রঞ্জন, বেলঘরিয়া, ১৩ আগস্ট#
মাওবাদী তকমায় ডাক্তার বিনায়ক সেওনকেও রাষ্ট্র জেল খাটিয়েছে। গত প্রায় তিনদশকএর কাছাকাছি সময় ধরে এ দেশের কেন্দ্রীয় বা বিভিন্ন রাজ্যসরকারগুলো সামাজিক কিংবা সরাসরি রাজনৈতিক আন্দোলনে বা প্রতিবাদে উদ্যোগী উদ্যমী বহু মানুষকেই একইরকম কানুন ও কৌশলে দমন করার একটার পর একটা নজির গড়েই ফেলেছে। তা সে সব মানুষের পায়ে দলীয় রাজনীতির ছাপ থাক কিংবা না-ই থাক।
এমনটাই যখন চলছে চলবে এবং বাড়বে আর সরকারের সঙ্গে সহযোগী প্রশাসন — নানান সুযোগলোভী প্রচার-মাধ্যম হিসেব কষে তালবাদ্য বাজিয়ে যাবে তখন গলা খুলে কথা বলার সাহসে না কুলোলেও মন বুঝ মানছে কই? সে প্রশ্ন করছেই — একেই কি বলে গণতন্ত্র?
মাত্র ক’দিন হল চূড়ান্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার উত্তরাখন্ডের মৃত্যুপুরী থেকে ফিরে এসেছে — হিমাদ্রি ভট্টাচার্য, বলা যায় ফিরে আসতে পেরেছে। হিমাদ্রির বাড়ি — বেলঘরিয়ায় ও ওখানে ওর মধ্যেই কিছু অনুভবী তরতাজা যুবকের সঙ্গে গিয়েছিল — যাদের বেশিরভাগই চিকিৎসক। ওরা ওখানে নিয়ে গেছিল — মানুষের কাছে ঘুরে ঘুরে হাত পেতে সংগ্রহ করা টাকাপয়সা, কম্বল ওষুধ, মোমবাতি, দেশলাই এই রকম কিছু ত্রাণসামগ্রী।
টানা দিন আটেক ধরে দুর্গম বিধ্বস্ত পাহড়ে পাহাড়ে হেঁটে হেঁটে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ওরা ওই ত্রাণসামগ্রী নিঃস্ব নিরন্ন মানসিক শারীরিক আঘাতে চূড়ান্ত বিপর্যস্ত মানুষেরহাতে হাতেই পৌঁছে দিয়েছে, সঙ্গের চিকিৎসকরা যতখানি পারে ততটাই চালিয়ে গেছে চিকিৎসাও। মানুষগুলো এমন নিদারুণ দুরাবস্থাতেও ওদের ভূমিকায় খুশি এতটাই যে, ওরা ওখান থেকে চলে আসার আগের রাতে — ঘুরে ঘুরে ডেকেই সকলকে খাইয়েছেন রাতের খাবার।
বেলঘরিয়াবাসী এই হিমাদ্রি ভট্টাচার্য আর ওর বন্ধু মৃণাল জানাকেই কিন্তু উত্তরাখন্ডে রওনা হবার কয়েকদিন আগে একেবারে আচমকাই — বেলঘরিয়া স্টেশন এলাকার একটি চা-দোকান থেকে থানায় তুলে নিয়ে গেল — পুলিশ, কোনোরকম নোটিশই ছিল না — উদ্দেশ্য — জিজ্ঞাসাবাদ।
সে-ই জিজ্ঞাসাবাদ মেয়াদ ছিল দু-ঘন্টার বেশি এবং তা চলাকালীন ভারপ্রাপ্ত আই.সি. ওদের সামনেই বলে বসলেন — “আপনাদের তো চিনি” …….”কীভাবে?”
