জিতেন নন্দী, রবীন্দ্রনগর, মহেশতলা, ১১ জুলাই, ২০২০#
আমরা থাকি মেটিয়াবুরুজ আর মহেশতলার সীমানায়। আমাদের পাড়া রবীন্দ্রনগর মহেশতলা পুর এলাকার মধ্যে। উত্তর দিকে পাঁচ-সাত-দশ মিনিট হেঁটে গেলে মেটিয়াবুরুজ এলাকা। লকডাউনের মধ্যে মাস তিনেক আটকে থাকার পর মনে হল, অনেকদিন আশপাশের খবর পাই না। যাই একদিন দেখে আসি চেনা-পরিচিত মানুষজন কেমন আছে সব।
একদিন বিকেলে গেলাম শাহজাদা সুলতানের বাড়িতে। সাইকেলে চেপে কিলখানার গলিতে ঢুকেই দেখি জমজমাট পাড়া, দোকানপাট সব খোলা। লোকে দিব্যি ঘুরছে ফিরছে। ঈদগাহ্ ময়দানের পিছনে বস্তির একেবারে শেষে শাহজাদার ঘর। ওঁর ছেলে সিরাজ কাটিংয়ের কাজ করে। মেয়েদের টপ নিজে কেটে অন্য দর্জিকে দিয়ে সেলাই করে নেয়। চৌকির ওপর স্তূপ করা রেডিমেড মাল। সিরাজকে জিজ্ঞাসা করলাম, মাল এত পড়ে রয়েছে? ও বলল, ঈদের আগে সামান্য কিছু বিক্রিবাটা হয়েছে। তারপর দু-সপ্তাহ হল হাট খুলেছে বটে। কিন্তু কাস্টমার আসছে না। বাইরের কাস্টমার কীভাবে আসবে?
শাহজাদার সঙ্গে গেলাম কাচিসড়কে। সেখানেও জমজমাট সন্ধ্যার মেটিয়াবুরুজ। রাস্তায় আগের মতোই ভিড়। শাহি মহল রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন শাহিদ হুসেইন শাহিদ। ওঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের আলাপ। আমরা একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম তিনজনে। মেটিয়াবুরুজে করোনার প্রসঙ্গ এল। ওঁর কথাটা ছিল মোটামুটি এইরকম :
কাচিসড়কের কাছে পাহাড়পুর রোডের ওপর মৌলানা আজাদ মেয়েদের স্কুল। সামনে আলাউদ্দিন মাস্টার কোটিপতি মানুষ, বড়ো বিজনেস ম্যান। ওঁর ছেলের দিল্লিতে শ্বশুরবাড়ি। সে বউকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল। ফিরে এসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেল। পরে ওর বাবাও মারা গেল। ১৩৩, ১৩৪, ১৩৫ এই তিন ওয়ার্ডে দু-তিন মাসে প্রায় আড়াইশো মানুষ মারা গেছে। ওষুধ নেই, ডাক্তার নেই। নার্সিং হোম, ডাক্তারখানা সব বন্ধ ছিল। হাসপাতালগুলোও বদমায়েসি করেছে, যারা গেছে রোগি নিয়ে, ফিরিয়ে দিয়েছে। হার্টের পেশেন্ট, সুগার পেশেন্ট — বয়স্ক লোক বেশি, কিন্তু কমবয়সিরাও ছিল — সব রকম পেশেন্ট, বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। একমাত্র মেটিয়াবুরুজ হাসপাতালে কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু ওখানে করোনার চিকিৎসা হয় না। যারা পয়সাওয়ালা তারাই করোনায় মরেছে। আর গরিব লোকে মরেছে না খেয়ে কিংবা বিনা চিকিৎসায়। লকডাউন যদি করতেই হত, পাঁচদিন অন্তত সময় দেওয়া উচিত ছিল। যারা বাইরে গিয়েছিল, যে যার ঘরে ফিরে আসত। সবার আগে দিল্লি আক্রান্ত হয়েছে। সব জায়গার খবর জানি না। তবে শুনেছি হরিবাবুর বস্তিতে একজন করোনায় মারা গেছে। করোনার যেরকম গুজব ছিল মেটিয়াবুরুজ নিয়ে, সেরকম কিছু হয়নি এখানে।
শাহজাদার সঙ্গে আর একদিন গেলাম মিঠাতলাব, মারি রোডে শেখ বরজাহানের কারখানায়। শুনলাম, এখানে টেস্ট করার পর তিনজনের করোনা ধরা পড়েছিল। প্রথম কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। জ্বর যাচ্ছিল না। একজনের শ্বাসকষ্ট একটু হয়েছিল। ওরা একটু পয়সাওয়ালা লোক, ভয় কাজ করে। ওদের বাঙ্গুরে রেফার করেছিল। দুজন বাঙ্গুরেই টেস্ট করায়, পজিটিভ রিপোর্ট হয়। হাসপাতাল ওদের বলে যে আপনারা ভর্তি হয়ে যান। বাঙ্গুরে না হয়ে দুজন আমরিতে ভর্তি হয়, একজন ডিসানে। প্রায় চৌদ্দ-পনেরো দিন ছিল দুজন। আর একজনকে তিনদিনের মাথায় বলে যে আপনার জ্বর আসছে না, আপনি বাড়ি চলে যান, ডিসচার্জ করে দেয়। তিনজনই বেঁচে ছিল। একজনের বয়স পঁয়ষট্টি, একজনের ষাটের আশেপাশে, আর একজনের পঁয়ত্রিশ হবে। ফিরে এসে ওরা নিজেরাই কোয়ারান্টাইন ছিল বাড়িতে। পয়সাওয়ালা, ওদের আলাদা রুম আলাদা বাথরুম আছে। