জিতেন নন্দী, নয়াবস্তি, মহেশতলা, ২৭ মার্চ#
মেটিয়াবুরুজের আকড়া রোডের শেষ প্রান্ত থেকে রাস্তা যেখানে মহেশতলা এলাকার দিকে বাঁক নিচ্ছে, জায়গাটার নাম আকড়া ফটক। কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের ১৪০নং ওয়ার্ড পার করেই শুরু হচ্ছে মহেশতলা পুরসভার ৭নং ওয়ার্ড। আকড়া ফটকে গঙ্গার পার বরাবর একের পর এক ইটভাঁটা। ২৬ মার্চ দুপুর পৌনে বারোটা নাগাদ আমরা পাঁচজন রওনা হলাম নয়াবস্তির উদ্দেশ্যে। আমার সঙ্গে সাইকেল ছিল। ফটকের বাজার ছাড়িয়ে খানিকটা ফুটিফাটা পিচের রাস্তা। তারপরেই মাটির রাস্তা। ইটের গুঁড়ো আর ধুলোময় উঁচু-নিচু রাস্তার মধ্যে দিয়ে ধুলো খেতে খেতে চলেছি। মাথার ওপর চড়া রোদ। এক-একটা লরি আর মোটরবাইক যাচ্ছে আমাদের সারা শরীরে ধুলো ছড়িয়ে দিয়ে। আমাদের একজন বয়স্ক সঙ্গী আর এগোতে পারলেন না। আমার সাইকেলটা নিয়ে তাঁকে ফিরে যেতে হল। পথের দুপাশে সামান্য দূরে দূরে ইটভাঁটা আর কাছে সার দিয়ে ভাঁটা-শ্রমিকদের ইটের ঘর। ঘরের মাথার টালিগুলো যেন আলগা, কোথাও কোথাও ঘর যেন মাটিতে বসে যাচ্ছে আর মাথার টালির চাল যেন পড়ো পড়ো। মিনিট পনেরো হাঁটার পর দুপাশে হালকা ঝোপ আর একটানা পায়খানার দুর্গন্ধ। আমরা এবার নয়াবস্তিতে ঢুকছি। হঠাৎ যেন একটা ঘিঞ্জি পাড়াগাঁ। বসতি-ঘরগুলো বেশিরভাগ মাটির। দোকানঘরগুলো পাকা। তবে ইটের ব্যবহার রয়েছে। যেমন, দুই বাড়ির মাঝের সরু গলিতে কোথাও ইট পাতা রয়েছে।
জোহুরা বিবি, বাসিন্দা
বস্তির মধ্যে ৩৫০ ঘর। কোনো পরিবারে ২০ জন, কোনো পরিবারে ১৫ জন, ১২ জন, খুব কম পরিবার আছে যেখানে ৫-৬ জন। কেউ রিকশা চালায়, কেউ ভ্যান চালায়, কেউ জোগাড়ে কাজ করে, কেউ মিস্ত্রির কাজ, মেয়েরা লোকের বাড়িতে কাজ করে। আমাদের পাড়ার মানুষরা ইটভাটাতেও কাজ করে। তারা বাঙালি না, মুসলমান। বিহারিও আছে। বেশি পরিবারের চারশো টাকাও খরচা। পরিবারের সবাই না খাটলে কী করে হবে? পায়খানা-পেচ্ছাপের সমস্যা মানে ইটখোলার লোকের জায়গায় ইট রয়েছে। সেখানে যেতে ওরা বারণ করছে। চারদিকে বনজঙ্গল ছিল, ওরা কেটে দিচ্ছে। মেয়েরা কীভাবে করবে? বহুত কষ্ট। চান করার জন্য গাঙে যেতে হবে। বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে যাই। কিংবা জল নিয়ে এসে ঘরে ধুই। না খেয়ে না দেয়ে একটা বাথরুম করব, জায়গাই নেই। রেবা কয়ালকে (পুরসভার ৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলার) বলেছিলাম। এতগুলো মানুষের সংখ্যার মধ্যে দুটোই বাথরুম করে দিয়েছে। দেওয়ার পরে একজনের হাতে চাবি দিল। চাবি যতক্ষণে খোলে, ততক্ষণে করে, সব্বাই ওখানে করে না। সেই বাথরুম দুটো একদম বাজে হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, দুটো বাথরুমে হবে না। বাড়তি বাথরুমের দরকার। আর বাথরুমের জন্য একটা কল দরকার। জলের যদি ব্যবস্থা থাকে, তাহলে যে যাবে তাকে বলে দেওয়া হবে, তুমি পরিষ্কার করে আসবে। আমি নিজে একবার কী করেছি, ভর্তি ছিল, বাচ্চারা কাঁচ-টাঁচ সব ফেলে দেয়, আমি এই অবধি (কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত) প্লাস্টিক বেঁধেছি, বেঁধে হাত ঢুকিয়ে পরিষ্কার করেছি। করে তারপর রাগে-মাগে তালা দিয়ে দিয়েছি। যারা ফাঁকে যায় না, সবাই এসে বলছে, খোল খোল। খুলে দিয়েছি। আচ্ছা, জল বেশি করে দে। জল নেই তো কী করবে। কল আছে তো ওখানটায়। সারায় না। বর্ষার সময়টায় বন্ধ হয়ে গেছে।
খুশনাহার, রাইট ট্র্যাক সংস্থার কর্মী
এখানে জলের প্রচুর সমস্যা। আমি এক-দেড় বছর নয়াবস্তিতে আসছি। ফুলতলা, ডিপো, নয়াবস্তি, সত্যপীর আর বিশ নাম্বার মিলে পুরো আকড়া ফটকটায় একই ধরনের সমস্যা। এরা বারবার গিয়ে কাউন্সিলারকে জানায়। তিনি বলেন, ঠিক আছে দেখব। যেই ভোট আসে, ওদের একটু করে দেয়। তারপর যে-কে-সেই। তখন এদের কথাও শোনে না। এরা বারবার যাচ্ছে আর হেনস্থা হয়ে চলে আসছে। ইদানীং একটা চিঠি লেখা হচ্ছে বিধায়ককে। তাতে লেখা হয়েছে, এখানে কত লোক আছে, কত লোকের ভোটার কার্ড আছে, কত লোকের রেশন কার্ড আছে, এখানে কত বাড়ি আছে। এখানে কিছু লোকের ট্যাক্সের কাগজও আছে। কিছু লোক, যারা খুব পুরাতন, তাদের কাছে পাট্টা আছে। ফুলতলা আর ডিপোতেও কিছু লোকের পাট্টা আছে। পাট্টা থাকলে সুবিধা হয়। ইলেকট্রিক বিলও কিছু লোকের আসছে। একজনের ইলেকট্রিক আছে, ব্লক মিটার সবাইকে পয়সা দিতে হয়। আইসিডিএস-এর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এইরকম নোংরা জলে বাচ্চাদের অসুস্থ তো হবেই। চর্মরোগ, পায়খানা, বমি লেগেই থাকে। দত্তবাগানে স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। বুধবার আর শুক্রবার খোলে। দুটাকা দিয়ে টিকিট করাতে হয়।
ফুলতলায় ২২৪টা বাড়ি, ডিপোতে ৪৫০। এখন কিছু বাড়তেও পারে। সত্যপীরে ৩৫০ মতো বাড়ি। বিশ নাম্বারে লোকে অনেক সচেতন। ৪৫০ বাড়ি, সব হিন্দুস্তানি। কেউ বাসে কাজ করছে, কেউ পুলিশে চাকরি করে, কেউ সবজি বিক্রি করে, কেউ রিকশা চালায়। ভালো ভালো কাজ করে। ওরা শিক্ষিত, নিজের কাজ নিজে করে নিতে পারে। নয়াবস্তিতে আমাদের সাহায্য লাগে। এখন শিক্ষার আলো পৌঁছেছে। এখন টাকা না দিতে পারলেও স্কুলে ভর্তি নিচ্ছে। পাঁচটা বস্তিতেই বর্ষাকালে জল জমে, রাস্তাঘাটে কাদা হয়ে ভোগান্তি হয়। সত্যপীরের সামনের দিকটায় জল দাঁড়ায় না, পিছনের দিকে জল জমে।
Leave a Reply