- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

গাজাকে বছরের পর বছর ধরে অবরুদ্ধ করে রেখে যুদ্ধ তো জারি রেখেছে ইজরায়েল, তা না উঠিয়ে কিসের শান্তি আলোচনা, প্রশ্ন হামাসের

শমীক সরকার, কলকাতা, ৩১ জুলাই#

গাজায় গণকবর খোঁড়া হচ্ছে দ্রুত হাতে। টুটারে 'গাজা ইউথ ব্রেক আউট'-এর সূত্রে পাওয়া ছবি। ২৭ জুলাই।
গাজায় খোলা জায়গায় গণকবর খোঁড়া হচ্ছে দ্রুত হাতে। টুটারে ‘গাজা ইউথ ব্রেক আউট’-এর সূত্রে পাওয়া ছবি। ২৭ জুলাই।

গাজার ঘরে ঘরে আকাশপথে ক্ষেপণাস্ত্র ফেলছে ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স, সাথে স্থলপথে ট্যাঙ্ক হানা; মৃত পনেরোশো গাজাবাসী, তার মধ্যে সাড়ে বারোশো অসামরিক মানুষ — তিনশোর বেশি শিশু, দেড়শো মহিলা, পঞ্চাশ বয়স্ক; ষোলো লক্ষ মোট জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় আড়াই লক্ষ গাজাবাসী উদ্বাস্তু হয়েছে; ছাপ্পান্ন জন ইজরায়েলি সেনা ও তিনজন অসামরিক ইজরায়েলির মৃত্যু গাজার প্রতিরোধে

