- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

ধূসর পট পুরানো আখর

তমাল ভৌমিক, ভবানীপুর, ১৩ আগস্ট#

বইয়ের নাম ‘ধূসর পট পুরানো আখর’, লেখকের নাম সন্দীপ বন্দোপাধ্যায়, প্রকাশনা সংস্থার নাম ণ্ণঋতাক্ষর’। ৯০ টাকা দামের আশি পাতার এই বইটায় কিছু ইলাস্ট্রেশনও আছে। ইলাস্ট্রেশনের ছবিগুলো ও প্রচ্ছদ বেশ সুন্দর করে এঁকেছেন বিশ্বরঞ্জন চক্রবর্তী। বইটাকে একধরনের স্মৃতিকথা বলা চলে। যদিও স্মৃতিকথায় আঁকা ছবির উপস্থিতি সাধারণত দেখা যায় না, তবু এই বইটায় ছবিগুলো দেখতে ভালোই লাগে।
বইয়ের শেষ অংশে লেখক সন্দীপের ভাষায় ‘আত্মজীবনী তো লিখতে চাইনি, পঞ্চাশ বছর আগে ভবানীপুর জায়গাটা কেমন ছিল, সেই সময় আর তার সঙ্গে একটা পরিবারের ভাঙ্গনকথা — খণ্ড খণ্ড স্মৃতি জুড়ে আঁকতে গিয়েছিলাম এইরকম একটা মানচিত্রই’। পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে সন্দীপের মানচিত্র ভালোই ফুটে উঠেছে।
স্মৃতিকথায় সময়ের মানচিত্রে এমন কিছু ছবি ফুটে ওঠে যা ইতিহাসের পটে অনেক সময় ধরা পড়ে না। যেমন ১৯৬২-র ভারত-চীন যুদ্ধের সময় এই পাড়ার চীনা দন্ত চিকিৎসক ডাক্তার চুং-এর কথা। ডাক্তার চুং-কে তখন পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ায় ৮-৯ বছরের সন্দীপের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কেন? উত্তর পাওয়া গিয়েছিল, ‘ওটাই নাকি রীতি। যে দেশের সঙ্গে যুদ্ধ হচ্ছে, সেই দেশের সঙ্গে কারো জাতিগত সম্পর্ক থাকলে তাকে নাকি আগেভাগেই গ্রেপ্তার করে নেওয়া হয়।’ এর বছর দুয়েক পরে সেই চীনা ডাক্তার ছাড়া পেয়ে ফিরে আসেন এবং তাঁর শরীর ও মন দুই-ই ভেঙে যাওয়ায় এর কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান। পরিণত সন্দীপ স্মৃতি থেকে এই ঘটনার উল্লেখ করে লিখছেন, ‘এখন যাকে অরুণাচল প্রদেশ বলা হয়, সেই সময় তার নাম ছিল নেফা — নর্থ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি। কোথায় কোন সুদূর নেফায় বরফের পাহাড়ে যুদ্ধ হল আর কলকাতায় একটা লোকের জীবন ধ্বংস হয়ে গেল। না, রণাঙ্গনে আমি যাইনি, তবে যুদ্ধ আমি দেখেছি।’
আর একটা ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ১৯৬৭ সালের কথা লিখছেন সন্দীপ, ণ্ণরাজনীতির দিক থেকে ভবানীপুর ছিল খুব গোলমেলে জায়গা। বামপন্থীদেরই দাপট, কিন্তু ভোটে জেতে কংগ্রেস। ১৯৬৭ সালেও কংগ্রেসই জিতেছিল। আমাদের সে কী দুঃখ। ওই বছরই বোধহয় লোকসভা নির্বাচনে আমাদের এলাকায় প্রার্থী ছিলেন গণেশ ঘোষ। চট্টগ্রাম বিপ্লবী। সেই সময় ণ্ণগণেশ ঘোষকে ভোট দিন’ লেখা পোস্টার আমি দেওয়ালে সেঁটেছি। মাস্টারদার সহযোদ্ধা গণেশ ঘোষ। খুব গর্ব হত মনে। ১৯৯০-৯১ সালে গণেশবাবু যখন অসুস্থ হয়ে এসএসকেএম হাসপাতালে উডবার্ন ওয়ার্ডে ছিলেন, আমি একদিন দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি তখন কানে একেবারে শুনতে পান না। ফলে কথা বিশেষ হয়নি। তবে আমি যে একসময় তাঁর হয়ে প্রচার করেছি — এই কথাটা বলতে গিয়েছিলাম জাঁক করে। গণেশবাবু ঠিকই শুনতে পেলেন; আর জিভ কেটে বললেন, ছি ছি বড়ো খারাপ কাজ করেছিলেন। … কেন তিনি ওই কথা বলেছিলেন, আন্দাজ করতে পারি। বামপন্থার হাল দেখে তাঁর মতো মানুষ তখনই বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।’
