বলে আমার হাতটা এমন করে চেপে ধরলেন বৃদ্ধা, চোখ ঘোলাটে, চলতে পারেন না ঠিক মতো, কোনোমতে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটছেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন জলের ধারার কাছে। পাহাড়ি এক ক্ষীণ জলের ধারা, এক জায়গায় পাথুরে মাটি ভেদ করে ভুরভুর করে জল বেরোচ্ছে, নাম তার ভুরভুরি —- সে দেব্তা আছে। হাতের লাঠি ফেলে দিয়ে নুইয়ে পড়ে বৃদ্ধা অঞ্জলি ভরে জল নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করে জলে নামলেন। বারবার অঞ্জলি ভরে জল তুলছেন আর বিড়বিড় করে কথা বলছেন। আর জলের ধারাতেই উৎসর্গ করছেন। এরপর জল থেকে উঠে লাঠিটা খোঁজার চেষ্টা করতে লাঠিটা এগিয়ে ধরতেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে উঠলেন — তুঁয়ার মতন আমার বিটা ছিলে — দু-দুটা … বেঁচে থাক! বেঁচে থাক …
আমার সংসারে সবই আছে। ওধারকে থাকি বটেক। কথা বলতে বলতে শক্ত করে আমার হাতটা চেপে ধরলেন। আমার মুখ ফুটে একবার বেরিয়েছিল, কী হয়েছিল আপনার ছেলেদের? বৃদ্ধার ভুরভুর করে বেরিয়ে আসা কথা আর চোখের জলে আমার সমস্ত সন্ধানী প্রশ্ন ভেসে গেল … কেবল কানে বাজতে থাকল, বেঁচে থাক, বেঁচে থাক। আমি চুপ করে অনেকক্ষণ তাঁর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
এধারে ভুরভুরি নিয়ে শহুরে সুরজিতের অনুসন্ধান কার্য চলছে — চলছে ভুরভুরিতে কাঠি দেওয়া। সুরজিৎ বলে ওঠে, ভুরভুরিতে নামতে পারবি? অপরদিক থেকে হারুন উত্তর করে, ণ্ণএত মানুষ যাকে দেবতা বলে বিশ্বাস করে, দ্যাখ পাথরের ধারে ধুপ দিয়ে পূজা দিচ্ছে, তাতে আমি পা দিতে যাব কেন? পাকামি করার কী আছে! …’ আমাদের তর্কটা সরে যায় একটা জলাশয় ঘেরা লাল শালুকের সৌন্দর্য্যের মাঝে। গুটিগুটি পায়ে আমরা কয়েকজন অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন খেতখামার পার করে এক বটতলার ছায়ায় দাঁড়াই। সামনে মাটির দেওয়াল, সেই সকাল থেকে লেপে যাচ্ছে মেয়েরা। বেলা প্রায় দশটা। দূর থেকে লাল মাটি জোগাড় করে মাথায় করে বয়ে এনে দেওয়াল লেপার কাজ করে। এরপর সেই দেওয়ালে ছবি আঁকা হবে।
শহুরে ট্যুরিস্টের আনাগোনা শুরু হয়েছে অযোধ্যা পাহাড়ে। দু-একটি খাবার হোটেলে দারুণ ভিড়। চকচকে চামড়ার ট্যুরিস্টরা এতদিন ট্যুরিস্ট না আসাতে এই আদিবাসীদের কী অবস্থা ছিল তাই নিয়ে কটকটে বিশ্লেষণে ব্যস্ত। হোটেলের প্রাণবন্ত কিশোর ছেলেটি হাসিমুখে ওদের চা দিয়ে যায়। হঠাৎ দুটি বলদের শিঙে শিঙ ঠেকিয়ে লড়াই দেখে ট্যুরিস্টরা উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে। মোবাইল ক্যামেরা ঝকমকিয়ে ওঠে। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ছেলেটি। ধিঙ্গি মেয়ে প্রশ্ন করে, ণ্ণমাম্মি মাম্মি গরুর মেল ফিমেল হয়!’ মাম্মি বলতে শুরু করেন, ণ্ণগরুর রিপ্রোডাকশন হবে কী করে! গরুর ফেমিনিন জেন্ডার হল গরু। আর মেল হল ষাঁড়। ওদের মেল ফিমেল থেকে রিপ্রোডাকশন হয়, বুঝলি না’। হোটেলের কিশোর ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে ওদের দিকে চেয়ে থাকে, হাতে খাবারের থালাটা।
