নেহা দীক্ষিত, ২৪ জুলাই, মূল ইংরেজি প্রতিবেদনটি স্ক্রোল ডট ইন-এ বেরিয়েছিল, অনুবাদ শমীক সরকারের করা#
মারুতি সুজুকির ১৪৭ জন শ্রমিক জেল-এ রয়েছে আজ দুই বছর ধরে, সাজা হয়নি, ছাড়াও পায়নি। তাদের মধ্যেই একজন সোহান। গুরগাঁও-এর ভন্দসি জেল-এ বন্দীদের মধ্যে যাদের নামের আদ্যাক্ষর স এবং র দিয়ে, তাদের আত্মীয় স্বজনরা তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারে সোমবার এবং বৃহস্পতিবার, সকাল আটটা থেকে দুপুর বেলা অবদি।
সুষমা সোহানের স্ত্রী, আমার পাশেই গাড়িতে বসে রয়েছে, আমরা ওই গাড়ি চড়েই জেল-এ যাচ্ছি। তার চোখে না ঘুমনোর ছাপ। তার প্রতিবেশি আত্মহত্যা করেছে, তাই সে রাতে ঘুমাতে পারেনি। পড়শি কাজ করত কেবল ফ্যাক্টরি, কাজের জায়গায় মারপিট হয়েছিল। সে বাড়ি এসে শেষবারের মতো গ্রামে তার স্ত্রীকে ফোন করেছিল, বলেছিল তার মারা যাওয়ার পর সে যেন আবার বিয়ে করে। তার স্ত্রী পড়শিদের ফোন করার আগেই সে ঝুলে পড়েছে।
সুষমা বলে, ‘একা মেয়ে হয়ে বেঁচে থাকা খুব কষ্টের’। পরিপাটি করে পোশাক পড়েছে সে, সালওয়ার কামিজ, আঁটো করে চুল বাঁধা বিনুনিতে, হাতের বড়ো কালো ব্যাগে একটা ছোট্ট টিফিন বাক্স। সে একটা কেবল ও তার তৈরির কারখানায় কাজ করে, সে কারখানায় তাকে সপ্তাহে দু-দিন দেরি করে আসতে দেয়।
‘আমার ঠিক পাশের বাড়ির মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করেছে আজ, … ‘তোমাকে দেখে তো বিয়ে হওয়া বলে মনে হয়, কিন্তু আজ তিন বছরে তোমার স্বামীকে একবারও দেখিনি, বাচ্চাও নেই। কী ব্যাপার?’ আমি তাকে বলেছি, কেন? তুমি কি আমার বাচ্চাদের বড়ো করতে চাও?’
সুষমার এখন বয়স তিরিশের কাছাকাছি। ২০০৮ সালে সে গ্র্যাজুয়েশন করেছে, তারপর শিমলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার শংসাপত্র পেয়েছে। এক বন্ধুর বাড়িতে দেখা, তারপর ভালোবেসে বিয়ে। সোহানের বাবা হরিয়ানার কার্ণালে থাকেন, তিনি এই বিয়ে মেনে নেননি। এবং স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না।
সোহান তখন মারুতি সুজুকির মানেসর কারখানায় স্থায়ী চাকুরে। পনেরো হাজার টাকা পায় মাস গেলে। আর সুষমা চাকরি পেয়ে গেল কাছেরই একটা স্কুলে। বেতন পাঁচ হাজার টাকা।
‘ঘটনাটা যখন হয় তখন একজন শ্রমিকের বিয়ে হয়েছে এক মাস মাত্র। তার স্ত্রী আমাকে বলেছে, কীভাবে তার চেনা পরিচিত প্রত্যেকে বলেছে, বৌ অপয়া, তাই স্বামী জেল-এ। আমি তাকে বলেছি, ওসব কথায় কান দিও না। আমার চার বছর বিয়ে হয়েছে। তবুও তো আমার স্বামী গ্রেপ্তার হয়ে গেছে।’ — সুষমা বলে চলে।
জিয়া লাল-এর খোঁজে
পঁচিশ মিনিট পর, আমরা জেল-এ পৌঁছলাম। ‘একটু আগেই চলে এসেছি আজ। সাধারণত আমি তিনটে অটো পাল্টে এখানে আসি।’ — সুষমা বলে ‘ইন্টারভিউ রেজিস্ট্রেশন সেন্টার’-এর দিকে এগোতে এগোতে। এখানেই যারা বন্দীদের সঙ্গে দেখা করতে চায়, তাদের নাম নথিভুক্ত করতে হয়।