“আমি তো বেলঘরিয়া জি.আর.পি.তেই ছিল। আপনারা প্রায়ই কতরকম নিয়ে আসতেন …..আপনাদের এভাবে নিয়ে আসতে হল …… কী করব, আমাদের ওপর চাপ রয়েছে …। ইত্যাদি।
পুলিশ-প্রশাসনই বা কেন? বেলঘরিয়ার বহু বাসিন্দা এলাকায় যাঁদের কিছুটাও নিয়মিত যাতায়েত করেন — ছাত্র যুবক-বয়স্ক বেকার মানুষ অন্তত কিছুটাও সেখানে গল্পানুভাবে সময় কাটান কিংবা নানান পেশা বা ব্যবসা করেন সংশ্লিষ্ট এলাকায় — বেশিরভাগই চেনেন — মৃণালকে, হিমাদ্রিকে। যেহেতু গত প্রায় দু-দশকেরও বেশি সময় ধরেই সমাজের নানানস্তরের দুস্থ-পীড়িত মানুষের সংকটে নানাভাবে পাশে দা৬ড়ানো — নাটক, গান, সাহিত্যের চর্চা — নিয়মিত রক্তদান শিবির চালানো থেকে সিঙ্গুর – নন্দীগ্রামের মানুষের সংগ্রামই হোক কিংবা কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, হাল আমলে ঘটে যাওয়া — নোনাডাঙার বস্তি উচ্ছেদ, দিল্লি বা কামদুনির ধর্ষণ কান্ডের প্রতিবাদে কখনও এলাকাতেই কখনো আবার একেবারে আন্দোলনের জমিতেই লড়াকু মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যেতে কে না দেখেছে ওদের?
ব্যক্তিগতভাবে মজদুর ক্রন্তি পরিষদ (MKP) নামের শ্রমজীবীদের একটা গণ-রাজনোইতিক সংগঠনে যুক্ত থেকেই কাজ করে গেছে ওরা। মৃণাল জানা পেশাগতভাবে Telemedia-র সাংবাদিক, তথ্যচিত্রও তৈরি করেছে।
এ হেন সুপরিচিত সমাজকর্মী দু-জন মানুষকেই এতগুলো বছর ধরে জানাশোনাদেখার পরও পুলিশ পাঠিয়ে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হচ্ছে কোন চাপের কারণে? কারাই বা কীভাবে সেই চাপ দিচ্ছে?
একেবারেই হালে চাপটা তৈরি হওয়ার শুরু — রাজ্যের পরিবহনমন্ত্রী মদন মিত্র-র সাম্প্রতিক কিছু উক্তি থেকেই — আর সেই চাপটা হিমাদ্রি বা মৃণালের মতো মানুষদের ওপরেই নয়, এসে পড়েছে সবরকম বেলঘরিয়াবাসীর ওপরেই — তা তিনি প্রতিবাদী হোন আর না-ই হোন। মেসের বাসিন্দা — ছাত্রযুব, স্টেশন চত্বরে সান্ধ্য আড্ডায় মজে থাকা লোকজন, দোকানদার, চা- দোকানী একটা ভয় উঁকি মারতে শুরু করল তার পরপরই, সবার মনেই। যেহেতু মুখ খুলেছেন মন্ত্রী — আর তা, এইভাবে — বেলঘরিয়াতে মাওবাদীরা ঢুকে পড়েছে — তারা ঘাঁটি গেড়েছে …. মেসগুলোতে কারা থাকে? কী পরিচয় তাদের? স্টেশন চত্বরে চা-দোকাঙ্গুলো মাওবাদীরা আসে – যায় — যোগাযোগ করে। প্রাক্তন নকশালদের মদতেই এ সব বেড়ে উঠেছে, ইত্যাদি ….। সব খবরই মন্ত্রীর নিজস্ব সোর্স থেকে জানা আর পুলিশকে তা জানানো হলেও … তারা ব্যবস্থা নেয়নি। অতএব এসব বন্ধ করতে এলাকায় জনগণকে নিয়ে সন্ত্রাস বিরোধী কমিটি বানাতে হবে, মেস-কর্তাদের বাসিন্দাদের সমস্ত পরিচয় জেনে নিতে হবে … ইত্যাদি দাওয়াইও ঘোষণা করে দিলেন তিনি।
