সুনামি হলে কুডানকুলাম হয়ে উঠবে ফুকুশিমা। এই আশঙ্কার সমর্থন পাওয়া গেছে ‘দ্য স্টেটসম্যান’ দৈনিক সংবাদপত্রের ১২ এপ্রিলের সম্পাদকীয়তে। শ্রীলংকা ও ভারত, দুটি আলাদা দেশ হলেও একফালি সমুদ্রের তফাতে দুটি বাসভূমি। তামিলনাড়ুর তিরুনেলভেলি জেলার কুডানকুলাম থেকে শ্রীলংকার মানার-এর দূরত্ব ২৫০ কিমি। আগামী কয়েকমাসের মধ্যে কুডানকুলামে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম চুল্লি চালু করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে ভারত সরকার। প্রতিবেশী দ্বীপভূমি শ্রীলংকা এই উদ্যোগে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষত রাশিয়ার চের্নোবিল ও জাপানের ফুকুশিমার ভয়াবহ দুর্ঘটনার ভয় তাদের বিচলিত করেছে।
অথচ তামিলনাড়ুর বড়ো মিডিয়া এর মধ্যে প্রতিশোধের গন্ধ পাচ্ছে। তারা বলছে, রাষ্ট্রসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শ্রীলংকার তামিল নিধন নিয়ে যে প্রস্তাব এনেছে এবং যা ভারত সরকারের সমর্থন পেয়েছে, তার প্রতিশোধ নিতেই ব্যাগড়া দিতে চাইছে শ্রীলংকার সরকার।
এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ সত্য নয়। ১৯৯৪ সালেই শ্রীলংকা জানিয়েছিল, কুডানকুলামে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে তার খারাপ প্রভাব পড়বে মানার উপসাগরের সামুদ্রিক জীবনে এবং কলম্বো থেকে দ্বীপের উত্তরে যে উপকূলবর্তী জাহাজ চলাচল করে তার ওপর। ২০০৫ সালে এক জনস্বার্থ মামলায় ভারতের ‘ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি’ যে জবাব (এফিডেভিট) পেশ করে বোম্বে হাইকোর্টে, তাতে মেনে নেওয়া হয়েছিল যে থানের খাঁড়িতে মাছ ও সামুদ্রিক জীবের শরীরে তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া গেছে। গত চার দশক যাবৎ মুম্বইয়ে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার ওই খাঁড়িতে পরমাণু বর্জ্য নিক্ষেপ করে চলেছে। কিন্তু এই তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ কতখানি তা জানানো হয়নি। ‘এটা জনস্বার্থের ব্যাপার নয়’ বলে এফিডেভিটে বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়, ভাবার পরমাণু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি মামলার আবেদনকারীরা কথা বলুক। কিন্তু ভাবার কর্তারা কথা বলতে চায়নি। প্রসঙ্গত, মানার উপসাগরের দুই কূলেই জনসমাজ মৎস্যজীবী। তাই কুডানকুলাম নিয়ে আপত্তি উঠেছে দুই পারেই।
কুডানকুলামে যে রাশিয়ান চুল্লি বসানো হচ্ছে, তার প্রযুক্তি সম্বন্ধে ভারতের কোনো পরমাণু বিজ্ঞানী ওয়াকিবহাল নয়। ভারতের সমস্ত চুল্লিই কানাডার নকশার (প্রেশারাইজড হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টর)। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এব্যাপারে তাঁরা রুশ বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভর করে আছেন। কিন্তু চুল্লি সরবরাহ করেছে রাশিয়ার সরকার ও কোম্পানি। যে মাল বেচে সে কখনও মালের গণ্ডগোল নিয়ে কথা বলতে চায় না। তাহলে সেই মাল লোকে কিনবে কেন? আমরা কুডানকুলামের চুল্লির নিরাপত্তা নিয়ে এখনও কোনো স্বাধীন বিশেষজ্ঞ-মতামত পাইনি।
১৯৮৬ সালের চের্নোবিল দুর্ঘটনায় মানুষের ভুল ছিল। ২০১১-র ফুকুশিমায় ভূমিকম্প, সুনামি এবং মানুষের ভুল মিলে বিপদ ডেকে এনেছিল। ১৯৯৬ সালেই অ্যাটমি এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এ গোপালকৃষ্ণন একটি রিপোর্টে জানিয়েছিলেন, আমাদের পরমাণু-প্রতিষ্ঠানগুলিতে ১৩০টি নিরাপত্তা-ত্রুটি ঘটেছে, তার মধ্যে ৯০টি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে।
গত বুধবার ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার কাছে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটে গেল, তা সুনামির দিকে যায়নি বটে। কিন্তু যদি যেত, তাহলে কী ঘটত দক্ষিণ ভারতের পরমাণু কেন্দ্রগুলোতে? আমরা কলকাতায় কোন কোন বাড়ি থেকে নিচে নেমে এসেছি, তাই নিয়ে হইচই করছি। কলকাতার পাতাল রেল বন্ধ করে দিচ্ছি। কেন? যে কারণে তা করছি, সেই কারণেই পরমাণু কেন্দ্রগুলোতে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। তারপরেও আমরা কুডানকুলামের চুল্লি চালু করার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠব?
জিতেন নন্দী, কলকাতা, ১৩ এপ্রিল
Leave a Reply