- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

ভারতের পরমাণু শক্তির প্রসার পরিকল্পনা এবং প্রতিরোধ

কুডানকুলাম পরমাণু প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনের কর্মী এবং ‘পিপলস মুভমেন্ট এগেনস্ট নিউক্লিয়ার এনার্জি’র নেতা এস পি উদয়কুমার সম্প্রতি ‘বিদ্যুতে একচেটিয়া দখলদারি ও পরমাণু শক্তি’ শীর্ষক এক বক্তৃতা দিতে কলকাতায় এসেছিলেন। ২৮ জুলাই সন্ধ্যায় মধ্য কলকাতার আর্থকেয়ার বুক্‌স-এ এক ঘরোয়া আলোচনায় তিনি কয়েকজন বন্ধুর কাছে কিছু কথা বলেন। তাঁর সেই কথাবার্তার প্রথম অংশ এখানে প্রকাশ করা হল। ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন জিতেন নন্দী#

এস পি উদয়কুমার
এস পি উদয়কুমার

আমি পরমাণু শক্তি সম্পর্কিত সামগ্রিক ছবিটা দেওয়ার চেষ্টা করব। শান্তনু চক্রবর্তী কিছুটা যোগ করতে পারবে, আমরা জাতীয় স্তরে উদ্যোগ নিচ্ছি যাতে ‘ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অফ অ্যান্টি নিউক্লিয়ার মুভমেন্টস’ ন্যাম-কে পুনরুজ্জীবিত করা যায়। ২০০৯ সালের জুন মাসে আমরা দেশের সমস্ত পরমাণু বিরোধী এবং ইউরেনিয়াম মাইনিং বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে ন্যামের মধ্যে সমাবেশিত করা হয়েছিল। তারপর কুডানকুলাম পরমাণু শক্তি বিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আমরা তেমন কিছু করতে পারিনি। এখন পুনরায় ন্যামকে সংগঠিত করার কিছুটা সময় ও সুযোগ পেয়েছি। এখন আমাদের সামনে এক নতুন সরকারের রাজনৈতিক পলিসি।
মনমোহন সিং প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে সব ধরনের দেশের সঙ্গে সব ধরনের ডিল (চুক্তি) সেরে ফেলেছিলেন। যদিও ভারতের জনসাধারণ এইসব ডিলের বিন্দুবিসর্গ জানে না। তিনি দেশের পক্ষ থেকে একের পর এক ডিলে সই করে গেছেন। এখন বিজেপি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু পলিসির কোনো বদল হয়নি। আমরা জানি পরমাণু বোমা আর পরমাণু প্রযুক্তির ব্যাপারে বরাবর বিজেপির আসক্তি রয়েছে। এমনকী ভারতীয় জনসংঘ এবং অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার নির্বাচনী ইশ্‌তেহারেও সর্বাগ্রে সবসময় পরমাণু বোমা এবং প্রযুক্তির উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব আমরা নতুন সরকারের পরমাণু পলিসিতে কোনো পরিবর্তন পাইনি। আমরা ভেবেছিলাম যে অন্তত তারা মনমোহন সিংয়ের সই করা চুক্তিগুলো একবার খতিয়ে দেখবে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ওইসব চুক্তিকেই লাগু করতে চেয়েছেন, এমনকী সে ব্যাপারে তিনি আরও ক্ষিপ্ত। তিনি সেইসব চুক্তিকে পুনর্নবীকরণ করছেন, সেগুলোর পুনরুচ্চারণ করছেন। এটাই হতাশার জন্ম দেয়।

