আজ থেকে সাঁইত্রিশ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতবাসীর ওপর কুখ্যাত জরুরি অবস্থা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। কিছু মানুষ খুব খুশি হয়েছিল, আমলারা অফিসে আসছিল ঠিক সময়, দোকানিরা দামের তালিকা টাঙিয়ে রাখছিল দোকানের বাইরে, ঠিক সময়ে ট্রেন চলছিল ইত্যাদি কারণে। কিন্তু অনেক মানুষ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা ও ক্ষমতা খর্বিত হওয়ার কারণে। আমি তখন ১৫ বছরের বালক, বাবার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়েছিলাম (বাবা ছিলেন ডিএমকে পার্টির কর্মী)। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, জড়ো হওয়ার স্বাধীনতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ভয়ের থেকে মুক্তি ছিল না সে সময়। লোকে তাদের কথা মন খুলে বলতে পারত না। খবরের কাগজে সেনসরশিপের কারণে সাদা পাতা বেরোত। সমাজে সন্দেহ আর ভয়ের একটা পাতলা আবরণ পড়ে গিয়েছিল। এটি সেই ভারত ছিল না, যাকে ভালোবেসে আমি বড়ো হয়েছি। আমি আমার ভয়ঙ্করতম দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি, সাঁইত্রিশ বছর পরে আমি আবার একইরকম নীরব জরুরি অবস্থার মধ্যে পড়ব।
আজ ইদিনথাকারাই গ্রামে আমার আর পুষ্পরায়নের স্বেচ্ছা নির্বাসনের ১০০ দিন। ১৮ মার্চ ২০১২ বিকেল চারটে পঁয়তাল্লিশে তিরুনেলভেল্লি জেলাশাসকের পিএ আমাকে এবং ইদিনথাকারাই চার্চের ফাদার জয়কুমারকে বলেন, জেলাশাসকের অফিসে গিয়ে দেখা করতে পরদিন সকাল দশটায়। জেলাশাসক সেলভারাজ নিজেই রাতে এবং পরদিন সকালে আমায় ফোন করে বলেন, তাঁর অফিসে গিয়ে দেখা করতে। আমি বুঝতে পারি, ডাকাডাকি করা হচ্ছে আমাদের সবাইকে গ্রেফতার করার জন্য। ঠিক তাই, কুদানকুলাম, কুট্টাপুলি, চেট্টিকুলাম, এবং ইরোডে আমাদের ২০০ বন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। রায়ান এবং আমি আরও ১৩ জনের সঙ্গে অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশনে বসি, আমাদের বন্ধুদের আশু নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে। ১৯ মার্চ পুলিশ সুপার বিজয়েন্দ্র বিদারি আমার মোবাইলে ফোন করে আত্মসমর্পন করতে বলেন। আমি মোবাইল অন রেখেই উপস্থিত হাজার হাজার মানুষকে জিজ্ঞেস করি, আমি আত্মসমর্পন করব কিনা, তারা চিৎকার করে জানিয়ে দেয়, না। আমি পুলিশ সুপারকে বলি, বেশ কিছু পুলিশ ভ্যান পাঠানোর জন্য, যাতে সবাইকে ভ্যানে তোলা যায়। তিনি রেগে গিয়ে বলেন, এই শেষবার আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি, বলে তিনি ফোন রেখে দেন। আমরা মাঝেমাঝেই ফোনে কথা বলতাম, তাঁর মৌখিক সম্মতি নিতাম আমাদের সভা সমিতিগুলি করার জন্য। সেই ১৮ মার্চ থেকে আমি আর পুষ্পরায়ন এই ছোট্ট উপকূলের গ্রামটি ছাড়িনি (সমুদ্রপথে দু’বার কাছেই কুথেনকুঝি গ্রামে যাওয়া ছাড়া)। আশেপাশের গ্রামগুলির মানুষ আমাদের পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে সারাক্ষণ নজর রাখছে। তামিলনাড়ু সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে আমাদের এলাকায় খাবার, জল, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য জরুরি জিনিস যেমন শিশুখাদ্য, ফল, সবজি সরবরাহ বন্ধ করে রেখেছে। মায়েরা বাচ্চাদের চিনির জল খাওয়াচ্ছে। পোয়াতি মহিলারা হাসপাতালে যেতে পারছে না। পুরুষেরা গ্রামে ঢুকতে-বেরোতে পারছে না। আমাদের ঘিরে রেখেছে সারা তামিলনাড়ু থেকে জুটিয়ে আনা বিশাল পুলিশবাহিনী এবং আধাসেনা। এ অবস্থাকে আমরা বলি আর এক মুল্লিভাইকাল (জরুরি অবস্থা), সত্যি তাই।
