৭ অক্টোবর ২০১১ : আইএমটি-মানেসরে এগারোটি কারখানা শ্রমিকদের দখলে
শের সিং সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ‘ফরিদাবাদ মজদুর সমাচার’ থেকে#
২০১১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস ছিল মারুতি-সুজুকির মানেসর প্ল্যান্টে মালিক শ্রমিক উভয়পক্ষের প্রস্তুতিপর্ব। শ্রমিকেরা যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে তেমন কিছু না করতে পারে, ম্যানেজমেন্ট তার ব্যবস্থা পাকা করছিল। শ্রমিকদের ওপর ছাঁটাই-সাসপেনশনের আক্রমণ তো ছিলই। তার ওপর পুলিশ-ক্যাম্প বসানো হয়েছিল। ৬০০ একর জায়গার ওপর এই মানেসর ফ্যাকট্রি এতদিন নিচু দেওয়াল আর তারজাল দিয়ে ঘেরা ছিল। অক্টোবর মাসের গোড়ায় চারপাশে উঁচু দেওয়াল তোলা হল। কারখানা এবার দুর্গের চেহারা নিল।
কিন্তু শ্রমিকদের মধ্যে অন্য এক প্রক্রিয়া গড়ে উঠল। গুরগাঁও থেকে ১৭ কিমি দূরে মানেসরের ইন্ডাস্ট্রিয়াল মডেল টাউনশিপ (আইএমটি)। ১২ সেপ্টেম্বর মারুতি সুজুকিতে শ্রমিক-বিক্ষোভের ঢেউ পৌঁছাল এখানকার সেক্টর-৩-এর মুঞ্জাল শোয়া ফ্যাকট্রিতে। স্থায়ী কাজে অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের প্রতিবাদে শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে দেয়। মুঞ্জাল শোয়ার গুরগাঁও এবং হরিদ্বার ফ্যাকট্রিতেও কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরের দিন মঙ্গলবার রাত আটটার সময় ১৫৫ জন শ্রমিককে কোম্পানি স্থায়ীকরণ করে।
১৪ সেপ্টেম্বর আইএমটি-মানেসরে বিকেল চারটের সময় সুজুকি পাওয়ারটন কাস্টিং ফ্যাকট্রি, সুজুকি পাওয়ারটন ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ইঞ্জিন ফ্যাকট্রি এবং সুজুকি মোটরসাইকেল ফ্যাকট্রির দুই শিফটের শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে ফ্যাকট্রির ভিতরেই বিক্ষোভ শুরু করে। শ্রমিকেরা শ্লোগান দিয়ে বলে : মারুতি সুজুকি মানেসর ফ্যাকট্রির সমস্ত শ্রমিককে কাজে ফিরিয়ে নিতে হবে; গুড কন্ডাক্ট বন্ড হটাতে হবে।
১৫ সেপ্টেম্বর ওই তিন ফ্যাকট্রির বিক্ষোভ চলতে থাকে। মারুতি সুজুকির গেটেও শ্রমিকদের মধ্যে উল্লাস দেখা যায়। তারা শ্লোগান দেয়, বক্তৃতা করে, গান গায় আর প্রচারপত্র বিলি করে। নানারকম আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। সেল অ্যান্ড ডেসপ্যাচ-এর ড্রাইভাররা সি-শিফটে কাজ বন্ধ করে দেয়। ঠিকেদারের অধীনস্থ ৩৫০ জন ড্রাইভার এ এবং বি-শিফটে সেল অ্যান্ড ডেসপ্যাচ গেটের বাইরে জমা হয়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে খোলা মাঠে তারা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
১৬ সেপ্টেম্বর সুজুকি পাওয়ারটন কাস্টিং ফ্যাকট্রি, সুজুকি পাওয়ারটন ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ইঞ্জিন ফ্যাকট্রি এবং সুজুকি মোটরসাইকেল ফ্যাকট্রির ম্যানেজমেন্ট শ্রমিকদের আলোচনায় ডাকে। শ্রমিকেরা ম্যানেজমেন্টের অনুরোধে কাজ শুরু করে।