৮ জুলাই ভোরবেলা ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্স গাজার ওপর আকাশপথে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র হানা চালিয়ে সতেরো জনকে মেরে ফেলার মধ্যে দিয়ে এবারের মতো গাজা আগ্রাসন শুরু করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন প্রটেকটিভ এজ’। ইজরায়েল রাষ্ট্রপ্রধান বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন, ‘হাত খুলে মারো’। এই যুদ্ধে ইজরায়েলের ঘোষিত লক্ষ্য গাজা থেকে ইজরায়েলের ওপর রকেট হামলা ও সুরঙ্গপথে হামলা চিরতরে শেষ হয়। এখনও চলতে থাকা ইজরায়েলের এই আগ্রাসনে ব্যবহার হচ্ছে আকাশপথে বোমা হামলা, স্থলপথে ট্যাঙ্ক নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে গাজার মধ্যে ঢুকে হামলা, সমুদ্রপথে রকেট হামলা। ১৭ জুলাই গাজায় ট্যাঙ্ক নিয়ে ঢুকে পড়ে স্থলপথে হামলা চালাতে শুরু করে ইজরায়েল।
একতরফা ‘যুদ্ধ’
একদিকে ইজরায়েল, অন্যদিকে গাজায় শাসকদল হামাস এবং অন্যান্য কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন এই যুদ্ধে সামিল। ২০০৮-০৯ এবং ২০১২ সালে দু’বার এই যুদ্ধ হয়েছে, তারপর যুদ্ধবিরতি হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারেও যুদ্ধে হামাসদের সম্বল ইজরায়েলের ওপর বাড়িতে বানানো রকেট নিয়ে হামলা, যেগুলির বেশিরভাগই পড়ে দক্ষিণ ইজরায়েলের নেগেভের ফাঁকা মাঠে, কিছু গাজার মধ্যেই ফেটে যায়। যে কয়টা তেল আভিভ প্রভৃতি শহরে গিয়ে পড়ছে, তার অনেকগুলিই আটকাছে ইজরায়েলের ণ্ণআয়রণ ডোম’ সুরক্ষা বলয়ের রকেট-প্রতিরোধক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি। বাকিগুলি থেকে বাঁচার জন্য আগে থেকে সাইরেন বাজানোর ব্যবস্থা ও বাঙ্কার আছে ইজরায়েলের। এখনও পর্যন্ত এবারে প্রায় আড়াই হাজার রকেট হামলায় প্রাণ গেছে মাত্র তিনজন ইজরায়েলির। স্থলপথে হামলা চালাতে গিয়ে প্রতিরোধে প্রাণ হারিয়েছে জনা পঞ্চাশেক ইজরায়েলি সৈন্য।
অন্যদিকে সমুদ্রতীরে বেশ কিছু গিজগিজে শহর ও জনপদ নিয়ে গঠিত গাজার ওপর ইজরায়েলের জল-স্থল-অন্তরীক্ষ হামলায় নিহত হয়েছে প্রায় পনেরোশো গাজাবাসী। যাদের মধ্যে নব্বই শতাংশই অসামরিক মানুষ। এক তৃতীয়াংশ শিশু-মহিলা-বয়স্ক। আহত হাজার দশেক। মূলত আকাশপথে, এবং সামান্য কিছু জলপথে ও স্থলপথে, প্রায় হাজার পাঁচেক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হাসপাতাল, রাষ্ট্রপুঞ্জের স্কুল, আশ্রয় স্থল, মসজিদ, বাজার, সমুদ্র সৈকত — কোনো কিছু বাদ যায়নি ক্ষেপণাস্ত্র হানা থেকে।
একতরফা প্রচার যুদ্ধ
ইজরায়েলি মিডিয়া এবং সেখানকার সূত্রে মার্কিন ও ইউরোপিয়ান মিডিয়া প্রচার করছে, ইজরায়েল গাজায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আগে সেখানে আকাশপথে লিফলেট ছড়িয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে বাসিন্দাদের চলে যেতে বলছে। হামাস বারণ করছে। ইজরায়েল থেকে ফোন করা হচ্ছে, মোবাইলে মেসেজ করা হচ্ছে আরবিতে– পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাড়ি খালি করো, বোমা পড়বে। গাজার দক্ষিণ পূর্বে খান ইউনিস এলাকায় এরকমই একটি ফোন আসার পর বাসিন্দারা বাড়ি খালি করে। তারপর ক্ষেপণাস্ত্র পড়ে। তারপর সব থেমে গেলে বাসিন্দারা বাড়ি ফিরতেই ফের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়, সাত জন বাসিন্দা মারা যায়, পঁচিশ জন আহত হয়। এভাবেই ইজরায়েলের তরফে প্রচার করা হচ্ছে, তারা বাড়ি-পাড়া-শহর খালি করতে বলে তবে আক্রমণ করছে।
ইজরায়েলি মিডিয়া খুব বড়ো করে প্রচার করছে কতগুলো রকেট গাজা থেকে ইজরায়েলের মাটিতে পড়েছে। তার অভিঘাতে কত মানুষ ভীত, বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছে। গাজা-ইজরায়েল সীমান্তে কত হাজার ণ্ণমৃত্যু সুরঙ্গ’ খোঁড়া হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে কত ইজরায়েলি পালিয়ে এসেছে। উল্লেখ্য, এসব প্রচারে হামাসও খুব খুশি হয়। গাজায় যে গণহত্যা চালাচ্ছে ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স, তার উল্লেখ থাকলেও তার কারণ হিসেবে হামাসের বাড়বাড়ন্তকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। ব্যতিক্রম ণ্ণহারেৎজ্‌’ সহ কিছু বামপন্থী পত্র পত্রিকা, কিছু সেগুলোর সম্মিলিত পাঠকসংখ্যা মোটের দশ শতাংশ-ও নয়। মিডিয়ার জনসমীক্ষা জানাচ্ছে, প্রায় পুরো ইজরায়েল চায়, যুদ্ধ চালাক ইজরায়েল। তবে কিছু যুদ্ধবিরোধী মিছিলও হয়েছে — রাজধানী তেল আভিভের এরকম একটি র‍্যালিতে ২৬ জুলাই সামিল হয়েছিল হাজার পাঁচেক লোক।