পুষ্পরায়ন, জেসুরাজ এবং আমি গ্রেফতারি ও পুলিশি নিপীড়নকে ভয় পাই না। আমরা কেবল চাই না, আমাদের লড়াইটা তামিলনাড়ু সরকার, ভারত সরকার এবং তাদের গুপ্তচর সংস্থারা গুটিয়ে দিক। তাই আমরা ইদিনথাকারাই-এর বাইরে যাইনি। এই স্বেচ্ছা-নির্বাসন মধুর নয়। কিন্তু এই স্বেচ্ছা-নির্বাসনে আমাদের লাভ, আমরা আমাদের লড়াইকে জিইয়ে রাখতে পেরেছি, প্রচুর অনশন, জনসভা, প্রচার, পরিকল্পনা, মিটিং সহ অন্যান্য কাজের মধ্যে দিয়ে। এ পর্যন্ত ণ্ণপরমাণু শক্তি বিরোধী জন আন্দোলন’-এর নেতৃবৃন্দ এবং দক্ষিণ তামিলনাড়ুর সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ৩০০-র বেশি মিথ্যে মামলা দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের বিরুদ্ধে ১৭০টা এফআইআর করা হয়েছে। আমাদের এক বন্ধু এটা লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, সেপ্টেম্বর ২০১১ থেকে ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত ১০৯টা এফআইআর করা হয়েছে ৫৫,৭৯৫ জন মানুষ এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ২১টি ধারা দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে আছে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার ধারা (১২১), ৩৬০০ জনের বিরুদ্ধে। এবং দেশদ্রোহিতার ধারা (১২৪এ) দেওয়া হয়েছে ৩২০০ জনের বিরুদ্ধে। কুদানকুলাম থানা সম্ভবত সেই থানা, যেখানে সবচেয়ে বেশি দেশদ্রোহিতা এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মামলা লেখা হয়েছে সবচেয়ে কম সময়ে, ঔপনিবেশিক এবং স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে।
… আমার মনে পড়ে যাচ্ছে জরুরি অবস্থা এবং মিসা (আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুরক্ষা আইন)-র দিনগুলির কথা। হ্যাঁ, আজ দেশে চলছে নীরব জরুরি অবস্থা। রাষ্ট্র, যারা কিনা আমাদের দিকে আঙুল তুলে বলছে, আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি, তারাই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে জনগণের বিরুদ্ধে। আজকের ভারতে কোনটা দেশদ্রোহিতা? মনমোহন সিং সরকারের গাদা গাদা মন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত, কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এবং সুস্থভাবে বাঁচার কথা বলছি, তারাই নাকি দেশদ্রোহী!
মনমোহন সিং সরকার, স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বিতর্কিত সরকার, নোংরা খেলায় মেতেছে আমাদের লড়াই ও আন্দোলনকে দমন করার জন্য। ওরা আমাদের বিদেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগ করেছে, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মেলানোর অভিযোগ এনেছে, বিরোধী দলগুলির সঙ্গে চলার অভিযোগ এনেছে, ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছে। ওরা আমার স্কুলটাকে ভেঙেছে, বাচ্চাদের লাইব্রেরিটাকে ধ্বংস করেছে, বাচ্চাদের জলের ট্যাপগুলো নষ্ট করেছে, পরিবারের লোকজনকে হেনস্থা করেছে, সমস্ত ধরনের অমানবিক, বিভাজনকামী, অপরাধমূলক ব্যবহার করেছে। ভারত সরকার এবং ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি জনসমক্ষে কোনো ধরনের তথ্য দিতে অস্বীকার করছে, এবং তাদের নিজেদের স্বার্থে অসত্য, অর্ধসত্য, বিকৃত মন্তব্য করে চলেছে।
কুদানকুলাম পরমাণু চুল্লি বিরোধী আন্দোলনকে শেষ করে দেওয়ার সমস্ত ধরনের প্রচেষ্টার পর ভারত সরকার এখন বাঙ্গালোরের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ থেকে ডাক্তার এনে আমাদের মগজ ধোলাই করার বন্দোবস্ত করছে। সরকার দিনে দিনে অসুস্থ এবং নির্লজ্জের মতো ব্যবহার করছে। এই নীরব জরুরি অবস্থার পাশাপাশি একটা বলে-কয়ে জরুরি অবস্থাও চলছে দেশে — আমরা এমন একটা সরকার নিয়ে চলছি, যারা বিদেশি সরকারের জন্য কাজ করে, বিদেশি কোম্পানির জন্য, বিদেশি স্বার্থে কাজ করে। তারা এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতে পারে না, ‘সাধারণ ভারতবাসী’ নীতি বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করতে পারে, সেগুলো নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করতে পারে, অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে পারে। আমরা একটা জরুরি অবস্থাতেই রয়েছি।
এস পি উদয়কুমার, ২৬ জুন জরুরি অবস্থার দিন দক্ষিণ তামিলনাড়ুর কুদানকুলাম এলাকার ইদিনথাকারাই গ্রাম থেকে পাঠানো বার্তা থেকে নেওয়া
Leave a Reply