আনারকলি সালোয়ার কামিজ পরে একজনের সঙ্গে মোলাকাত হলো এখানে। চুল ডাই করা। ফোন করছিল, ‘আপনি কেন স্টেশন হাউস অফিসারকে বলছেন না যে আমার স্বামীর জীবন বিপন্ন হবে এখান থেকে ছাড়া পেয়ে বাইরে এলে? আমি তো তাকে টাকাও দিলাম।’ এক মিনিট পর সে ফোন কেটে দিল। ওর নাম মমতা। পনেরো বছর আগে তার স্বামীর যাবজ্জীবন হয়। এখনো সে জেল-এ। দু’বছর আগে স্বামীদের নামের আদ্যক্ষরের সাদৃশ্যের কারণে মমতা আর সুষমার দেখা হয়। তখন থেকেই তারা বন্ধু, পরস্পরের সমব্যাথী। যাদের স্বামীরা জেল-এ, তাদের তো রোজই বিচার আর একঘরে হয়ে থাকারই জীবন।
মিটিং-এর জন্য নাম নথিভুক্ত করার লাইনে দাঁড়িয়ে তারা পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে। নিজেদের মধ্যে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেই তারা কাগজপত্র জমা দেয়, ওয়েবক্যামেরার সামনে দাঁড়ায়, পরের কাউন্টারে যায়। ‘কেন তুমি ওদের কথা শোনো?’ সুষমা মমতাকে জিজ্ঞেস করে। ‘ওরা আমাকে বলে ‘বেচারি’। যখন আমি ওদের সহানুভূতি প্রত্যাখ্যান করি, আমাকে বলে চরিত্রহীনা, কারণ আমি আমার মতো করে জীবন চালাই, ভালো কাপড়জামা পরি, স্বামী জেল-এ তাই শোকে সারাক্ষণ মুহ্যমান থাকি না। আমার যদি বিয়ে না হতো তাহলে কী হতো? আমাকে তো বেঁচে থাকতেই হতো, তাই না? সেকথা ভাবি আর সামনে তাকাই আমি।’
‘দিদি, তোমার ব্যাপারটা আলাদা। আমার স্বামী কাউকে খুন করেনি। সে অধিকার চেয়েছিল। … এমনকি তোমার স্বামীর যেমন দোষ প্রমাণ হয়েছে, তার দোষও প্রমাণ হয়নি’ — সুষমা বলে।
১৯৯৯ সালে মমতার স্বামী একটা খুন-এ দোষী প্রমাণিত হয়। সুষমার স্বামী এবং মারুতি সুজুকির আরো ১৪৬ জন শ্রমিক মারুতি সুজুকি কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার অবনিশ কুমার দেব-এর খুনের (১৮ জুলাই ২০১২) দায়ে জেল-এ। কেটিএস তুলসি, হরিয়ানার পাবলিক প্রসিকিউটর, যার একবার এজলাসে ওঠার পারিশ্রমিক ১১ লাখ টাকা, তিনি দাবি করেছেন যে তার কাছে এদের অপরাধের ২৩ জন প্রত্যক্ষদর্শী আছে। রাজেন্দ্র পাঠক, শ্রমিকদের হয়ে দাঁড়ানো আইনজীবি বলেন, ‘কেবলমাত্র প্ল্যান্টের সিনিয়র ম্যানেজার প্রসাদ দাবি করেছিল যে সে জিয়া লাল বলে এক শ্রমিককে দেখেছে মারুতি কারখানায় আগুন দিতে। যখন তাকে বলা হয় জিয়া লাল-কে চিনিয়ে দাও, সে পারেনি।’
২০১৩ সালের মে মাসে প্রথমবারের জন্য শ্রমিকদের জামিনের আবেদন করা হয়। তা প্রত্যাখ্যান করে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট বলে, ‘বিদেশি পুঁজিপতিরা তাহলে শ্রমিক অসন্তোষের ভয়ে ভারতে বিনিয়োগ করবে না।’ এই মামলাটাকে একটা দৃষ্টান্তমূলক রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে ১৪৭ জনেরই মারাত্মক সাজা হবে, হতে পারে দুই যুগের জন্য জেল-এ থাকার সাজা।
সুষমা একটা ব্যাগে তিনটে বই নিয়ে এসেছিল — অক্সফোর্ডের ইংরেজি থেকে হিন্দি অভিধান, একটা ধর্মের বই, এবং ভারতের শ্রম আইনের ওপর ছোটো একটা বই। মহিলা কনস্টেবল সব বইগুলির পাতা খুলে খুলে দেখল। তারপর সুষমাকে বলল, ‘জেলের মধ্যে আইনের বই আর অভিধানের কী দরকার। এগুলো তুমি নিয়ে যেতে পারবে না।’