মন্ত্রীর প্রকাশিত উক্তিগুলোর পরপরই যথারীতি Telemedia-র আনাগোনাও শুরু –স্টেশন এলাকায় মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু — সবই আতংকে মাত্রা যোগাল। থমথমে হতে লাগল পরিবেশ — স্টেশন এলাকার চা-দোকানে বিক্রিটাও কমতে লাগল। মেসবাসী ছাত্রদের মনেও আতংক বাড়ল — মালিকরাও ভয় পেলেন মন্ত্রীর ফতোয়ায়। যদিও মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে নির্দ্ধিধায় প্রায় প্রত্যেকেই জানিয়েছেন যে এ এতাবৎ এমন কোনোরকম ঘটানাতো ঘটেইনি বা কোনোরকম অস্বস্তিই তাঁরা অনুভবও করেননি যা কিনা সাক্ষ্য দেয় ‘ মাওবাদী’ দের উপস্থিতির — বস্তুতই এটা তাঁদের কাছে কষ্ট কল্পনা মাত্র।
শান্ত বেলঘরিয়াতে অতএব মাওবাদের জুজু দেখিয়ে চাপ, ত্রাস ছড়ালেন কে? পরিবহন মন্ত্রী স্বয়ং।
তাঁর ওইসব বিবৃতির পরপরই — শাসকদলের সমর্থক কোন কোন সংগঠনের পক্ষে — হিমাদ্রি ভট্টাচার্য, মৃণাল জানারা কে কোথায় থাকে, তাদের ফোন নম্বর কই, এইরকম খোঁজ খবর নেওয়া শুরু হয়ে যায়। খুব হালফিলেই কামদুনিতে ধর্ষণকান্ডের প্রতিবাদে বেলঘরিয়াতে মিছিল সংগঠিত হয় তেমনই সরাসরি কামদুনিতে পৌঁছনোর পরপরই একটি সংবাদ মাধ্যম এবং টেলিমিডিয়াতেও মৃণাল-হিমাদ্রিদের বহিরাগত ও সম্ভাব্য মাওবাদী বলে চিহ্নিত করেই প্রচার শুরু করে দিয়েছিল।
এত তাড়াতাড়িই ভুলে যাবার উপায় নেই যে মাত্র বছরখানেকের কিছু বেশি সময় আগেই ইস্টার্ন বাইপাসের ধারে নোনাডাঙায় বস্তি-উচ্ছেদে প্রতিবাদে সাধারণ বাসিন্দারা যে আন্দোলন শুরু করেন — তাতে এরা দুজনেই এবং বেলঘরিয়ার বাসিন্দা আরও কয়েকজনও গ্রেপ্তার হন –১৮ দিন জেলও খাটেন — ঐ সময়ে একাংশ মিডিয়াও তাদের মাওবাদী বলেই চিহ্নিত কওরা তো বটেই, প্রশাসনও তারা ওখানে বিপুল অস্ত্র মজুত করেছে ও হামলায় ছক কষেছে এ জাতীয় অভযোগও তুলে আদালতে এদের বিচার চেয়ে বসে। এমন অভিযোগের ভিত্তিতেই নকশালদমন সেল এস।টী।এফও তদন্তে নামে — এদের সম্পর্কে এবং ক্রাইম সেকশনে শারতীরিক পরিচয় রেকর্ডিংও কওরা হয়। কিছুই শেষপর্যন্ত সপ্রমাণ কওরা সম্বব হয় না এবং পুলিশের প্রতিহিংসাপ্রবণ আচরণের নিন্দা কওরেই বিচারপতি জামিন মঞ্জুর করেন।
ধারাবাহিক এইসব সরকারি আক্রামণ কী দেখাচ্ছে? পুরনো বামজামানার মতোই নতুন সরকারও কোনোরকম বিরোধিতার ভাষা শুনতেই নারাজ — ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাই সেসব চুপ করিয়ে দেবার নানান কৌশলেরা একটা বড়ো ব্রহ্মাস্ত্র — মাওভূতের আমদানি — আপাতত সে প্রেচেষ্টার ধারাবাহিকতায় তাঁদের destination? বেলঘরিয়া।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নইয়ে যাচ্ছেন, তবে কোনরকম আগাম জানানো নেই কেন?”
