বিকর্ণ,৭ই জানুয়ারী,২০১৫#
নতুন বছরের প্রথম রবিবারে ৪ঠা জানুয়ারী ছিল কোচবিহার আনন্দম্ কালচারাল সেন্টারের ৩৪’তম বর্ষপুর্তি উৎসব। অনুষ্ঠান শুরু হল চার্লি চ্যাপলিনের ১২৫ ত জন্মবার্ষিকীর স্মরণে চ্যাপলিন অভিনীত –‘সার্কাস’। সন্ধ্যেবেলায় সন্মানজ্ঞাপন করা হল রবীন্দ্রভবনের সামনের চা বিক্রেতা মণিশঙ্কর দেবনাথ, বাদাম বিক্রেতা নিরঞ্জন দে, রবীন্দ্রভবনের অস্থায়ী কর্মী বাবলু সরকার, অরুন সরকার, নৃপেন রায় আর দেবজ্যোতি দাসকে। তারপর মূল অনুষ্ঠানে ছিল সুকন্যা দত্তগুপ্তের নির্দেশনায় বাল্মিকী প্রতিভা, শ্রীশংকর দত্তগুপ্তের নির্দেশনায় ‘পিটার দি গ্রেট’ এবং ‘আজও নিরুপমা’। ৬ জানুয়ারী সন্ধ্যায় শ্রীশংকর দত্তগুপ্তের সাথে এই আনন্দম্ নিয়ে কথাবার্তা বলতে গিয়েছিলাম।
আজকের এই আনন্দম্ কালচারাল সেন্টার ৩৫ বছর আগে কিভাবে শুরু হয়েছিল?
- কোচবিহার পলিটেকনিকে পড়ার সময়ে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের (নান্দিকারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা) সংস্পর্শে এসে নাটক ও যাত্রায় নিয়মিত অভিনয় শুরু করি, পরে ১৯৭৮ সালে যোগেশ মাইম একাডেমীতে যোগদান করি আর সেই বছর থেকেই মুখাভিনেতা হিসেবে অভিনয় শুরু করি। আর আশেপাশের কিছু বাচ্চাদের নিয়ে এই আনন্দম্ শুরু করি ১৯৮০’র ১৫ই আগষ্ট। ১৯৮০তেই সুইডেনের ব্রেক মাইম থিয়েটার থেকে স্কলারশিপের জন্যে ডাক পাই, কিন্তু সে বছরই আমার মাতৃবিয়োগ হয় আর বাবাকে একা রেখে আর যেতে পারিনি।
তুমি তো সারা ভারতে ঘুরেছ আনন্দমের টীম নিয়ে…
- আমরা হায়দ্রাবাদে গেলাম ১৯৮৫ তে সেখানে কোলকাতা থেকে গিয়েছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন,তারাপদ রায়, কুমারেশ ঘোষ এই সাহিত্যিকেরা বিশ্ব হাস্য সন্মেলনে যোগ দিতে এবং শিল্পী হিসেবে গিয়েছিলাম আমি আর পদ্মশ্রী নিরঞ্জন গোস্বামী। তো ওই যে গেলাম হায়দ্রাবাদে সেখানে মজা হল কি- আমার একটা অদ্ভুত Feeling হল যে ওইরকম একটা পরিসরে যেখানে Times এর সাংবাদিক বসে আছে, BBC’র সাংবাদিক বসে আছে সেখানে আমি কোচবিহারের একটা ছেলে আমার বন্ধুদের আমি স্টেজের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। এবং তখন opening ceremony যেটা হয়েছিল তাতে আমার আর নিরঞ্জনদার একটা মাইম দিয়েই অনুষ্ঠানের শুভ সুচনা হয়েছিল। তারপর সান্ধ্যকালীন performance । সকালবেলার performance এ আমি হাসাব কি? আমার তো ছোটবেলার বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে এবং ওখান থেকে যে বাঙালিরা তারা ছুটে এলেন বললেন ‘আপনি এরকম করছেন কেন?’ আমি বললাম ‘দেখুন সত্যিকথা আমি তো কোলকাতার নই আমি কোচবিহারের ছেলে’ তা উনি বললেন ‘আমরা কোথা থেকে এসেছি? আমরা কেউ বাংলাদেশ থেকে, কেউ আরও ছোট কোনও জায়গা থেকে, আপনি নির্ভয়ে করুন আমরা আছি’ ওই শুরু হল ৮৫’তে যে, না আমাকে কোচবিহারেই ফিরে আসতে হবে এটা দৃঢ় হয়ে গেল। এই ৮৫’ onwards প্রতিবছর নাট্যোৎসব করা নাটকের কর্মশালা টুকটাক শুরু হয়ে গেল। এবারে ১৯৯৩ তে National School of Drama প্রথম এখানে আমাকে একটা সুযোগ দেয় ছোটদের নিয়ে workshop করার। সেবার সিদ্ধার্থ চক্রবর্ত্তী, NSD pass out, ওর নেতৃত্বে workshop টা হয় নেতাজী সংঘে। পরের বছর সিদ্ধার্থকে নিয়ে আসি আর সঙ্গে আর এক NSDian পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সেবার আমরা একটা নাটক তুলি, সেই নাটকটা আমাদের দিল্লীতে perform করার কথা ছিল। সব প্রস্তুতি শেষ, টিকেট কাটা complete, কিন্তু সেবার দিল্লীতে প্লেগের উৎপাত। তখন আমি আর ঝুঁকি নিইনি বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়ার। সব reservation cancel করে দিই। এরপর থেকে চলছে – এখনও চলছে।
তুমি যাদের নিয়ে কাজ করছ তারা তো তথাকথিত ভাবে পিছিয়ে পড়া ঘর থেকে আসা?