১৮ সেপ্টেম্বর রাতে শ্রম দপ্তরে মারুতি সুজুকির ম্যানেজমেন্ট এবং শ্রমিকদের মধ্যে আলোচনা ভেঙে যায়। সেখান থেকেই পুলিশ তিনজন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে। শ্রমিকেরা উত্তেজিত না হয়ে তাদের জামিনের জন্য চেষ্টা করে। ২০ তারিখ তারা ছাড়া পায়।
ওদিকে ট্রেনিদের ফোন করে জানানো হয়েছিল, ১৯ সেপ্টেম্বরে মধ্যে কাজে না এলে বরখাস্ত করে দেওয়া হবে। ২০ তারিখ থেকে টেলিফোনে কোম্পানির সুর পাল্টাতে থাকল। প্রথমে, ‘ডিয়ার এমপ্লয়ি …’, তারপর ‘মারুতি পরিবারের প্রিয় সাথি’, তারপর ‘প্রিয় সহকর্মী’ সম্বোধন চলতে থাকল। এমনকী শ্রমিকদের গ্রামের বাড়িতেও পৌঁছে গেল ম্যানেজারেরা। বাড়ির লোককে শ্রমিকেরা বলল, ‘কিছু জিজ্ঞেস না করে ঠান্ডা এনে সাহেবকে খাইয়ে দাও আর আদর করে বিদেয় করো।’ আশপাশের কিছু পঞ্চায়েত-সরপঞ্চকে কোম্পানি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে একত্রিত করল। তাদের দিয়ে শ্রমিকদের বলানো হল, ফ্যাকট্রির ভিতরে ঢোকো, নাহলে এখান থেকে ভাগো। রাতে তাদের মদ খাইয়ে গাড়ি করে এলাকায় ঘোরানো হল। গ্রামে শ্রমিকদের ঘরের ভাড়া বাড়ানো হল। কিন্তু এসবে কোনো ফল হল না।
২৩ সেপ্টেম্বর ইউনিয়নের নেতারা তিনটে বাসে করে শ্রমিকদের নিয়ে মানেসর ফ্যাকট্রির গেটে এল। সুজুকির অন্য ফ্যাকট্রি থেকেও নেতারা এল। বক্তৃতা আর কথাবার্তা হল। ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা চালানোর জন্য গুরগাঁও ফ্যাকট্রির নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হল। ৩০ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে একটা লিখিত চুক্তি হল।
চুক্তি অনুযায়ী ৩ অক্টোবর স্থায়ী শ্রমিকেরা কারখানায় প্রবেশ করল। কিন্তু ১২০০ ঠিকা শ্রমিককে কাজে নেওয়া হল না। ৪ ও ৫ তারিখ একইভাবে চলল। দশেরার পর ৭ তারিখ ঠিকা শ্রমিকেরা কারখানার গেটে জমা হল। তাদের ধমকানোর জন্য সেখানে উপস্থিত হল কোম্পানির ভাড়াটে বাউন্সারেরা। একজন সাসপেন্ড স্থায়ী শ্রমিকের সঙ্গে সেই পালোয়ানদের বচসা হল। দ্রুত আইএমটি-মানেসরের তামাম ফ্যাকট্রির শ্রমিকদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হল। দুপুর একটার সময় মারুতি সুজুকির গেটে সকলে একত্রিত হল। ঠিক হল, বিকেল চারটের সময় এ এবং বি-শিফটের শ্রমিকেরা মিলে কারখানা দখল করে নেবে।
শ্রমিকেরা কারখানা দখল করল। মারুতি সুজুকির সঙ্গে সুজুকি ইঞ্জিন, সুজুকি কাস্টিং, সুজুকি মোটরসাইকেল, সত্যম অটো, বাজাজ মোটর, ইন্ডিওরেন্স হাইলেক্স, লুমেক্স, লুমেক্স ডি কে ডিঘানিয়া-র শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে নিজের নিজের কারখানা দখল করল। দাবি করা হল, মারুতি সুজুকির ১২০০ ঠিকা শ্রমিককে কারখানায় কাজে নিতে হবে। ৭ অক্টোবর বিকেল চারটে থেকে আইএমটি-মানেসরের ১১টি ফ্যাকট্রি দখল করে ধর্মঘট শুরু হল।
Leave a Reply