দরজা খুলল, দশ ফুটের একটা ঘর, এক ফুটের একটা তারজালি দিয়ে দুইভাগ করা। ওই দুই ভাগ দিয়েই জনা পনেরো দর্শনপ্রার্থীদের দুটি লাইন চলে গেল। জেলের পাশে তারা অপেক্ষা করতে লাগলো। ‘আজ অনেক কম লোক এসেছে’ — সুষমা বলে, ‘আজ মেঘলা ছিল সকালটা, তাই’।
জেলের খিড়কির ওপারে এল প্রথম বন্দী। অংশু, জেলবন্দী মারুতি শ্রমিক সুমিতের দুই বছর বয়সী ছেলে চিৎকার করে উঠল আনন্দে, বাবাকে দেখে। ওর জন্মের সময় থেকে অংশু বাবাকে দেখছে জেলবন্দী। ওর মা ওকে একটু তুলে ধরলো, যাতে ভালো করে দেখতে পারে বাবাকে।
‘আমার মরদ আমাকে আজ দাঁড় করিয়ে রাখবে। ও আমার ওপর রেগে আছে, ওর ছাড়ানোর কাগজপত্র আমি তাড়াতাড়ি করে জমা দিতে পারিনি তাই’ — মমতা বলে।
সোহান আসে, চান করেছে, দাঁড়ি কামিয়েছে সদ্য। চুল আঁচড়ানো, বাঁদিকে ফেলা। সুষমাকে দেখে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। জেলের খিড়কির দু-পাশে গরাদ ধরে দু-জনে দু-জনের প্রতিবিম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সুষমা আমার দিকে আঙুল দেখায়, সোহান হাত নাড়ে।
আরো বন্দীরা চলে আসে। গুঞ্জন বেড়ে যায়। মমতার স্বামী, মধ্যবয়সী বিশাল চেহারার এক পুরুষ সাদা কুর্তা পাজামা পরে গামছা জড়িয়ে দুই পা মুড়িয়ে বসে আছে মেঝেতে। মমতা তাকে দেখে এদিকে ঠিক সেভাবেই বসে পড়ে।
‘ম্যাডাম, ধন্যবাদ আপনি এসেছেন। সবাই আমাদের ভুলে গেছে। মিডিয়া আমাদের সাহায্য করা ছেড়ে দিয়েছে। এটাকেই কি কর্পোরেট মিডিয়া বলে?’ সোহান জিজ্ঞেস করে।
‘তিন চারজনের বাচ্চা মারা গেছে। কিন্তু তারা সৎকারে অবদি যেতে পারেনি। আরেকটা ছেলের বাবা গত বছর মারা গেছে। সে ঠিক সময়ে শ্রাদ্ধে যেতে পারেনি। উত্তর প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, ওড়িশা, রাজস্থানের দূর দূরান্তের পরিবারগুলোর ওরাই একমাত্র উপার্জনকারী। ওদের পরিবারের লোকজন আসা ছেড়ে দিয়েছে, কারণ আসা যাওয়া করার মতো পয়সা নেই তাদের। কেউ কেউ ছ-মাস হয়ে গেল পরিবারের কাউকে দেখেনি। তিন চারটে ছেলের তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’ — সোহান বলে।
সে যাতে সুষমার সঙ্গে কথা বলতে পারে, তাই আমি দু-পা পিছিয়ে এলাম। ছোট্ট ঘরে গুঞ্জন এত বেড়ে গেছে যে চিৎকার করে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে। প্রত্যেকে হাসছে। এই মূল্যবান মুহুর্তটার জন্য প্রত্যেকে খুশি।
দু-মিনিট পর সোহান আমাকে ডাকল। ‘আরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। আজকাল তো আমার নতুন লোকেদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ-ই হয় না।’ সে হেসে বলে।
ভেতরে কেমন কাটছে? — আমি তাকে জিজ্ঞেস করি।
