গুরগাঁওয়ের মানেসরে মারুতি মোটরগাড়ি কারখানার ম্যানেজারেরা দলবদ্ধ শ্রমিকের স্বতঃস্ফূর্ত ক্রোধের শিকার হয়েছেন। একজন ম্যানেজারকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এই ঘটনা দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়ও বটে।
কিন্তু কেন এমন ঘটল? এর পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যপূর্ণ উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। দলবদ্ধ শ্রমিকের এরকম মারমুখী চেহারা অবশ্য পশ্চিমবঙ্গেও কখনো কখনো দেখা গেছে। সাধারণ ছাপোষা শ্রমজীবী মানুষের দপ করে জ্বলে ওঠা আগুনের মতো হিংস্র চেহারা আমাদের একেবারে অপরিচিত নয়।
মারুতি-সুজুকি ভারতের সবচেয়ে বড়ো মোটরগাড়ি কোম্পানি। এর মালিকানার মূল নিয়ন্ত্রণ জাপানি সুজুকি কোম্পানির হাতে। এই কোম্পানির প্ল্যান্টগুলোতে কিছুটা অভিনব হলেও অত্যন্ত সংগঠিত ও আধুনিক কায়দায় শ্রমিকদের কম পয়সায় বেশি উৎপাদন করিয়ে নেওয়া হয়। গত ত্রিশ বছরে কোম্পানির এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটা সংগঠিত শীতল হিংসা রয়েছে। তার বহিঃপ্রকাশ সামান্যই। শ্রমিকদের তুই-তোকারি-গালিগালাজ আর কলার চেপে ধরা তো রয়েছেই। ঠিকা শ্রমিকদের সামান্য ণ্ণবেআদবি’ দেখলে নিঃশব্দে কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া হয়।
এই সুসংগঠিত ও লাগাতার দমনের সামনে দীর্ঘকাল শ্রমিকেরা ছিল অসহায়। ২০০০ সাল থেকে ম্যানেজমেন্টের পোষা একটা ইউনিয়ন শ্রমিকদের মাথার ওপর চেপে বসেছিল। এগারো বছর সেই ইউনিয়নের কোনো নির্বাচন হয়নি। শ্রমিকেরা নিজেদের উদ্যোগে একটা স্বাধীন ইউনিয়ন করতে চাইল। কিন্তু সরকার রেজিস্ট্রেশনের আবেদন নাকচ করে দিল। এই অবস্থায় গত বছর জুন মাসে ১৩ দিন স্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিক এবং ট্রেনি-কর্মীরা একত্রে মানেসর কারখানা দখল করে রাখে। এরপর কোম্পানি একটা গুড কন্ডাক্ট বন্ডে শ্রমিকদের জোর করে সই করিয়ে নিতে চায়। শ্রমিকেরা তা প্রত্যাখ্যান করে। ঠিকা শ্রমিকদের কাজে ঢুকতে না দিলে অক্টোবর মাসে আবার কারখানা দখল করে শ্রমিকেরা। এবার এই কারখানা-দখল আন্দোলনে যোগ দেয় আশপাশের আরও দশটি কারখানার শ্রমিক। এবার কোম্পানি নতুন চাল দেয়। তারা গোপনে নবগঠিত স্বাধীন ইউনিয়নের নেতাদের হাত করে ফেলে। হঠাৎ শ্রমিক-নেতারা চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে যায়। শ্রমিকেরা অগত্যা তড়িঘড়ি নতুন নেতা স্থির করে।
কিন্তু আইনসম্মতভাবে সামান্য সংগঠিত হতে না দেওয়ার ঘটনা শ্রমিকদের ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে। সামান্য ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারটুকুও না দেওয়ার এই রেওয়াজ গুরগাঁও শিল্পাঞ্চলে রয়েছে। এবছর মার্চ মাসে এখানকার ওরিয়েন্ট ক্রাফট কারখানায় (ভারতের সবচেয়ে বড়ো পোষাক তৈরির সংস্থা) একজন লেবার কন্ট্রাক্টর একজন শ্রমিককে কাঁচি নিয়ে আক্রমণ করে। সেই ঘটনায় কারখানার বিশ হাজার শ্রমিক ভয়ানক উন্মত্ত হয়ে ওঠে। আর একটি ঘটনায় একজন নির্মাণ-শ্রমিক কাজ করতে করতে সাততলা থেকে পড়ে যায়। আশপাশের বিভিন্ন সাইট থেকে এক হাজারের বেশি নির্মাণ-শ্রমিক জড়ো হয় এবং নির্মাণ কোম্পানির অফিসে চড়াও হয়।
অতএব মারুতির ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। ক্ষমতাহীন মানুষের সামান্য প্রতিবাদ করার সুযোগটুকুও যদি কেড়ে নেওয়া হয়, যদি দিনের পর দিন সংগঠিত ক্ষমতার হুমকি আর দমনের পরিবেশে তাকে মুখ বুজে কাজ করতে হয়, তাহলে তার ধৈর্যের বাঁধ কখনো কখনো ভেঙে পড়তে পারে। তখন ঘটতেও পারে ক্ষমতাহীনদের দলবদ্ধ হিংসার ঘটনা।
Leave a Reply