রুশ-ভারত সহযোগিতা (কোলাবরেশন) যেটা ছিল, তার মাধ্যমে মোট ১২টা চুল্লি কেনার চুক্তি হয়েছে। ইতিমধ্যে কুডানকুলামে দুটো চুল্লি বসেছে, অর্থাৎ আরও দশটা রাশিয়ান চুল্লি রাশিয়া থেকে কেনা হবে। আমরা জানি না, হয়তো এর মধ্যে চারটে হরিপুরের জন্য বরাদ্দ হবে। আরও চারটে বসবে কুডানকুলামে, বাকি দুটোর জন্য ওরা সাইট খুঁজছে। উড়িষ্যার পাতি সোনাপুরের কথা সম্ভাব্য সাইট হিসেবে আলোচনা হয়েছে। আমরা নিশ্চিতভাবে সেটা জানি না। দিল্লিতে রাশিয়ান দূতাবাসও বিকল্প সাইটের জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। ওরা আন্দাজ করছে যে হরিপুরে চুল্লি নাও বসতে পারে। কিন্তু ওরা অবশ্যই কুডানকুলামে আরও পাওয়ার প্ল্যান্ট বসাতে চাইছে। কারণ তামিলনাড়ুর আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে ডিএমকে আর এডিএমকে চুপ করে রয়েছে। আমরা করুণানিধি এবং ওঁর ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে দেখা করেছি। আমরা জয়ললিতার অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং ওঁর বদলে যিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তাঁর সঙ্গেও কথা বলেছি। আমরা ওঁদের বলেছি যে কুডানকুলামে যখন প্রথম দুটো চুল্লির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তখন কেন আমরা আরও চুল্লি বসাতে যাব? অতএব আমরা ডিএমকে এবং এডিএমকে-র সঙ্গে লবি করার চেষ্টা করলাম। আমরা সফল হলাম না। কারণ উভয় দলই উন্নয়ন সম্পর্কে অন্যান্য দলের মতোই ধারণা পোষণ করে। উভয় দলই দিল্লির চাপের মধ্যে রয়েছে, দিল্লির সরকারকে ভয়ও পাচ্ছে। তাদের উভয়ের নেতাদের ওপরই দুর্নীতির নানারকম অভিযোগ রয়েছে।

সিপিএম এবং সিপিআইয়ের অবস্থান বেশ গোলমেলে। সিপিএম সরকারের নিউক্লিয়ার পার্কের ধারণাকে সমর্থন করে না। তারা মনে করে যে প্রতিটি সাইটে দুটোর বেশি পরমাণু চুল্লি বসানোর দরকার নেই। সিপিআই পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে, কিন্তু সেটা তারা জনসমক্ষে ঘোষণা করতে চায় না। দিল্লিতে চারমাস আগে তাদের এক নেতা সুধাকর রেড্ডির সঙ্গে কথা হয়েছিল। সিপিএমের বরদারাজন এবং ফরোয়ার্ড ব্লক ও আরএসপির নেতাদের সঙ্গেও কথা হয়। কথাবার্তা বেশ সমর্থনমূলক, কিন্তু তারা কেউই প্রকাশ্যে এব্যাপারে একটা স্পষ্ট অবস্থান নিতে চায় না। ২০০৯ সালে নির্বাচনের আগেও এঁদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম যাতে এটাকে নির্বাচনে একটা ইস্যু করা যায়। তখনও তারা রাজি হয়নি। তারা ভয় পায় যে এর ফলে তারা জাতীয়তা বিরোধী, উন্নয়ন বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবে। এটাই হল কুডানকুলামের পরিস্থিতি। প্রথম দুটো প্রজেক্টের খরচ ছিল ১৩,২০০ কোটি টাকা। হঠাৎ তারা ঘোষণা করল যে খরচটা বেড়ে হয়েছে ১৭,০০০ কোটি টাকা। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, কী করে খরচটা বেড়ে গেল? ওরা বলল যে নির্মাণের সময় খরচটা বেড়ে গেছে, ৪০০০ কোটি টাকা সুদ হিসেবে (ইন্টারেস্ট ডিউরিং কনস্ট্রাকশন) যোগ হয়েছে। ১৩০০০ কোটি টাকার ওপর ৪০০০ কোটি টাকার সুদ? কীভাবে এটা হিসেব করা হল? কে করল? কোনো উত্তর নেই। ৩ ও ৪ নং ইউনিটের জন্য ওরা খরচ ধরেছে ৪৫,০০০ কোটি টাকা। তিনগুন খরচ বেড়ে গেল। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে বাড়ল?