মৃণালের প্রশ্নে — পুলিশকর্মীদের উত্তর — “বড়বাবু ডেকেছেন আপনাদের থানায় যেতে হবে,” ব্যস।
ভ্যানে তোলার পর মোবাইল ফোন কেরে নেয় তারা — এ নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করতেই পুলিশোচিত ভাষায় গালিগালাজও করে।
“জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আগাম জানানোর তো কোন রীতি নেই, এভাবেই আনা হয় —- জেনে নিন পুলিশ বা পাবে বা না পাবে ” বলে আমাদের সামনে একটা ঢাউস মোটা আইনের বই এগিয়ে দেন বেলঘরিয়া থানার IC যে কোন লোককেই ডাকতে পারি এমনভাবে — আমার বিরুদ্ধেও কোন অভিযোগ তুললেও এমনটাই হবে” আরও বিস্তারিত করেন IC
অভিযোগটা কী ওদের বিরুদ্ধে?
IC-র “ওদের বিরুদ্ধে mass petition জমা পড়েছে। mass petition? কারা করল? IC জানালেন তাদেরই নিরাপত্তার খাতিরেই সেটাও তিনি বলতে পারবেন না –“তাদের নিরাপত্তার দায় নেবে কে? আপনারা নেবেন? ইত্যাদি এই কথাবার্তা চলাকালীন আমরা MKP, APDR, KNS ও কিছু সাধারণ নাগরিক জানতে চাইলাম “কিন্তু কোন অভিযোগে ওদের বিরুদ্ধে petition?
ICর উত্তর — illegal activities-এর”
illegal কোন কোন activity?”
investigation এখন চলছে —- অতএব বলা যাবে না এটাও — আমাদের জানার অধিকার থাকতেই পারে, তবে বলার উপায় নেই তাঁর — “জানতে হলে আদালতে যেতে হবে”‘ ইত্যাদি —
investigation চলবে — এটাই শেষ নওয়, আবারও ডাকা হতে পারে —– পিটিশন এ নাকি মোট ৮ জনের নাম আছে —- এমন কথাওজানালেন IC।
ওদিকে দু’ঘন্টারও বেশি সময় ধরে চলা জিজ্ঞাসাবাদের পর্বে হিমাদ্রি ও মৃণালকে প্রথমে 2nd Officer ও IC নিজে তারপর ব্যারাকপুর কমিশনারেট থেকে আসা ACP ও DCP, আবার দুজন IB অফিসারও জেরা করেন। জেরায় মামুলি তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি ওদের রাজনৈতিক অবস্থানের কোথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানতে চাওয়া হয়। জেরা চলাকালীন IBর -একজন বলে উঠলেন, “আপনারা তো এর মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুরে একটা স্মরণ সভায় যোগ দিতে গেছিলেন না? IB মশাই-র খবর মিথ্যে নয়। মৃণালের সদ্য প্রয়াতা মায়ের স্মরণ সভাতেই যোগদিতে গিয়েছিল ওরা। দেখাই যাচ্ছে প্রশাসনের তরফে কী রকম কড়ামাত্রার নজরদারই চালু রয়েছে — বেলঘরিয়াবাসী সামাজিক বা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় মানুষজনের ওপর।
এতসবের পরেও পরিবহন মন্ত্রী এভাবে আচমকা থানায় তুলে আনা তো বতেই ফোন কেরে নেওয়া, গালিগালাজ প্রভৃতি পুলিশি আচরণও যথাযথই হয়েছে বলে সাফাই গেয়েছেন জনপ্রতিনিধি নয় বরং শাসকের স্বভাবেচিত ভঙ্গিতেই।
Leave a Reply