২৭ ডিসেম্বর, শাকিল মহিনউদ্দিন, মেটিয়াবুরুজ#
পোশাক তৈরি শিল্পে মেটিয়াবুরুজ-মহেশতলার নাম আজ সকলেরই জানা। এই অঞ্চলের অধিকাংশ বাসিন্দার রুটি-রুজি তথা জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম হল এই পোশাক শিল্প। একদা এই অঞ্চলের দর্জিরা মেমসাহেব এবং কলকাতা ও তার আশেপাশের অভিজাত পরিবারের অর্ডারি পোশাক সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করত। কাজের বাহারি মুন্সিয়ানায় দর্জিদের বেশ খ্যাতিও ছিল, মিলত ভালো কাজের ইনাম। মানুষের চেহারাকে পর্যবেক্ষণ করে সেই আন্দাজ মতো কাটিং করা, তারপর হস্তশিল্পের নিঁখুত বয়নে শরীরের মানানসই করা পোশাকের মধ্যে দর্জির শিল্পী সত্তার পরিচয় ফুটে উঠত প্রতিটি পোশাকে। কিন্তু সময়ের অভিঘাতে সেই নিপুন হস্তশিল্প আজ বড়োই অমিল। তার জায়গায় এসে গেল যন্ত্রশিল্পের কারিগরি। ডাইসে সেট করা ডিজাইন এখন উঠে আসে পোশাকে। শিল্পকর্মের ছোঁয়া দেওয়ার পরিবর্তে কারিগরকে তাকিয়ে থাকতে হয় মেশিনে কাম জোগান দেওয়ার কাজে। সেলাইয়ের কাজে গতি বাড়িয়েছে মোটরচালিত যন্ত্র।
জীবন ও জীবিকার পথকে প্রশস্ত করতে সময়ের ডাকে দর্জিরা খুঁটিনাটি ওস্তাদি ছেড়ে পোশাক তৈরি শুরু করল পাইকারি হারে। সেই পোশাক বিক্রি হতে থাকল হাওড়ার মঙ্গলাহাটে, মানিকতলার হরিশাহাটে এবং আলিপুর-গোপালনগরের চেতলাহাটে। তখনও ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। স্থানীয় স্কুল শিক্ষক এম এ জব্বার সাহেব শিক্ষকতার পাশাপাশি গভীর রাতে কাঁধে গাঁটলি নিয়ে হাটেও যেতেন। রাতবিরেতে পরিবহণের অপ্রতুলতাকে মোকাবিলা করে সম্পূর্ণ কায়িক পরিশ্রম করে হাটে যাওয়ার কষ্টটা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। এছাড়া হাটে চুরি, ছিনতাই, প্রাণহানির ভয় তো ছিলই। এই সমস্ত অসুবিধাকে দূর করার জন্য দর্জি-অন্তপ্রাণ জব্বার সাহেবের মাথায় খেলে গেল হাট নির্মাণের চিন্তা। তার আগে অবশ্য মেটিয়াবুরুজের কারবালায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুন্নাফ মার্কেট হাট। বিক্রেতার বাড়িতেই যে ক্রেতার আবির্ভাব ঘটতে পারে — এই ভাবনার জনক কিন্তু জব্বার সাহেব। কখাগুলি জানালেন ১৩৯নং ওয়ার্ডের বেশ কয়েকবারের পুরপিতা, আকড়া হাই মাদ্রাসার প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ও এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী জনাব গোলাম রসুল মণ্ডল।
জব্বার সাহেব ‘জব্বার হাট’ প্রতিষ্ঠা করে এখানকার পোশাক শিল্পকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করলেন। সফির কাঠগোলার নিকটবর্তী ঘরামিপাড়ার হাজী মফিকুল ইসলাম মোল্লার মতে, জব্বার সাহেব পোশাক শিল্পকে নতুন দিশা দেখানোর জন্য গড়ে তুললেন ছোটো ছোটো স্টল। সেই স্টলে বসে নতুন করে ব্যবসা শুরু করা ছোটো-মাঝারি ব্যবসায়ীরা তাদের তৈরি পোশাক সারা ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত বাজারে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ পেল। হাট প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে জব্বার সাহেব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে খরিদ্দার টেনে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই বিজ্ঞাপনের টানেই খরিদ্দাররা জব্বার হাট হয়ে বিক্রেতার বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বিক্রেতার পরিবহণ খরচ বেঁচে যাওয়ায় অত্যন্ত কম দামে খরিদ্দারের কাছে ভালো পোশাকটি দিতে সমর্থ হয় সে।
এভাবে গলির ব্যবসা উঠে এল রাজপথে জব্বার সাহেবের সৌজন্যে। উৎপাদিত পোশাক কড়া নাড়ল ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে, প্রতিটি গ্রামের কাঁচাবাড়িতে। ব্যবসা বৃদ্ধির সাথে সাথে এখানকার উন্নতির মানচিত্রেও বদল এল। বদলে গেল জীবিকার ধরনধারণ। কাজের খোঁজে ছুটে আস্তে শুরু করল বাংলার পল্লি অঞ্চলের শিক্ষানবিশ দর্জিরা। ওস্তাগরের দলিজে বসেই সেলাই করতে থাকল প্রচুর পোশাক। ওস্তাগরপাড়ায় গড়ে উঠতে থাকল একের পর এক প্রাসাদসম বাড়ি। জব্বার সাহেবের আন্তরিকতার আরও এক বড়ো প্রমাণ হল, তিনি স্টলগুলো বিলিবন্টন করেছিলেন একেবারে জলের দরে। আজ তার দাম আকাশছোঁয়া।
মালিপাড়ার আবুল হাসান মালির (বুলবুল মালি) কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, হাট নির্মাণ করে বিভিন্ন প্রান্তের খরিদ্দারকে একত্রিত করা জব্বার সাহেবের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব। আমাদের প্রোডাক্টকে এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার যে প্রয়াস তিনি করেছিলেন, তা আজ অনেকটাই সফল।
অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যকে পরিণত করলেন বহির্বাণিজ্যে। টেকনিকাল জ্ঞান অর্জন করে, সুষ্ঠু বিজনেস পরিকল্পনার দ্বারা সততার সঙ্গে ব্যবসা করতে পারলে সারা পৃথিবীতে আমরা আমাদের তৈরি পোশাক সরবরাহের কাজে সক্ষম হয়ে উঠবেন বলে তিনি মনে করেন। তবে তিনি সতর্ক করেন, নিজেদের মধ্যে রেষারেষির মাত্রাটা অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে। দর্জিসমাজের উন্নতির জন্য জব্বার সাহেবের অবদান এখানে সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে। তবে আইনজীবী মনিরুল ইসলাম অত্যন্ত দুঃখ করেই বলেন, জব্বার সাহেবের আন্তরিকতার মর্যাদা আমরা কতটা দিয়ে থাকি তা নিজের বুকে হাত দিয়ে ভাবা উচিত।
Leave a Reply