ইদানীং ওরা বলছে যে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে প্রজেক্টের জন্য বাড়তি আর্থিক দায় বা লায়াবিলিটি। যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০১৫ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে এখানে এসেছিলেন, ওবামা এবং নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একটা কথাবার্তা হয়েছিল, একটা মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং স্বাক্ষর করা হল, এটা ভারত বা মার্কিন দেশের নাগরিকদের কাছে প্রকাশ করা হয়নি। অন্ধ্রপ্রদেশের কোবাডায় যে মার্কিন কোম্পানি পরমাণু চুল্লি সরবরাহ করছে, সাপ্লায়ার কান্ট্রির বা সেখানকার কোম্পানির কোনো লায়াবিলিটি নেই, অর্থাৎ এখানে চুল্লিতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মার্কিনিদের কোনো দায় নিতে হবে না। কোনো ক্ষতির জন্য এনপিসিআইএল দায়ী থাকবে, তাদেরই সম্পূর্ণ লায়াবিলিটি। এটা প্রথমে চেপে যাওয়া হয়েছিল। পরে বিদেশ বিষয়ক মন্ত্রক থেকে এটা জানা যায়। তখন আমরা প্রশ্ন করলাম, যদি আমেরিকান সাপ্লায়ারের জন্য লায়াবিলিটি না থাকে, তাহলে তো রাশিয়ান কোম্পানির জন্যও লায়াবিলিটি থাকবে না। লায়াবিলিটি অ্যাক্ট তো ইউএস-এর জন্য একরকম, রাশিয়ার জন্য আরেকরকম, ফরাসিদের হজন্য আরেকরকম হতে পারে না। অতএব কুডানকুলামের ৩ ও ৪ নং ইউনিটের জন্য কেন ৪৫,০০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, আমরা বুঝতে পারলাম। আমরা ডিএই (ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জি) একটা চিঠি লিখে আরটিআই করেছি, সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা পাইনি। লায়াবিলিটি বা দায়ের প্রশ্নে কিছু অস্পষ্ট ব্যাপার রয়েছে। হরিপুর, পাতি সোনাপুর বা অন্যত্র কী হবে, কেউ জানে না। ২০০৫ সাল থেকে প্রায় এক দশক এরা আমেরিকান চুক্তি নিয়ে কিছুই ভাবেনি। ভারত মার্কিন পরমাণু চুক্তি নিয়ে কত যাওয়া-আসা হয়েছে, কত টাকা খরচ হয়েছে, বুশ এসেছেন, ওবামা এসেছেন, নরেন্দ্র মোদি ওদেশে গেছেন, ভারতের জনসাধারণ কোনো ফলই পায়নি। এখন …

