জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু থেকেই নোনাডাঙায় উচ্ছেদ হয়ে ফের ঘর বানিয়ে থাকা বস্তিবাসীদের টিঁকে থাকার লড়াই এক নতুন জটিলতার মুখোমুখি হয়েছে। বর্ষা আসছে, অথচ গোটা মাঠটি ঘিরে ফেলা হয়েছে পাঁচিল দিয়ে। পাঁচিল গভীর এবং তাতে জল বেরোনোর জায়গা নেই। তাই মজদুর পল্লী ও শ্রমিক কলোনির মানুষদের আশঙ্কা, বর্ষাকালে এই মাঠের মধ্যে থাকা যাবে কী করে?
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো এই মাঠের মধ্যেই বসানো হয়েছে এক বিশাল পুলিশ তাঁবু — মজদুর পল্লি এবং শ্রমিক কলোনির মাঝখানে। সারাক্ষণ বস্তিবাসীদের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে পুলিশ, যারা কিছুদিন আগে মারধোর করে দশজন বস্তিবাসীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
১৫ জুন নোনাডাঙা মাঠে গিয়ে বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেল, তা নিম্নরূপ : ১৩ জুন রাতে দুই কলোনির চার-পাঁচজন প্রতিনিধির সঙ্গে ১০৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলার স্বরূপ ঘোষ কথা বলতে চান। উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির পরামর্শক্রমে পঁচাশি জনের একটি তালিকা, তাদের পুনর্বাসন দেবার আর্জি নিয়ে পাঁচজন প্রতিনিধি কাউন্সিলারের সঙ্গে দেখা করতে যায়। কাউন্সিলার জানায়, দশদিনের মধ্যে মাঠটি ফাঁকা করে দিতে হবে। বাইপাসের কাছাকাছি সুভাষপল্লি বস্তির পাশে টিনের ঘরে তাদের আপাতত থাকতে হবে। তিনমাসের মধ্যে পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করা হবে তাদের। পরে ১৪ জুন সন্ধ্যেবেলা নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম নিজে নোনাডাঙার মাঠে এসে বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনিও ওই একই প্রস্তাব দেন। তবে তালিকার মধ্যে থেকে যাদের নিকট আত্মীয়দের এরই মধ্যে ফ্ল্যাট আছে নোনাডাঙায়, তারা বাদ যাবে, সেকথাও জানানো হয়। সেই সঙ্গেই শর্ত দেওয়া হয় মন্ত্রী এবং কাউন্সিলারের তরফে : বহিরাগত উচ্ছেদবিরোধী কর্মীদের নোনাডাঙায় ঢুকতে দেওয়া যাবে না। ‘উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’র ব্যানার খুলে ফেলে শাসকদলের ব্যানার লাগাতে হবে। ১৫ এবং ১৬ জুন শাসক দল এবং সরকারের যে অনুষ্ঠান আছে নোনাডাঙায়, তাতে যোগ দিতে হবে মিছিল করে। মন্ত্রী যখন বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন, তখন কোনো মিডিয়া বা ক্যামেরাধারী কেউই উপস্থিত ছিল না।
এই প্রস্তাব দেওয়ার সময় বস্তিবাসীদের মধ্যে থেকে একজন প্রশ্ন করেন, একটু লিখিত দিলে হয় না? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসে, মন্ত্রী নিজের মুখে বলছে, তার ওপর আবার লিখিত চাই? ‘উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’ তখন মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয়, পরদিন ১৫ জুন মিছিল করে সল্টলেকের কেএমডিএ-র (যাদের নির্দেশেই উচ্ছেদ হয়েছিল) অফিসে যাবে এবং সেখানে বলবে, মন্ত্রী যেন এসব কথা সমস্ত মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, এবং তারা শর্তহীন পুনর্বাসন চান।
১৫ জুন শুক্রবার সকাল থেকেই নোনাডাঙার মাঠ ঘিরে ফেলে বেশ কিছু বহিরাগত যুবক। অভিযোগ, তারা শাসক দলের আশ্রিত। কেউ কেউ এসে বস্তিবাসীদের ওপর চড়াও হয়। মারধোর করা হয় বস্তিবাসীদের আন্দোলনের স্থানীয় নেতা বাপি মণ্ডল এবং উচ্ছেদ বিরোধী কর্মীদের। এমনকী বস্তিবাসী যুবক ও মহিলারাও এই মারধোরের হাত থেকে রেহাই পায়নি। একই সঙ্গে বাইরে থেকে কেউ মাঠে ঢুকতে গেলে, পাঁচিলের ফাঁক আগলে সেখানে বাধা দিতে থাকে শাসক দলের আশ্রিত এই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী। এই মারধোরের ঘটনা ঘটে পুলিশ ক্যাম্পে উপস্থিত পুলিশ বাহিনীর সামনে। সাময়িক হতভম্ব দশা কাটিয়ে উঠে বস্তির মহিলারা তেড়ে গেলে ওই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী পালিয়ে যায় মাঠ থেকে। কিন্তু পাঁচিল ঘিরে থাকে তারা। বাইরে থেকে কেউ ঢুকতে গেলে আগ্রাসীভাবে বাধা দিতে থাকে। আমাদের কাগজের প্রতিনিধি শ্রীমান চক্রবর্তী মাঠের মধ্যে ঢুকতে গেলে তাঁকে বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ওই ঠ্যাঙাড়েরা। সাংবাদিক পরিচয়কে আমলই দেয়নি তারা। পরে তিলজলা থানায় অভিযোগ জানানো হয় ‘সংবাদমন্থন’-এর পক্ষ থেকে।
এই আক্রমণে প্রতিরোধ কমিটির কেএমডিএ অফিসে মিছিল করে যাওয়ার পরিকল্পনাও বাতিল হয়ে যায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নোনাডাঙার মাঠ ঘিরে উত্তেজক পরিস্থিতি রয়েছে।
শমীক সরকার, নোনাডাঙা, ১৫ জুন। মাঠের মধ্যে আশঙ্কিত বস্তিবাসীদের ছবি ১৫ জুন দুপুরে প্রতিবেদকের তোলা
Leave a Reply