মালিক ভাড়া নিয়ে বসে আছে, ড্রাইভার ছোট্টু সেই সকালে পেশেন্ট নিয়ে শিকরাবাদ গেছে। ফিরে আসতেই মালিক তাকে বেরোতে বলছে ট্যুরিস্ট নিয়ে। সকাল থেকে তার খাওয়া হয়নি। প্লাস্টিকে কিছু মুড়ি নিয়ে ছোট্টু আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সে গাড়ি চালাতে শিখেছে ছেলেবেলায়। তার বাবা মা মারা গেছে ছেলেবেলাতেই। সে সব কাজই করতে পারে। সে কিছু চাষ আবাদও করে। এখানে চাষ করা খুব কঠিন — একবার ফসল হয়। এক টুকরো জমি তৈরি করতে পাঁচ সাল লেগে যায়। পাহাড়ের ওপর থেকে জমি দেখে যে চোখ জুড়িয়ে যায়। সে জানায়, গণ্ডগোলের সময় যখন ট্যুরিস্ট আসত না, তখনও গাড়ির ভাড়া ছিল। কারণ, এই অযোধ্যা পাহাড় এলাকা বিরাট। সেই তুলনায় গাড়ির সংখ্যা খুবই কম। পাহাড়ের ভাঙাচোরা এবরো খেবরো পাথর বিছানো পথে গাড়ি চালাতে চালাতে ছোট্টু গর্বভরে বলে আপনাদের কলকাতার ড্রাইভাররা এই রাস্তায় গাড়ি চালাতে পারবেক লাই। টাকাপয়সা বেশি মিলবে, সে কি কলকাতায় যাবে? জিজ্ঞেস করায় ছোট্টু সাফ জানায়, ইখান ছেড়ে যাবক লাই। পরিবার ছেড়ে যাবক লাই। বাচ্চা আছে।
অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন ডুরগা ফলস ও ব্রাহ্মণী ফলসের ধারে পাথরের পরে শুয়ে থেকে এই লাগাতার জলের শব্দে কতই না অর্থ বেরিয়ে আসে। বেলা বাড়ে।
পাহাড়ের ওপর যত্রতত্র চড়ে বেড়াচ্ছি, ছাগলের চড়ছে সর্বত্র। বেলা পড়ে আসছে। একটা গাছের ডালে গুটি কয়েক ছেলে দোল খাচ্ছে — বিপজ্জনক, কিন্তু বেশ আনন্দ করছে। গুটিগুটি পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। দুটি বাচ্চা এগিয়ে এসে এ বাবু , পয়সা দে না, বিস্কুট খাবো, বলে হাত পাতল। বারবার চাইতে থাকল। চোখ ফেরাতেই দেখি, পড়ন্ত বেলায় কতগুলো ছেলেপেলে পাহাড়ের কোলে প্লাস্টিক দলা পাকিয়ে বল বানিয়ে ফুটবল খেলায় মেতেছে। মেয়েরা কাঠ কেটে মাথায় করে ঘরে ফিরছে। সূর্য ডোপবে ডোবে …
ধীরে ধীরে সূর্য অস্ত গেছে। চাঁদ ফুটেছে। মন কিছুতেই পাহাড়ের মাথা থেকে নামতে পারে নি। পাহাড়ে ঘুরছে একটা ছিপছিপে ছেলে। তাকে ডেকে জানতে চাইলাম, এখানে কতক্ষণ থাকা নিরাপদ। সে গর্বের সঙ্গে বলল, পাহাড়ের মানুষ শান্ত। কোনও ভয় নেই। কখনও এরা গণ্ডগোল করে না। সারারাত থাকলেও কিচ্ছু হবে না। আসলে বাইরের মানুষ এসে আমাদের এমন দশা হল। ওরা (মাওবাদী) তো বাইরে