অমিতাভ সেন, কলকাতা, ৩০ মে#
কাল রাত থেকে ইলশেগুঁড়ি। আজ সারাদিন আকাশ ঝুরছে। বাদলা হাওয়ায় দোতলার ফাঁকা ঘরে ধাঁই ধাঁই করে দরজার কপাট পড়ছে। ওরা চলে যাওয়ার সময় ভিতরের দরজা ভালো করে লাগায়নি। হঠাৎ হঠাৎ দরজার পাল্লা মাথার উপর ধড়াম করায় চমকে উঠছি। এমনিতে বন্ধু দীলিপ আত্মহত্যা করায় মনটা খুব নরম হয়ে পড়েছে। তারপর মেঘে ঢাকা দিনের চোখ বোজা আলো পরিবেশ আরও থমথমে করে তুলেছে। সঙ্গে ভুতুড়ে বারইর মত দরজার শব্দ।
গোপালনগর পোস্টাপিসে গেলাম ২৫ পয়সার স্ট্যাম্পের খোঁজে । যথারীতি নেই। কলকাতায় কোন পোস্টাপিসেই পাওয়া যাচ্ছে না। জিপিওতেও নয়। সারা রাস্তা ভাবতে ভাবতে গেছই — কেন দীলিপ ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিল, এই ৫৯ বছর বয়সে কিসের ভয়, কত দুঃখ — আত্মহত্যাকারীর মন আমরা উপলব্ধি করতে শিখিনী, তাহলে তো ঠেকানোই যেত। দুদিন বাদে হয়তো এমনিই মরত, কেন নিজের থেকে মরতে চাইল কিছুই বোঝা গেল না — ভাবতে ভাবতে প্রেসিডেন্সি জেলের সামনে এক এসবেস্টসের চালাওয়ালা ফাঁকা একতলার বারান্দায় এক খুনখুনে বুড়িকে আতস কাচের চশমা পরে পা ছড়িয়ে বসে একা একা ঝোলা থেকে কলা বার করে মুখে পুরতে দেখে ফুটপাথ থেকে পরে যাচ্ছিলাম। সামলে নিতে নিতে ওপার থেকে এপারে আসছিলেন এক দিদি — তিনি বললেন, লাগল? আমার দিদির মতই লাগল দেখতে। না বলে হেসে কালীঘাট ব্রিজে উঠে দেখি উলটপালট হাওয়া ছাতা মাথায় রাখতে দেবে না। টাই গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই ফিরলাম পটুয়া পাড়া দিয়ে।
সেখানে মোড়ে আধপুরোনো বারই অর্ধেক ভাঙ্গা পড়েছে। পরপর দোকানে বল–প্রেস মেশিন, শ্যাকরার কারিগরি সব যেন অকালবৃষ্টিতে থমকে আছে। বাঁদিকে ‘চুলের জন্য পুষ্টির ভিটামিন সমৃদ্ধ এলীন কেশতৈলর‘ রংচটা পুরনো বিজ্ঞাপনের নিচের দোকানে অন্ধকার বিস্কুটের বয়ামের ওপাশে একজন বসে মাছই তাড়াচ্ছে। ডানদিকে শিবের বুকের উপর কালীর কাঠামো উলটো দিকে মুখ ঘুরিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে মাথা নিচু করে দুটো পুলিশ টিনের চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছে। ‘ওলা, তুই চটি কোথায় ফেললি?’ বলে ফুটপাথে বসা মেয়ের মা ছুটে এসে একপায়ে চটি পরা ছোট্ট মেয়েকে কোলে তুলে চটি খুঁজতে ছুটল। মেয়েটার দুপায়ে মল, তাও ভালো, মল হারায়নি দেখলাম। দেখতে দেখতে বারই পৌঁছে দরজাতেই শুনি বউয়ের গলা, ‘এই দেখ ঋতুপর্ণ ঘোষ, সিনেমাপরিচালক মারা গেছেন। টিভিতে দেখাচ্ছে, মাত্র ৪৯ বছর বয়স, ঠিক আমার বয়সী, দেখ ১৯৬৩ সালে জন্ম। মনটা খুব খারাপ লাগছে। একটা গুণী লোক চলে গেল।‘ দেখে শুনে আবার দীলিপের কোথা মনে পরে গেল। আর মনে পরে গেল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদ করা নাজিম হিকমতের কবিতার লাইন, ‘দিনগুলি মেঘাচ্ছন্ন, মৃত্যুর খবর দিচ্ছে দিনগুলি‘।
Leave a Reply