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, ওই তিনটে মানুষ, যেহেতু তাদের যৌথ পরিবার, সেই পরিবারগুলো ওদের সঙ্গে দশ-বারোদিন কাটিয়েছে। একই পরিবারে কারও হয়তো পনেরোজন, কারও বারোজন সদস্য আছে। কিন্তু মিঠাতলাব বস্তি এলাকায় কারো সেরকম কিছু হয়নি।
এছাড়া ফোনে কথা বলেছি কয়েকজনের সঙ্গে। কাঞ্চনতলা-বদরতলায় জ্যোতিপ্রকাশ সরদারের সঙ্গে কথা বললাম। বদরতলার বাসিন্দা মেটিয়াবুরুজের নামজাদা ওস্তাগর এস টি আলির স্ত্রী মারা গেছেন করোনায়। ষাটের কাছাকাছি বয়সি মহিলাকে বড়ো কোনো বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। জ্যোতিপ্রকাশদার বক্তব্য : বদরতলায় মুসলমানদের করোনা হলেও হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে না, টেস্টও হচ্ছে না। বেশিরভাগ বয়স্করাই মারা যাচ্ছে। মারা গেলে স্থানীয় ডাক্তারের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে কবর দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মৌলবিরা নাকি মসজিদে বলে দিয়েছে, আমরা নামাজ পড়ি, আল্লার নাম নিই, নিয়ম মেনে চলি, আমাদের করোনা হবে না। আমরা যেরকম তন্ত্র-মন্ত্র করি, এদের মধ্যেও তাই। হিন্দুদের মধ্যে একজন পিয়ারলেসে গিয়ে নিজে থেকে ভর্তি হয়েছিল। সে ইলেক্ট্রিক সাপ্লাইয়ে কাজ করে। ওর টেস্টে নেগেটিভ বেরোয়। আর তো সেরকম শুনতে পাইনি।
মুদিয়ালির যুবক সৌমেন তিওয়ারির একই বক্তব্য। মুসলমানরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে চেপে যাচ্ছে। এ নিয়ে আমি ফোনে মুদিয়ালির প্রবীণ চিকিৎসক পান্নালাল পালের সঙ্গে কথা বললাম। মেটিয়াবুরুজে দীর্ঘকাল তিনি চিকিৎসা করছেন, বিশেষত মুসলমান মহিলাদের। তিনিও শাহিদ হুসেইনের বক্তব্য সমর্থন করলেন যে, পাহাড়পুর রোডে হরিবাবুর বস্তিতে একজন মারা গেছে করোনায়। আরও দু-একজন আক্রান্ত হয়েছে। ‘মুসলমানদের এত হচ্ছে’ বলে যে কথাটা চারদিকে রটছে তার সত্যতা তিনি জানেন না।
এই রটনা কিংবা ঘটনার প্রভাব আমাদের পাড়াতেও রয়েছে। খোলা চোখে যেটুকু দেখেছি : ষাটোর্ধ একজন স্বচ্ছল হিন্দু অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর শোনা গেল তাঁর করোনা পজিটিভ। তিনি মারাও গেলেন। আমাদের পাড়ার কাছেই খালপাড়ে সাতঘরায় এক মুসলমান যুবতী ন্যাশনাল মেডিকালে বাচ্চা বিয়োনোর পর জানা গেল সেও করোনা আক্রান্ত। সেও মারা গেছে। হাউজিংয়ের বাসিন্দা আর একজন বয়স্ক মানুষ মহেশতলার একটি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর করোনা আক্রান্ত হন। চিকিৎসার পর তিনি বাড়ি ফিরেছেন। আরও দু-একজন আক্রান্ত হয়েছে, কেউ কেউ নিজে থেকেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, সুস্থ হয়ে ফিরেও এসেছে।
আমি এত বড়ো এক অঞ্চলের মধ্যে নামমাত্র কয়েকটা পাড়াতেই খোঁজ করতে পেরেছি। মেটিয়াবুরুজ আর সংলগ্ন আমাদের মতো এত বিশাল অঞ্চল খুবই জনবহুল। সরকারি তালিকাভুক্ত এবং তালিকা-বহির্ভুত বস্তির সংখ্যাও এখানে প্রচুর। ঘেঁষাঘেঁষি করে বেঁচে থাকা জনসমুদ্রের মাঝে গুটিকয়েক মধ্যবিত্ত ‘দ্বীপ’ বাদ দিয়ে লকডাউন আর সোশাল ডিস্টেন্সিং যে এখানে একটা হাস্যকর মিথ্যেয় পরিণত হয়েছিল তা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানে পুলিশ আর আমাদের জনপ্রতিনিধিরা।
Leave a Reply