থেকে আসে। এই জঙ্গল পাহাড়ের পথ ধরে আসে। আমি তো এখানকার ছেলে। ওই ইস্কুলেই পড়াশুনো করেছি। এখন এখানে থেকে খেয়ে অনেকেই পড়াশুনো করে। আমি মাধ্যমিকে ফিফটি সেভেন পারসেন্ট মার্কস ও পেয়েছিলাম। আমার তো প্রাইমারিতে চাকরি হয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু এমএলএ-র লোক ইন্টারভিউ বোর্ডে আছে। কী হবে বলুন। তবে কী জানেন, একটা পরিবর্তন দরকার ছিল। এখন একটা কিছু হয়েছে কিন্তু। এখন আমরা ভালোই আছি। আমি ক্যালকাটা পুলিশে লাইন দিয়েছিলাম সেখানে হয়নি। পরে তিন বছর হল এই বিশেষ বাহিনীতে যোগ দিয়েছি (বিশেষ বাহিনীর নামটা জিজ্ঞেস করলাম না আর)। আমি এখানে কাজ করি না। এখানে আমার বাড়ি। প্রথমে বাড়ির লোক কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু কি করব বলুন। আমাদের এখানে তো তেমন কোনও কাজ নেই। মানুষ খুব গরীব। একবার মাত্র ফসল হয়। তাই কাজে তো যেতেই হবে। জানেন তো, এখানে ছেলেপেলেদের জোর করে বন্দুক দেখিয়ে ওরা (মাওবাদীরা) দলে নিয়েছিল, কী করবে বলুন। আপনারা পাহাড়ে থাকুন, কিছু হবে না। অন্ধকার হলে পাহাড় থেকে নামতে অসুবিধা হবে। এই যা। আমার তো এই পাহাড়ে ঘুরতে খুব ভালো লাগে। ছুটিতে বাড়ি এলে এখানে ঘুরে বেড়াই। চাঁদের আলোয় সমস্ত কিছু ভেসে যেতে থাকল। পাহাড় জঙ্গল ক্ষেত, সরু পথ। সবকিছু মিলেমিশে এই সৌন্দর্য্যই সত্য।
অযোধ্যা উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রর সামনে এক মহিলা শিশু কোলে নিয়ে বসে আছে। এই অবেলায় এখানে তাকে দেখে একটু দাঁড়ালাম। একজন বয়স্ক লোক ডেকে আলাপ জুড়লেন। জানতে পারলাম, শিশুটির জ্বর হয়েছে, তাই নিয়ে মহিলা সেখানে ভর্ত্তি আছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দালান কোঠায় সে না থাকতে পেরে তিনি বাইরে ঘুরছেন। সন্ধ্যেবেলা তার স্বামী এল আরেকটি বাচ্চা নিয়ে। সেও রাতে এখানে থাকবে। সাথের বাচ্চাটিকে সামনের রাস্তায় গিয়ে পায়খানা করাচ্ছে ওরা। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মী মানুষটি বললেন, এখানে সব ওষুধপত্রই দেওয়া হয় কাছাকাছি কোনও দোকানও নেই, দেখছেন না। আর মানুষের ওষুধ কেনার পয়সাও নেই। রুগীর অবস্থা খুব খারাপ বুঝলে এখানে থেকে ডাক্তার ট্রান্সফার করে দেয় শিকরাবাদ বা পুরুলিয়া হাসপাতাল। সরকারি অ্যামবুলেন্সে করেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মানুষটি বেশ আন্তরিকতার সাথেই বলছেন, আপনারাও তো আমাদের কাছে এসেছেন। আপনাদের সুবিধা অসুবিধা আমাদের দেখতে হবে। শরীর খারাপ করলে ওষুধও দিতে হবে। কী বলেন। আজ এখন ডাক্তার নেই। বাড়ি গেছে। কিন্তু সিস্টার দিদিমনি আছেন। তিনি এখন সব দেখবেন। পরে রাত সাতটার পর প্রচণ্ড কাশি জ্বর গলাব্যাথা নিয়ে বিধ্বস্ত এক বন্ধুকে নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে ওই মানুষটি সিস্টারকে ডেকে আনলেন। তিনিএনে রুগী দেখে নামধাম লিখে ওষুধ দিলেন। রাতটা ভালোই কাটল। পরদিন ফেরার তাড়াহুড়োয় সেই মানুষটির কাছ থেকে বিদায় নেওয়া হল না।