একতরফা যুদ্ধবিরতি
১৫ জুলাই মিশর এবং ইজরায়েল একটি যুদ্ধবিরতি শর্ত হাজির করে, যা হামাস খারিজ করে দেয় এই বলে যে গাজার ওপর ইজরায়েলি অবরোধ উঠে যাওয়ার শর্ত না থাকলে যুদ্ধবিরতি অর্থহীন। পাল্টা হিসেবে ১৬ জুলাই হামাস ও প্যালেস্তাইনি ইসলামিক জিহাদ মিলিতভাবে দশ বছরের জন্য বলবত থাকার মতো একটি দশদফা যুদ্ধবিরতি শর্ত দেয়, যার মধ্যে রয়েছে, গাজা সীমান্ত থেকে ইজরায়েলি ট্যাঙ্কের অপসারণ, ইজরায়েল-গাজা সীমান্তে রাষ্ট্রপুঞ্জের নজরদারি ও গাজা-মিশর সীমান্তে ইজরায়েলি অবরোধ হটানো, সাম্প্রতিক কালে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে গ্রেফতার হওয়া প্যালেস্তাইনিদের মুক্তি, গাজা সংলগ্ন ভূ-মধ্যসাগরে অন্তত ১৩ কিমি পর্যন্ত গাজার মৎস্যজীবীদের মাছ ধরতে দেওয়া, রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে গাজায় একটি বিমানবন্দর নির্মাণ প্রভৃতি। ইজরায়েল এই শর্ত প্রত্যাখ্যান করে।
জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ইজরায়েল, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (২২ জুলাই) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (২৮ জুলাই) দাবি জানাতে শুরু করে, তারা চায় গাজা ফালি-কে সম্পূর্ণভাবে অস্ত্রমুক্ত করে তবে যুদ্ধবিরতি হোক। হামাস জানিয়ে দেয়, যারা তাদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার কথা বলবে, তারাই মরবে। ২৭ জুলাই হামাস আরো জানায়, গাজা থেকে ইজরায়েলি স্থলবাহিনী না হটে যাওয়া পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি হবে না। তবে রাষ্ট্রপুঞ্জের মধ্যস্থতায় মাঝেমধ্যেই কয়েক ঘন্টার জন্য যুদ্ধবিরতিতে সামিল হচ্ছে দুই পক্ষই।
সুজাইয়া ধ্বংস
২০ জুলাই উত্তর গাজার সুজাইয়া শহরে একটি ইজরায়েলি ট্যাঙ্কে গাজার ট্যাঙ্ক-বিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে এবং ট্যাঙ্কে থাকা সাতজন ইজরায়েলি সেনা মারা যায়। এর প্রত্যুত্তরে ওইদিন সারাদিন ধরে আকাশ-হামলা ও স্থল হামলা চালায় ইজরায়েলি বাহিনী। আকাশ পথে ৬০০ বার গোলাবর্ষণ করা হয় একদিনে। বোমা ফেলা হয় একশো টন। শহরের প্রচুর বসতবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। মোট ৬৫ জন শহরবাসী মারা যায় হাসপাতালে, যাদের মধ্যে ১৭ জন শিশু ও ১৪ জন মহিলা। তিনশো জন গুরুতর আহত হয়। কিন্তু ধ্বংসস্তুপের তলায় কতজন যে মরে পরে আছে, তার হিসেব অজানা।
টার্গেট হাসপাতাল, স্কুল, বসতবাড়ি
ইজরায়েলির হামলার টার্গেট হচ্ছে একের পর এক হাসপাতাল আর রাষ্ট্রপুঞ্জের স্কুল — যেগুলো আহতদের চিকিৎসার ক্ষেত্র এবং উদ্বাস্তুদের বসবাসের জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বেত হাইনুনের ৮০০ শরণার্থীর আশ্রয় নেওয়া একটা স্কুলে ২৪ জুলাই ইজরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হানায় ১১ জন মারা গেছে যাদের মধ্যে ৭ জন বাচ্চা আর ২ জন মহিলা। ১১০ জন আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৫ জন বাচ্চা ও ৩১ জন মহিলা। খুজা গ্রাম থেকে পালিয়ে ইজরায়েলি কামানের গোলা থেকে বাঁচতে খান ইউনিস শহরে একটি দোতলা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল সমীর আল-নজ্জর-এর পরিবার। ২৬ জুলাই ওই বাড়িতে ইজরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হানায় ২১ জন শরণার্থী মারা যায়, যাদের মধ্যে ১১ জন শিশু ও ৫ জন মহিলা। ২১ জুলাই আল আকসা হাসপাতালে ক্ষেপণাস্ত্র হানায় অন্তত পাঁচজন মারা যায়।
ইজরায়েলের দাবি, এইসব স্কুল, বাড়ি ও হাসপাতালে হামাসের রকেট লঞ্চার সরঞ্জাম ও বন্দোবস্ত ছিল। সেগুলো ধ্বংস করতেই হামলা। ইজরায়েল, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও আমেরিকা বরাবরই দাবি করছে, হামাস জনবসতিকে ব্যবহার করছে — যুদ্ধ চালাচ্ছে সেখান থেকেই, তাই তারা গাজার জনগণকে বলছে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে, তানাহলে ক্ষপণাস্ত্র হানায় মরতে হবে। অপরপক্ষে হামাসের দাবি, ইজরায়েলের মূল লক্ষ্য গাজার দখল নেওয়া, প্রয়োজনে প্যালেস্তাইনিদের মেরে ভাগিয়ে দিয়ে।
যাই হোক, গাজায় মৃত ও আহতদের নব্বই শতাংশ অসামরিক ব্যক্তিত্ব। রক্তাক্ত গাজায় যুদ্ধ এখন ঘরের মধ্যে সেঁধিয়েছে।