চূর্ণী ভৌমিক, ১৫ ডিসেম্বর#
রোববার, ৯ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যে ৮টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত রেনবো কার্নিভাল বা রামধনু উৎসবে আমি পৌঁছেছি দুপুর দুটো নাগাদ। ‘স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি’ নামক প্ল্যাটফর্মটি বিভিন্ন প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু যৌন গোষ্ঠীর অধিকারের দাবীতে লড়াই করছে তা জানতাম। তাদেরই আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি নানাধরণের মানুষের ভীড়। সমকামী, উভকামী ও ট্রান্সজেন্ডার গোষ্ঠীর সদস্যদের পাশাপাশি সমস্ত রকম অসাম্যের বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদ করতে চান তাঁরাও দল বেঁধে হাজির সেখানে।
এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে এই উৎসবের খবর পেয়ে রবীন্দ্রসদনে নাট্যমেলার ভীড় কাটিয়ে পৌঁছাই আমি। রামধনুর বিচিত্র রঙের মতোই বিভিন্ন ধরণের মানুষের সাথে আলাপ হয়, যাদের কথা আমি এতদিন প্রায় জেনেও জানতাম না । এমন অনেক মানুষের সাথে সরাসরি কথা বলবার ও আলাপ করবার সুযোগ পেয়ে গেলাম, যাদের এতদিন ধরে দূর থেকে দেখেছি কিন্তু কথা বলবার সাহস বা সুযোগ কোনটাই হয়নি। আমি ট্রান্সজেন্ডার গোষ্ঠীর লোকেদের কথা বিশেষভাবে বলব। কারণ ব্যক্তিগত সুত্রে সমকামী মানুষদের বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলাম আমি কখনও সখনও, কিন্তু যাঁরা এই ২১ বছর ধরে আমার জগতের সম্পূর্ণ বাইরে রয়ে গেছেন তাঁরা এই ট্রান্সজেন্ডার গোষ্ঠীর মানুষ। অদ্ভুত আনন্দ লাগে যখন সবাই মিলে শত বৈপরীত্য সত্ত্বেও একসাথে ‘সাত্তে পে সাত্তা’ বা ‘হাউসি’ খেলেন। কয়েক ঘন্টার জন্য চোখের সামনে ফুটে উঠছিল এক আশ্চর্য পৃথিবী, যার স্বপ্ন দেখলেও বাস্তব রূপটা দেখতে পাইনি কখনও।
আমার সংখ্যালঘু যৌনগোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে যে সচেতনতা এতদিন ছিল বলে ভাবতাম তার সম্পূর্ণ উপলব্ধি কখনও হয়নি এর আগে। নেহাতই কাগজে কলমে থাকা সেই সচেতনতায় যে স্বাভাবিক আন্তরিক উচ্ছ্বাসের অভাব ছিল, তা টের পাইনি এতদিন। আর এত ভালো লাগার অন্য আর একটা কারণ বোধহয় আমার সমবয়স্ক ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি। খুবই স্বস্তি বোধ করছিলাম তাঁদের সকলের মধ্যে। তবে কমবয়সী ছেলেমেয়ের পাশাপাশি মাঝবয়সী এমনকি বৃদ্ধ- বৃদ্ধারাও ছিলেন।
বিকেল বেলা অফ স্টেজ ইভেন্ট শেষ হয়ে শুরু হল সান্ধ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দর্শকদের ভীড় বাড়তে থাকল ক্রমশ। ফ্যাশন শোর সময় হঠাৎ ঢুকে পড়া দর্শকদের ভীড়ে বিরক্তিকর বা অস্বস্তিকর মন্তব্য দুএকটা যে কানে ভেসে আসেনি তা নয়, তবে দুপুর থেকে মন মেজাজ এত ভালো ছিল যে তা নিয়ে বেশী ঘ্যানঘেনে দুঃখ করার অবকাশটুকুই পাইনি। সন্ধ্যে ৮টা নাগাদ একটা মজার নাটক দিয়ে শেষ হল অনুষ্ঠান। কেউ বা তেঁতুলজল কেউ বা পীঠের রস মেখে শালপাতারা পড়ে থাকল, আর গায়ে চাদরটা একটু বেশী করে টেনে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালাম।
এইরকম উৎসব আরো হলে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বা রবীন্দ্রসদনের মত জায়গায় শুধু নয়, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে তবেই আমাদের সামাজিক ভাবে চাপিয়ে দেওয়া মনের বাধা বিপত্তিগুলো কেটে যাবে আপনাআপনি নিজস্ব নিয়মেই। পরেরবার মনে করে ক্যামেরা নিয়ে যাব। এই ছবিটা আমায় জোগার করে দিয়েছে তনয়া ভট্টাচার্য তার কোন এক বন্ধুর কাছ থেকে নিয়ে।
Leave a Reply