রাতের বেলা বোলেরো গাড়ির ভেতর বসে আছেন ড্রাইভার। বাবুরা ট্রেনে এসে পুরুলিয়া থেকে গাড়ি বুক করে এসেছেন। ড্রাইভার রাতে গাড়ীতেই থাকবে। তার কোনও ব্যবস্থা নেই। তার কোনও ব্যবস্থার কথা শহুরে ভ্রমণবিলাসীরা ভাবেননি। তারা মোবাইল হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার খেলায় মেতেছেন। ড্রাইভার বলছিলেন, একবার একজন মোবাইল ফেলে গেছিল, সে ফোন করে বলতে চার মাস বাদে এসে মোবাইল নিয়ে গেছে। এখানে কিছু চুরি হয় না। এদিকে ড্রাইভার শুনতে পেয়েছে, হাতি এসেছে মাঠে মাঠে ধান পেকেছে। তারা উদ্বিগ্ন। সে বলছে, হাতি নয় বাবু, সে ভগবান আছে। গল্প হচ্ছে, কথায় কথায় তিনি বললেন, এখন একটু লোকজন ঘুরতে আসছে। কী অবস্থায় না ছিল এখানে। ওই যে দেখছেন না, ছেলেদের হোস্টেল। ওটা ভর্ত্তি নাগা-রা আছে (সিআরপিএফ-এর নাগা ব্যাটেলিয়ন)। আমি দেখেছি, গায়ে গায়ে বেড পাতা আছে। এই তো কিছুক্ষণ আগে ওদের দু’জন আমায় বলল, এই ইংলিশ খাবে। চলো। আমি যাই নাই। উয়ারা সব খায়। এখানে বাঘমুণ্ডি বা কাছাকাছি এলাকায় কোথাও কুকুর দেখেছেন? কোনও কুকুর দেখবেন না। ওরা সব কেটে খেয়ে ফেলেছে। জানেন, কুকুরের মাংস লোনচা লাগে। আমায় বলেছে। ওরা আমাদের কথা বোঝে না। রাতের বেলা জঙ্গলে বেরোয়। সাঙ্ঘাতিক! এখন তো ওরাই এখানে আছে। পাহাড়ের মানুষ কিতু খুব শান্ত। খাবারের হোটেলেও একজন মানুষ বিস্ময়ের সাথে বলছিলেন, নাগাদের সাথে গেলাম। ওরাই নিয়ে গেছিল। একটা মেশিন ঘরের সামনে গেল। কী একটা ঢুকিয়ে দিল। মেশিন থেকে বেরিয়ে এসে বলল, এখানে হবে না। আবার আরেক জায়গায় গেল, সেখানে মেশিনে কী একটা ঢুকিয়ে দিল। মেশিনের পেটে থেকে অনেক গুলান টাকা বেরিয়ে এল — নাগাদের টাকা। সে বিস্ময়ের সঙ্গে দু-হাত দিয়ে অনেক টাকা দেখাতে লাগল। আমি বুঝলাম, এটিএম মেশিনের কথা বলা হচ্ছে।
রাতে ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় এক হাতে একটা রেডিও, অপর হাতে একটা ছোট্ট বাঁশি নিয়ে টলমল পায়ে হেঁটে আসছে পাহাড় সিং। ভোর বেলা সে গরু চড়াতে বেরোয়। সারাদিন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যার পর নেশা করে। ফাঁকা মাঠের ধারে গাছের তলায় বসে পাহাড় সিং বাঁশি বাজাএ শুরু করল। তার বাঁশির সুর রাতের বাতাসকে বীষণ্ণ করে তুলল।
পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে ২৬-২৭-২৮ অক্টোবর ঘুরে এসে বঙ্কিম
Leave a Reply