- আমি মূলত যোগেশ দত্তের ছাত্র। যোগেশদা আমার কাছ থেকে কোনও সন্মানদক্ষিণা নিতেন না। তাই আমিও ঠিক করি যে আমি কোচবিহারে তাদের নিয়েই কাজ করব যাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই।
দীপক চক্রবর্ত্তীর সাথে কোথায় আলাপ?
- ঐ যে বললাম ৮০ তে গিয়েছিলাম খাগড়াবাড়িতে সেখানে এই দীপক চক্রবর্ত্তীর সাথে আমার পরিচয় হয়। দীপকই আমার দলে এখন senior most, ছোটদের নিয়ে কাজ করলেও দীপক আমার সঙ্গে থাকে।
দীপকবাবুর কি জন্ম থেকেই সমস্যা?
- হ্যাঁ দীপক জন্ম থেকে মূক ও বধির, ওর জন্ম ১৯৬১ সালে, কিন্তু ওর সঠিক জন্মতারিখ ওর বাড়ির লোক দিতে পারে না। প্রথমে তো বোঝা যায়নি, জন্মের দু’বছরের মধ্যেই ধরা পরে দীপক মূক ও বধির। সেই সময়ে এখানে(কোচবিহারে) মূক ও বধিরদের স্কুল বা বিশেষ ধরনের কোনও শিক্ষাব্যবস্থা না থাকায় বাড়িতেই সামান্য অক্ষর পরিচয় হয়। ১৯৭৭ সালে জেনকিন্স স্কুলের তৎকালীন শিক্ষক শ্রী রমেন্দ্রকুমার কুন্ডু মহাশয়ের ‘চিত্রভানু’ তে আঁকায় বিশেষ প্রশিক্ষন নিয়েছিল, সামান্য কিছুদিন ‘মায়াচিত্রম’-এ আঁকা শিখেছিল একটা ছোট প্রদর্শণীও হয়েছিল তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের সামনের মাঠে। তারপর আট থেকে পনের বছর বয়েসের মধ্যে মা ও বাবা দুজনকেই হারায় দীপক। আমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমাদের সাথেই আছে, আমার কাছেই মাইম শিখেছে। আমার সাথে কোলকাতা শিশির মঞ্চ তারপর দিল্লীতেও অভিনয় করেছে।
তোমাদের এখন সদস্যসংখ্যা কত?
- এখন আমার total team টা দাঁড়িয়ে আছে ৪০ জনের। পেছনে সব দাঁড়িয়ে পড়ে বড়রা, পরবর্তীতে আরোও develop করবে team টা। পরবর্তীতে registration এর খাতিরেই আনন্দম্ নামটা উঠে গিয়ে হয় আনন্দম্ কালচারাল সেন্টার এবং পরবর্তীতে এই আনন্দম্ কালচারাল সেন্টারের যারা কর্মকর্তারা ছিলেন তাঁরা কয়েকজন প্রয়াত হন, তার মধ্যে একজন আমার নিজের জামাইবাবু, তারপর আমাদের বিপ্লব রুদ্র recently মারা যান। তখন আমরা চিন্তা করি নতুন করে আবার registration করার। ২০১৩’র ১৩ই ডিসেম্বর থেকে আমরা কোচবিহার আনন্দম্ কালচারাল সেন্টার হলাম। এই হল আমাদের আনন্দম্।
এখন যারা কাজ করছে তাদের কোথা থেকে পেলে?
