- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

পূর্বতন ছিটমহল মশালডাঙা থেকে : অতীতের কথা ১

জয়নাল আবেদিন, মশালডাঙ্গা, কোচবিহার, ২১শে আগষ্ট ২০১৫#

পূর্বতন মশালডাঙা ছিটের অধিবাসীরা। ছবি সোমনাথ চৌধুরি।
পূর্বতন মশালডাঙা ছিটের অধিবাসীরা। ছবি জয়নাল আবেদিন।

১৯৪৭ এর দেশভাগে ছিটমহলের অস্তিত্ত্ব ছিল, কিন্তু জীবন এরকম জটিল ও সঙ্কটাপন্ন ছিল না। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা মহাম্মদ আলি জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতবর্ষকে দ্বিখন্ডিত করে পাকিস্তান নামক একটি কৃত্তিম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। জন্মলগ্ন থেকেই এই দুই দেশ বার বার সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়ে পরে,  আর তাতে  সবচেয়ে বেশী বিপর্যস্ত হয় ছিটমহলের বাসিন্দাদের জীবন ও জীবিকা।
গত ২০১০ সালে ২৮শে মার্চ মধ্যমশালডাঙ্গা ছিটের সন্তানসম্ভবা গৃহবধূ আসমা বিবিকে ১৯ কিমি দূরে দিনহাটা হাসপাতালে আনা হয়। আসমা নিজের ছিটের ঠিকানা এবং স্বামী শাহাজাহান শেখের নাম লিখিয়েই হাসপাতালে ভর্তি হতে চান।  সেখানেই সমস্যা শুরু হয়। হাসপাতাল কত্তৃপক্ষের বক্তব্য ছিল যে ছিটের ঠিকানা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যাবে না ।ভর্তি হতে গেলে আগে পুলিশে জানাতে হবে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মশালডাঙ্গা ছিটের অন্যতম নেতা বেল্লাল হোসেন এবং ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির অন্যতম নেতা শ্রীদীপ্তিমান সেনগুপ্ত। এখানেই প্রতিবাদ করে ওঠেন দীপ্তিমান। জানিয়ে দেন যে আসন্নপ্রসবাকে অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেপ্তার করা হলে পরদিন ছিটের কয়েক হাজার মানুষ এসে জেলাশাসককে ঘেরাও করবেন। প্রশাসন থেকে কোলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। প্রসবের সময় এগিয়ে আসতে থাকে। আসমাকে ছিটের ঠিকানায় ও স্বামীর নামে ভর্তি করা হয়। সন্ধ্যে ৬টায় ভর্তির দুই ঘন্টা পর আসমা সন্তানের জন্ম দেন। ঘটনাটি ছিটমহলবাসীদের আশান্বিত করে তোলে। সমস্বয় কমিটি ছিটমহলবাসীদের অবলম্বন হয়ে ওঠে। এই প্রথম তাঁদের মধ্যে লড়াইয়ের  অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন ছিটমহলবাসীরা।
এরপর আর একটি ঘটনার কথা বলি,  আজ থেকে ৯ বছর আগে আঙ্কেশ আলি মন্ডল, হাসেম শেখ, জব্বার শেখ, আমির হোসেন এবং আবুল হসেন কাজের খোঁজে দিল্লি যাচ্ছিলেন। ছিট থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে নাজিরহাট হাসপাতাল মোরে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী তাঁদের আটক করে। অনুপ্রবেশের দায়ে তাঁদের সাজা হয় ২ বছর ৩ মাস। কিন্তু ৪ বছর কেটে গেলেও তাঁরা মুক্তি পাননি। । ২৬শে জুন ২০১১ দিনহাটা শালমারা ভারতীয় সড়কের উপর মশালডাঙ্গায় ৮ হাজার ছিটমহলবাসী ৪৮ ঘণ্টার অনশন শুরু করেন। দাবি ছিল সন্ধ্যার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ার পরেই দিনহাটা জেলে বন্দী পাঁচজন ছিটমহলবাসীর বিনাশর্তে মুক্তি এবং তাঁদের ছিটমহলে ঢোকার অনুমতি দিতে হবে। আর দ্বিতীয় দাবী ছিল ছিটমহল সমস্যার সমাধান যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে। সমন্বয় কমিটির ডাকে অনশনের দ্বিতীয় দিন সরকারী অফিসার ছুটে আসেন। অনুরোধ করেন অনশন তুলে নিতে। সরকারী প্রতিনিধীকে সমন্বয় কমিটির পক্ষে মিঃ সেনগুপ্ত বলেন যে শুধু মুক্তি দেওয়া নয়, মুক্তির পর বাংলাদেশে পুশ-ব্যাক করা চলবে না, ফেরত দিতে হবে ছিটমহলে। কারন পুশ-ব্যাক করলে তাদের ঢোকানো হবে বাংলাদেশের জেলে। দাবি না মানা হলে এরপর ঘের হবেন জেলাশাসক। জয়নাল আবেদিন বলেন পাঁচজনকে ২০১১ সালে ১৫ই আগষ্ট ছিটে এনে মুক্ত করে দিয়ে গেছে পুলিশ –বি.এস.এফ.। এই প্রথম ভারতের জেল খেটে কেউ সরাসরি ছিটে ঢুক্তে পারল। এই দুই ঘটনায় ছিটমহলবাসীরা নিজেদের অধিকার আদায়ের প্রেরনা খুঁজে পান এবং ছিটমহল সমস্যার সমাধান এবং অন্যান্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলনে নামেন।

আমরা আগে সন্ধ্যা নামলেই ঘরে ঢুকতাম, এখন সমন্বয় কমিটির কাজ নিয়ে সন্ধ্যেবেলা বসি। বিভিন্ন উন্নয়নের পরিকল্পনা করি। কারন এখন আমাদের সবকিছু প্রথম থেকে গড়ে তুলতে হবে, কাজেই এই কাজে কোনও আলসেমির জায়গা নেই, সন্তুষ্টির জায়গা নেই। আমরা এককাট্টা হওয়ার পর ভারতের বিভিন্ন হাটে বাজারেও আমাদের উপর অত্যাচার কমে গিয়েছিল। ১৯৯৪ সালে দীঁপক সেনগুপ্তের নেতৃত্বে সমন্বয় কমিটির প্রতিষ্ঠা। এর প্রকাশ্য কার্য্যকলাপ দেখা যায় ২০০৪ সাল থেকে। কমিটির সম্পাদক প্রক্তন বিধায়ক সৌমেন দাস। ভারত ও বাংলাদেশের দুই অংশের সহ সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত ও বাংলাদেশ কুড়িগ্রামের গোলাম মোস্তাফা। তাঁরাই এখন ছিটমহলবাসীর ভরসা। তাঁদের নেতৃত্বেই মুখ খুলেছে অসংখ্য দেশহীন মানুষের রুদ্ধকন্ঠ।