল গাজি নামে এক লৌকিক দেবতা পূজিত হন, যাঁকে রক্ত আমাশার মতো পেটের রোগ থেকে পরিত্রাণের আশায় পুজো দেওয়া হয়। জয়নগরের এই বিবিমার প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় ব্যানার্জী পরিবার পাকাগৃহটি নির্মাণ করে দিয়েছে। তিনবার থান পরিক্রমা করে ভক্তগণ পুজো দেয়। ভক্তদের বিশ্বাস, তাদের আনা দুধ পূজারী বিবিমার কাছে উৎসর্গ করে দিলে সেই দুধ খেলে পেটের রোগ সেরে যায়। ভক্তগণ আস্ত নানান ফল মোয়া পাটালি বা বাতাসা ধূপ মোমবাতি পূজারীর হাতে তুলে দেয় বিবিমাকে উৎসর্গ করার জন্য। পুজো শেষে ভক্তগণ তাদের সঙ্গে আনা মুড়ি তরকারি ইত্যাদি দিয়ে আশেপাশে মাঠে বা চাতালে বসে বনভোজনের প্রথা সারে। প্রথা অনুযায়ী, চাঁদ দেখার আগে বাড়িতে প্রবেশ করা যায় না।

এই ধর্মবিশ্বাসের নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণটি এরকম — বনভোজনের মতো প্রথা, চাঁদ না দেখে বাড়ি ফেরায় নিষেধ বা মাঙ্গন, যা আদিম শিকার ও সংগ্রহ প্রথার অবশেষ, তা দেখিয়ে দিচ্ছে — এটি আদিম, বনবাসী, শিকার ও সংগ্রহজীবী মানুষের পুজো ও প্রথা। তারা হিন্দু ধর্মের নিচুতলায় তথাকথিত নিম্নবর্ণ হিসেবে অর্ন্তভুক্ত হয় এবং উচ্চবর্ণের অবহেলা অত্যাচারে মুসলিম রাজত্বকালে তাদের দেবদেবীর নাম পরিবর্তন করে মুসলিম বিবিমা, গাজি পীর ইত্যাদি নাম দেয়। গত ৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার মাঘী পূর্ণিমার দিন এই থানে শত শত মহিলা পুজো দেয় এবং এই উপলক্ষ্যে তেলেভাজা ইত্যাদির কিছু দোকান বসেছিল।