‘ভালো। দরকারি খাবারটুকু দেয়’, হেসে বলে সোহান, ‘কাঁচা কাঁচা রুটি, পাতলা ডাল। একটা লাইব্রেরি আছে, একটা ডাক্তার আসে নিয়মিত। একটা ক্যানটিনও আছে। আমরা চাইলে কিনে খেতে পারি। কিন্তু তার জন্য টাকা দরকার। আমার বউ রোজগার করে এনে দেয় যাতে আমি কিছু কিনে খেতে পারি। কিন্তু যাদের সেরকম কেউ নেই, তাদের তো ওই যেটুকু খাবার দেয় সেটুকুই ভরসা। আমরা ভাগাভাগি করে খাই। এদের কেউ কেউ ঠিকা শ্রমিক। একজন তো কাজে লাগার তিনদিনের মাথায় ঘটনাটা ঘটেছে। আরে অন্তত ওদের তো ছেড়ে দিক’ — এক তোড়ে কথাগুলো বলে চলে সোহান।
আর চারজন মারুতি শ্রমিককে দেখিয়ে সে বলে, ‘আমাদের সঙ্গে অবনিশ কুমারের ভালোই সম্পর্ক ছিল। আমরা তার কাছে মাঝে মধ্যেই পরামর্শ চাইতাম। আমরা কেন তাকে খুন করতে যাব? পেচ্ছাপ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় আর মেডিক্যাল লিভ দাবি করা মানে কি মার্ডার করা? এমনকি জেলের অবস্থাও ওর থেকে ভালো। সেদিন আমি কাজের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। জানতাম না দু-বছর ধরে জেল-এ পচতে হবে। জানি না আরো ক’বছর থাকতে হবে এখানে।’
পুলিশ কনস্টেবল এসে বলল, আর এক মিনিট সময় আছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো দর্শনপ্রার্থী আর বন্দীরা গরাদের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এল। শেষ আধ মিনিটে সমস্ত মারুতি শ্রমিকরা এক জায়গায় এসে আমায় হাত নাড়লো। সোহান চিৎকার করে বলল, ‘ম্যাডাম, কিছু করবেন।’
তারপর এক এক করে বেরিয়ে আসতে লাগলো সকলে। মমতা সক্কলের শেষে বেরোলো। এই জেল শুরু হওয়ার প্রথম দিকের বন্দীদের মধ্যে তার মরদ একজন।
প্রত্যেকে এসে তাদের ব্যাগ নিল। সুষমার চোখে জল চলে এসেছিল, ‘আমি কখনো ওকে দেখাই না যে আমি দুঃখে আছি। ও আমাকে জিজ্ঞেস করে বাবা ফোন করে ওর খোঁজ নিয়েছেন কিনা। আমি মিথ্যে বলি, হ্যাঁ নিয়েছে। বাইরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেসব কথা বলে আমি ওকে বিড়ম্বনায় ফেলতে চাই না। … আমি নিজের জন্য কিচ্ছু কেনাকাটা করি না, কিন্তু ও কিছু চাইলে এক দিনও দেরি করি না। এই দু বছরে আমি কোনো কাপড় নিজের জন্য কিনিনি, কেবল ওর আর জেলে বন্দী সঙ্গী সাথিদের জন্য কিনেছি।’
আমরা গাড়িতে এসে বসলাম, ‘লোকে কেন জঙ্গী হয়? কারণ তুমি ন্যায্য দাবি করার জন্য তাদের যৌবনটা গিলে খাও, তাই’, সুষমা হঠাৎ বলে ওঠে। মমতা বলল, ‘আমি জানি না আমার স্বামী বেরিয়ে এসে কী করবে। এই ক’বছরে তো দিনকাল এত বদলে গেছে, সে কিছুই জানে না। মোদী বলেছেন, ভালো দিন আসছে। আমার তো কই এলো না।’ সুষমা বলে, ‘এই মাসে রেশনে এক শিশি তেল কিনেছি। তারও দাম বেড়ে গেছে। তার ওপর ঘর ভাড়া, সোহান ও তার সঙ্গী সাথিদের জন্য খরচ। ওদের যদি সাজা হয়ে যায়, আমি অন্তত এটুকু জেনে যাব যে কতদিন এমন করে চালাতে হবে।’ মমতা বলে, ‘জেনে কী লাভ। আমি জানতাম চৌদ্দ বছর, এখন তো পনেরো বছর হয়ে গেল।’ সুষমা বলে, ‘ঠিকই বলছ। তুমি কোন তারকেশ্বর মন্দিরের কথা বলছিলে?’ ‘কাছেই, সামনে বার যাব’, মমতা উত্তর দেয়।
Leave a Reply