কারণ আমেরিকান কোম্পানি গুজরাতের মিঠি ভিরদিতে এবং অন্দ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলামের কোবাডায় পরমাণু চুল্লি বসাচ্ছে। আমেরিকানরা এই চুল্লির জন্য লাইসেন্স পায়নি। জাপানি কোম্পানি ওগুলো বসাচ্ছে। তাই ভারত জাপানের সঙ্গেও একটা পরমাণু চুক্তি করেছে। মোদি টোকিও গিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে মিঠি ভিরদি এবং কোবাডায় জমি অধিগ্রহণ চলছে, ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে। মহারাষ্ট্রের জইতাপুরে যে ফরাসি পরমাণু চুল্লি বসবে, সেই প্রজেক্টের ব্যাপারে শিবসেনা বিরোধিতা করেছে। কারণ সেখানকার মানুষের সমর্থন নিয়ে তারা ভোটে জিতেছে এবং সেই সমর্থন তারা হারাতে চাইছে না। একই ধরনের একটা প্রজেক্ট ফরাসি ‘অ্যারেভা’ কোম্পানি ফিনল্যান্ডে করছে। সেই প্রজেক্ট সময় ও খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাতিল হয়েছে। জইতাপুরের মানুষ এই দৃষ্টান্ত তুলে ধরে সেখানে অ্যারেভার প্রজেক্টকে আটকাচ্ছে। এর ফলে নরেন্দ্র মোদি আর মনমোহন সিংয়ের গ্র্যান্ড নিউক্লিয়ার তাজমহল স্কিমের পথে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। কুডানকুলাম ১ ও ২ নং প্রজেক্ট ছিল এই নিউক্লিয়ার তাজমহল স্কিমের ভিত্তিপ্রস্তর। তারা এটা স্বীকার করতে চায় না যে তাদের এই ভিত্তিপ্রস্তর ভারসাম্যহীন অথবা খারাপভাবে স্থাপন করা হয়েছে। তারা এটা লুকোতে চায়। কুডানকুলাম ১ ও ২ নং চুল্লি যে বিফল হয়েছে, এটা আমরা সেখানকার কর্মরত শ্রমিকদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি।

প্রথমত, তারা কোনোরকম ইন্সপেকশন বা তদন্ত না করে তাড়াহুড়ো করে কমিশনংয়ের মাধ্যমে প্রজেক্টটা চালু করতে গেছে। এখন আর ইনস্টলেশন বা পার্টসগুলো পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ নেই, কারণ ইতিমধ্যে চুল্লি অ্যাক্টিভেট করা হয়ে গেছে। সন্দেহ করা যায় যে কংগ্রেসের লোকজন কমনওয়েলথ গেমস ইত্যাদির মতো কুডানকুলাম প্রজেক্ট থেকেও প্রচুর চুরি করেছে। এখন ধীরে ধীরে তারা স্বীকার করতে শুরু করেছে যে চুল্লি দুটোর যন্ত্রাংশ নিয়ে সমস্যা রয়েছে। তারা এখন বলছে, অনেক দুর্নীতি এবং অনিয়ম হয়েছে। তারা রাশিয়ার একটা কলঙ্কিত কোম্পানি জিওপোডোলস্ক থেকে যন্ত্রাংশ কিনেছিল। প্রথমে অস্বীকার করলেও এখন তারা বলছে, হ্যাঁ আমরা জিওপোডোলস্ক থেকে কিছু যন্ত্রাংশ কিনেছি। ডিএই থেকে জনৈক এ পি জোশী সেন্ট পিটার্সবুর্গে গিয়ে জিওপোডোলস্ক-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করেন। আমরা ডিএই এবং এনপিসিআইএল-এর কাছে আরটিআই করার পর তারা এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। জিওপোডলস্ক নিচু মানের স্টিল কম দামে উঁচু দর দেখিয়ে কেনে এবং সেই স্টিল দিয়ে যন্ত্রাংশ তৈরি করে। এদের প্রকিওরমেন্ট ডাইরেক্টরের জেলও হয়েছে।

কয়েক সপ্তাহ আগে ডিএই-র প্রধান রতন কুমার সিন্‌হা স্বীকার করেন, তারা কুডানকুলামের টারবাইনের যন্ত্রাংশের কিছু পরিবর্তন করছেন। রোসাটম সেই টারবাইন বানিয়েছিল। রোসাটমের টারবাইন নিয়ে চীনের তিয়ানওয়ান চুল্লিতে সমস্যা হয়েছে। তারা ইরানের বুশহর-এ চুল্লি বানিয়েছিল। চীনারা অবশ্য রাশিয়ান কোম্পানিকে সেই টারবাইন বদল করে দিতে বাধ্য করে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ডিএই, এনপিসিআইএল, রোসাটম, কংগ্রেস, বিজেপি, রাশিয়ান সরকার, ভারত সরকার সকলে ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে চাইছে। সকলেই এই প্রজেক্ট থেকে হাতিয়ে নিয়েছে।
ক্রমশঃ