কুশল বসু, কলকাতা, ১৫ ডিসেম্বর#
২০১১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে জনপ্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে মুবারক জমানার পতনের পর থেকে এক সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে চলছে মিশর। মুবারকের পতনের পর প্রথমে ক্ষমতা হাতে নিয়েছিল সামরিক বাহিনী। বিপ্লব হয়েছে, জমানা বদলাচ্ছে। নতুন সংবিধান লেখা হবে, কিন্তু সন্ধিক্ষণ পর্ব পেরোনোর জন্যই দরকার পুরোনো মুবারক জমানার সংবিধানের বদল, কারণ সেখানে নতুন কোনো রাজনৈতিক দল তৈরি করার মতো ন্যুনতম গণতান্ত্রিক অধিকারটুকুও নেই। তাই সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানেই একটি ‘সন্ধিক্ষণের সংবিধান’ গণভোটে ৭৭ শতাংশ সমর্থন পেয়ে লাগু হয়। কিন্তু সামরিক বাহিনী মিশরে আসন গেঁড়ে বসায় বিপ্লবের জনতা ফিরে আসে কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে। ১ এপ্রিল থেকে তাহরির স্কোয়ারে ‘বিপ্লব বাঁচাও’ জনবিক্ষোভ শুরু হয়। অবশেষে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় আসে ইসলাম ঘেঁষা সংগঠন ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর তৈরি করা নয়া রাজনৈতিক দল ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’-র নেতৃত্বের জোট। দ্বিতীয় স্থানে ছিল মৌলবাদী ইসলামপন্থী ণ্ণসালাফি’-দের রাজনৈতিক সংগঠনের জোট। তারও অনেক পেছনে ছিল সেকুলারপন্থী ও বামপন্থীরা। ৩১ মে মুবারক জমানার রাষ্ট্রীয় শাসনের প্রতীক, জরুরি অবস্থা উঠে যায়। একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পথ পেরিয়ে গণতান্ত্রিক মিশর উঁকি দেয়। নয়া সংবিধান লেখার কাজ চলতে থাকে।
২৯ নভেম্বর নয়া সংবিধান লেখার কাজ শেষ হয়। এতে একনায়কতন্ত্রের বদলে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র, যথেচ্ছ গ্রেপ্তারি ও লকআপে অত্যাচার এবং বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা থেকে জনগণের সুরক্ষার অধিকারের কথা আছে। মিশরীয় পরিবার প্রথা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তির অধিকারের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে। দেশের সংবিধান ইসলামিক শরিয়তি আইনের সুরে গাঁথা বলে বলা হয়েছে, মুবারক জমানাতেও এটা ছিল। ইসলাম, খ্রিস্ট এবং ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের (তিনটিরই উৎস আরবীয় আব্রাহাম ধর্ম) ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, বাকিদের নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং পয়গম্বরকে অপমান না করার কথা, দুটিই আছে সংবিধানে এবং এদের ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা করা হবে, সেকথা বলা নেই। মুবারক জমানার কুখ্যাত মিলিটারি কোর্টে অসামরিক নাগরিকদের বিচারের ধারাটিও রয়েছে। নয়া সংবিধানে একা মা, বিবাহ-বিচ্ছিন্ন মহিলা এবং বিধবাদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা ও বন্দোবস্তের কথা বলা আছে। রাষ্ট্রের তরফে মাতৃত্ব এবং শিশু মানুষ করার নিখরচায় বন্দোবস্ত এবং মহিলাদের কর্মক্ষেত্র ও পরিবারের প্রতি যৌথ দায়বদ্ধতার বিষয়টি দেখাশোনা করার কথা বলা আছে। কিন্তু সাধারণভাবে সব মানুষ সমান একথা বলা থাকলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও মহিলাদের বিশেষ অধিকারের কথা বলা নেই।
২২ নভেম্বর মিশরের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট একটি ডিক্রি জারি করেন তাঁর জারি করা সমস্ত ডিক্রি বিচারব্যবস্থার ঊর্ধ্বে। এছাড়া নয়া সংবিধান নিয়ে ১৫ ডিসেম্বর গণভোট হবে সেকথাও জানান। ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় বিচারপতিদের মধ্যে। বিপ্লবের জনতা ফের রাস্তায় নামে ডিক্রির বিরুদ্ধে এবং নয়া সংবিধানের বিরুদ্ধে। কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে লক্ষাধিক জনতা জমায়েত করে। বিভিন্ন শহরে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির অফিস পোড়ানো হয়। সরকারের পক্ষেও বিশাল বিশাল মিছিল শুরু হয়। ৬ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনে সরকারের পক্ষে এবং বিপক্ষে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ৬ জন মারা যায় এবং সাড়ে ছশো জন আহত হয়। কায়রো ছাড়িয়ে এই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে আলেকজান্দ্রিয়ায়া, আসিয়ুত প্রভৃতি শহরে। আসিয়ুতে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেয়, ণ্ণব্রাদারহুড নয়, সালাফি নয়, মিশর নাগরিক রাষ্ট্র’। ৮ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টের ডিক্রিটি প্রত্যাহৃত হয়। ব্যাপক জনবিক্ষোভের মধ্যেই নয়া সংবিধান নিয়ে গণভোট শুরু হয় ১৫ ডিসেম্বর। এতে ব্যাপক ভোট পড়ে।
Leave a Reply