সময়ের চালচিত্রে রাজনীতির আঁচ আজ যেমন লেগেছে সন্দীপের রচনায়, তেমনই তাঁদের বনেদি পরিবার ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ার কাহিনীও জায়গা করে নিয়েছে। অকপটেই আপন পরিবারের কথা বর্ণনা করেছেন সন্দীপ। দাদু বাবা মা সব আপনজন এমনকী নিজের দোষ-ত্রুটিও কোথাও ঢাকা দিতে চাননি। তিনি লিখছেন তাঁর মায়ের মৃত্যুতে, ‘যে মা আমায় কোনোদিন ভালোবাসেনি, যে মাকে আমি কোনোদিন ভালোবাসিনি — সেই মার জন্য কেন যে এত কাঁদলাম, নিজেও জানি না।’ ঘরের ও বাইরের নানা লৌকিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক পরিবর্তন সন্দীপের নজরে এসেছে। পুজোর ধুনুচি নাচ পাল্টে গেছে হিন্দি গানের সাথে টুইস্ট নাচে, মেট্রোরেলের খোঁড়াখুঁড়ি ভবানীপুরে মশার প্রচলন ঘটিয়েছে, অবাঙালি ব্যবসাদার ও উঠতি বড়োলোকেরা এসে ভবানীপুরের জনবিন্যাসে পরিবর্তন ঘটিয়েছে, পুরোনো বাড়ি বেচে দিয়ে উঠে গেছে এখানকার সাবেক বাসিন্দারা — এইসব মিলিয়েই গড়ে উঠেছে ১৯৭৫ সালে সন্দীপের এই পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিত আর এই স্মৃতিচারণ।
গোটা বইটাতে ভবানীপুর গড়ে ওঠার পুরোনো ইতিহাস এবং সন্দীপ বন্দোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক হয়ে ওঠার চেষ্টার কিছু কথাও বলা আছে। সেগুলোও কম আগ্রহজনক নয়। আর আছে বেশ কিছু গুণীজনের কথা। লেখকের ভাষায়, ‘রাজনীতি ও শিল্প-সংস্কৃতি জগতের অনেক খ্যাতকীর্তি মানুষের স্মৃতি মাথায় করে রেখেছে ভবানীপুর।’ তাদের কথা লিখতে গিয়ে সন্দীপ একজনের কথা ভুলে গিয়েছেন। তিনি হলেন অখিলবন্ধু ঘোষ। এই সঙ্গীতশিল্পীর কথা অনেকেরই মনে নেই। অথচ তাঁর গাওয়া ণ্ণপিয়ালশাখার ফাঁকে’, ‘ও দয়াল বিচার কর’, ণ্ণতোমার ভুবনে ফুলের মেলা’, ণ্ণওই যে আকাশেরও গায়’ ইত্যাদি বহু গান আজও জনপ্রিয়তা হারায়নি। ইনি থাকতেন ভবানীপুরের টার্ফ রোডে। টার্ফ রোডের কথা ও সেখানে বিপিন পালের থাকার কথা সন্দীপ উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা। হেমন্ত থাকতেন রূপনারায়ণ নন্দন লেনে। তার পাশেই টার্ফ রোড। হেমন্তর গ্ল্যামারে, অনেকের মতো অখিলবন্ধুও ঢাকা পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে হেমন্তই বলেছিলেন, ‘উনি গায়কদের গায়ক’। এই অখিলবন্ধু ঘোষকে আমি অর্থাৎ বর্তমান পাঠক দেখেছি, সন্দীপ বন্দোপাধ্যায়ের বাসস্থান যে গলিতে, সেই চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী স্ট্রীট দিয়ে সকালবেলা জগুবাজারে বাজার করতে যেতে।
দেখেছি এই আত্মভোলা শিল্পীর মাথার কাঁচা-পাকা চুল থাকত এলোমেলো, পরনের ধুতি-পাঞ্জাবীতেও পারিপাট্যের যেমন অভাব হাতের বাজারের থলিও তেমনই শীর্ণ ও মলিন। প্রায় রোজই দেখেছি। কারণ আমি গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই গলিরই বাসিন্দা।