- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

মানিকদার চায়ের দোকান

অমিতাভ সেন, ভবানীপুর, ৩০ জুলাই##

মানিকদার চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালে বোঝা যায় ডেকচিতে শুধু চায়ের জল ফোটে না। বোঝা যায় রাস্তার নাম দেবেন্দ্র ঘোষ রোড কেন। এখানে এই ছোট দোকানঘরে এসে সার্থক।
খুব ভিড়ের সময় এলাকার উঠতি মস্তান বাইক থেকে ‘আমারটা’ বলে হাঁক মারলে একবারও চোখ না তুলে ‘ণসময় হলেই পাবে’ বলে মোটরগাড়ি কারখানার বুড়ো ফিটার মিস্ত্রির হাতে গরমজলে ধোয়া ভাঁড়গুলো ধীরে ধীরে গুছিয়ে দেন। তারপর চায়ের কেটলির সাথে ফেরৎ খুচরো দিয়ে তাকে হিসেব বুঝিয়ে দেন।
রাত ঠিক ৯টার সময় বনেদি ঘরের বাবু খানদানি গলাটাকে একটু মিহি করে ‘মানিক একটু চা হবে ভাই?’ বললে মানিকদা অবিচলিত স্বরে ‘দোকান বন্ধ হয়ে গেছে’ ঘোষণা করে মহম্মদ রফির আধগাওয়া গানটার সাথে সাথে দোকান ধোয়া মোছার কাজ শেষ করতে থাকেন।
যে লোকটা কথায় কথায় খিস্তি দেয়, মানিকদার ভাই একবার দোকানে বসে তাকে ডেকে বাজার থেকে কিনে আনা তার হাতের মূলোর দর জিজ্ঞেস করায় সে একটা খারাপ কথা উচ্চারণ করেছিল। লোকটি চলে যাওয়ার পর ভাইয়ের মর্যাদাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলে মানিকদা তাঁর ভাইকে প্রচণ্ড বকেছিলেন, ‘কোন মানুষের সাথে কী কথা বলতে হয় শিখিসনি? তোকে দোকানে বসতে হবে না।’
খুব যত্ন করে চা করেন মানিকদা। প্রতিটা ভাঁড় একবার ঠান্ডা জল একবার গরমজলে ধুয়ে। চায়ে চিনি দিয়ে দুধ দিয়ে বার বার চামচেতে তুলে আরেকটা ভাঁড়ে ঢেলে টেস্ট করেন। তারপর হাত ধুয়ে মুছে তবে খদ্দেরের জন্য চা ঢালেন। কোনবার এর অন্যথা হয় না। শত ভিড়ের চাপ, খদ্দেরদের উশখুশ মানিকদার এই গোটা প্রক্রিয়াকে একটুও প্রভাবিত করে না।
গত ৩৮ বছর ধরে মানিকদার অকম্পিত স্বর একবার শুধু অনরকম শুনেছি। মোহনবাগানের প্রবল সমর্থক মানিকদাকে ইস্টবেঙ্গলের ৫ গোল দেওয়ার দিন সবাই যখন খোঁচাচ্ছিল তখন চায়ের দোকানের খাঁচার মধ্যে থেকে আহত সিংহের গর্জন শোনা গিয়েছিল, ‘ইস্টবেঙ্গল ৫ গোল দেওয়ার মতো ভালো খেলে জিতেছে তো? ব্যস। আমি হার মেনে নিয়েছি। আর কোন কথা আছে কি?’
সম্প্রতি আরেকবার দুপুর ১২টা নাগাদ দোকান বন্ধ করার সময়ে ‘ণআপনি এবেলার শেষ খদ্দের’ বলে তিনি আমাকে চা এগিয়ে দিয়ে একটু দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, ‘আমার বাবার সময়ে সন্ধ্যে ৭টায় দোকান বন্ধ হয়ে যেত। তাতেই একটা ঘরে আমাদের ৪-৫জনের দুধ-ভাত হয়ে যেত। এখন কী দিন পড়েছে। একটা ঘরে একজনকে নিয়েও চলে না। গড়িয়ার দিকে বাড়ি নিয়েও ছেড়ে দিয়েছি। কাউকে চিনি না। এখানে রাস্তায় বেরোলে সবাই চেনে, হাসে। ওখানে বউরা পাশের বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলবে কি, সবাই ভয়ে অস্থির, অচেনা জায়গা। আবার ভবানীপুরেই ফিরে এসেছি। খরচ খুব। খালি ভাবি আর আধঘন্টা দোকান চালালে আরেকটু কিছু হবে। আগে উত্তমকুমারের বই লাগলেই দোকান বন্ধ করে সিনেমা হলে ছুটতাম।’ বলে ম্লান হাসলেন, তারপর মৃদু কন্ঠে বললেন, ‘সিনেমাহলগুলোই বন্ধ হয়ে গেল সব। ছেলেমেয়েগুলো ঘরে এখন টিভি দেখে, বুঝলই না কীসব দিন চলে গেল।’