- আমাদের হচ্ছে কি প্রথমে শুরু হয়ছিল পাড়ার বাচ্চাদের নিয়ে, এবার ওরাই যখন ভালোলাগার কথাটা অন্যদের বলে – যেমন ঐ যে বাচ্চারা performance করল এখন অনেকেই ওদের সাথে যোগাযোগ রাখছে এবং আমরা workshop এ ওদেরকে নিয়ে আসি, workshop এ অদের সূচনাটা হয়। এই workshop হলে পরে কি হয় ৭ কি ৮ দিন, ওদের নিয়ে আমরা কাজ করি তারপর তারা আনন্দম্ এর মেম্বার হয়ে যায় এবং ধারাবাহিকভাবে কাজটা হওয়াতে বাচ্চারা আসতেই থাকে। যেমন তারা বলে যে মেয়েটি আছে ওকে দেখে আবার সোনামণি বলে মেয়েটি workshop এর পরে এসেছে। এইভাবে সারাবছর ধরে একটা স্রোত আসতে থাকে। গতবছর আমাদের workshop যেটা ছিল সুচন্দ্রা ভট্টাচার্য্যের একটা গল্প সিলেটের ব্রতকাহিনী নিয়ে। তীর্থঙ্কর এসেছিল জলপাইগুড়ি থেকে ও ক্লাস নিয়েছে, সব্যসাচী ক্লাস নিয়েছে। আর স্থানীয় অরূপ গুহ পরিবেশ নিয়ে ক্লাস নিয়েছে। বিমল দে সরকার আছে ও ছবি আঁকা ও এই যে হাতের কাজগুলো দেখিয়েছে। এই যে নাটকের উপকরন যা দেখলে সবই তিন্নি ( শঙ্করবাবুর মেয়ে সুকন্যা) এবং তার বাহিনীর হাতে তৈরী। যেমন সরস্বতির বীনা তৈরী হয়েছে রান্নার ডেকচি আর ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে, তারপর এভাবেই নানারকম ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে নানারকম উপকরন তৈরী হয়েছে, তাতে হয়তো অনেকটা খারাপ হয় কিন্তু নিজেদের হয়।
আর হ্যাঁ যা বলছিলাম আমাদের এখানে এখন যারা কাজ করছে রিয়া যেমন আছে ওর বাবা কাঠের কাজ করে, ঠাকুমা লোকের বাড়িতে কাজ করে, অর্কর বাবা নেই, শ্রীবাসের বাবা চানাচুর বিক্রি করেন, শুভজিতের বাবা বেসরকারি কর্মী, প্রিয়াঙ্কা হচ্ছে রিয়ার দিদি, রোহিত আলির বাবা গ্যারেজে কাজ করেন, রোহিতের সাথে এবারে আমরা ওর মাকেও নিয়ে এসেছি জোহরা বেগম। এই যে সায়ন্তন সেনগুপ্ত ২৮ বছরের যুবক কিন্তু mentally challenged তার মনের বয়েস ৫ বছর, তার চলন ফেরন ৪-৫ বছর বয়েসীদের মত কিন্তু আমাদের সঙ্গে আমাদের নাটকে কাজ করছে। আশুতোষ পাল পোষ্ট অফিসে কাজ করছে, ও আর অঙ্কন ৫ বছর বয়েসে আমাদের সাথে এসেছিল। আশুতোষ এখন সম্পাদক। মধুমিতা চক্রবর্ত্তী ছোটবেলায় এখানে এসেছিল পরবর্তীতে আশুতোষের সাথে তার বিয়েটাও হয়ে গিয়েছে। এখন আমরা পরিবারের মত হয়ে গিয়েছি। দীপা বর্মন বলে আমাদের গ্রুপে একটি মেয়ে আছে, যার জীবনটা বড় অদ্ভুত। যেহেতু ওর মা কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন তাই ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে ওনাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই মেয়েটা আমাদের গ্রুপে কাজ করছে, ওর মা হাতের কাজ করে শৌখিন জিনিসপত্র বানিয়ে বিক্রি করেন। দীপা কিন্তু প্রত্যেকবছর ক্লাসে ফার্স্ট হয়, এবছর নাইনে উঠল। এই যে বাচ্চাগুলো আছে তারা কিন্তু রেজাল্ট খুব ভালো করে। আমাদের এখানে শর্তই আছে ৬০% এর বেশী নম্বর পেতে হবে, ফেল করলে বাদ, ফলে এরাও জানে আমাকে রিহার্সাল করে গিয়ে পড়তে হবে। বিভিন্ন জায়গায় এরা perform করছে, সারা ভারতে program করেছে। এই তো কালকে কুশমন্ডি যাচ্ছি, এরপর জলপাইগুড়িতে তিনদিন ব্যাপী মূকাভিনয় উৎসব। সেখানে শেষদিন শেষ অনুষ্ঠান আমাদের।
এই ৩৪ বছরের অভিজ্ঞতা কিরকম?
- এই ৩৪ বছর পেড়িয়ে ৩৫ এ চলছি আমরা, অসংখ্য মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কোনওদিন বিপদে পড়তে হয়নি। আমাদের এখানে কোরিয়া থেকে ইংল্যান্ড থেকে শিল্পী এসে অসাধারন অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন। বিভিন্ন নামী দলগুলোকে নিয়ে এসেছি আমরা, কিন্তু এখন যেটা করছি আমাদের দলটাকে আরো সমৃদ্ধ করা। দেখবে তুমি আমরা কিন্তু অনেক কিছু করেছি পথনাটিকা,পুতুলনাটক, গীতিনাট্য, গীতিআলেখ্য, ছায়াপুতুল নাটক সবই এতকিছু বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করেছি। আরো অনেক কিছু করতে চাই , দেখা যাক।
Leave a Reply