কুডানকুলাম পরমাণু চুল্লি বিরোধী আন্দোলনের নেতা এস পি উদয়কুমার আজকের পরিস্থিতিকে বলেছেন, ‘নীরব জরুরি অবস্থা’। প্রতিবছর ২৬ জুন এলেই আমাদের মনে পড়ে যায় ১৯৭৫ সালের সেই জরুরি অবস্থা ঘোষণার দিনটির কথা। বহুদিন কংগ্রেস-বিরোধী এবং বাম রাজনীতির প্রতীক হিসেবে কাজ করেছিল ইন্দিরা গান্ধীর সেই সময়কার কার্যকলাপ। আজও শহরে ২৬ জুন পালিত হয়, বক্তৃতা আর আলোচনাসভায় জরুরি অবস্থাকে স্মরণ করা হয়।
কুডানকুলামে গতবছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে একটা অহিংস ও শান্তিপূর্ণ জন-প্রতিরোধ আন্দোলন চলছে। হাজার হাজার গ্রামবাসী, মহিলারা দফায় দফায় অনশন সত্যাগ্রহ করেছে। ভারত সরকার সেই প্রতিরোধকে কেবল অবজ্ঞাই করেনি, কঠোরভাবে দমন করেছে। গত মার্চ মাসে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা ভোল পাল্টে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিলেন, সরকারি দমন চূড়ান্ত রূপ নিল। সত্যাগ্রহীর বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’ করার ধারা, ‘দেশদ্রোহিতা’র ধারা! দেশের বিচার ব্যবস্থার কাছে গিয়ে আইনের নামে এইসব বেআইনি পদক্ষেপের সুবিচার পাচ্ছে না আন্দোলনকারীরা।
কিন্তু কুডানকুলামের এইসব কাহিনী দেশের অন্য প্রান্তের মানুষ জানতে পারছে না। ২০,০০০ স্থানীয় মানুষের লাগাতার প্রতিরোধ খবরের কাগজের পাতায় স্থান পায়নি। ১৯৭৫ সালের ঘোষিত জরুরি অবস্থায় মিডিয়া (বড়ো খবরের কাগজ) ছিল সরকারের আক্রমণের টার্গেট। অনেক সাংবাদিককে জেলে পোরা হয়েছিল। আর আজ মিডিয়া এসব খবর বেমালুম চেপে যাচ্ছে। তারা সরকারের কুকর্মের সঙ্গী। এই তো আজকের অঘোষিত জরুরি অবস্থার নতুন রূপ!
সেদিন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে দায়ী করা হয়েছিল। আজ মনমোহন সিং জনতার অভিযোগের কাঠগড়ায়। এঁদের দায় নিশ্চয় আছে। কিন্তু ঘটনাগুলোর পিছনে আরও অনেকেই নানানভাবে জড়িত রয়েছে।
কলকাতার পূর্বপ্রান্তে নোনাডাঙায় যেন খানিকটা কুডানকুলামের ঢঙেই ঘটনা ঘটে চলেছে। বস্তিবাসীদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বেশ কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি। বস্তিবাসী এবং সহযোগীদের প্রতিবাদ আন্দোলনের ওপর শুধু দমন করেই ক্ষান্ত থাকেনি সরকার, দফায় দফায় চলেছে গ্রেপ্তারি। ত্রিশজনের বেশি কর্মীকে জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাদের ওপর মিথ্যা মামলা করা হয়েছে এবং ‘বাইরের লোক’, ‘মাওবাদী’ স্ট্যাম্প লাগানো হয়েছে। যেন কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাইরে থেকে প্রতিবাদ করা অপরাধ! এখানেও বিচার ব্যবস্থার কাছে দরবার করে সুরাহা কিছু হচ্ছে না।
কিন্তু যে মিডিয়া সেদিন জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের প্রহরী বলে নিজেদের প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল, আজ তারা এত অনাচারের সংবাদে নীরব কেন? কেন তারা সরকারের সন্ত্রাসের দোসর? আমরা জেনেছি, কুডানকুলামে পরমাণু চুল্লির ক্ষেত্রে বহু বড়ো বড়ো দেশি ও বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। জানা গেছে, নোনাডাঙায় ৮০ একর জমি কেএমডিএ বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স-এর জন্য দেবে। দেখা যাচ্ছে, সর্বত্র এইসমস্ত বড়ো বড়ো বাণিজ্যিক সংস্থা আবার বড়ো মিডিয়ার সবচেয়ে বড়ো খুঁটি (মালিক, বিজ্ঞাপনদাতা ইত্যাদি)। তাই গণতন্ত্র আজ এক অন্য রূপে কয়েদ হয়ে রয়েছে দেশের নানা প্রান্তে, যেমনটা হয়েছিল জরুরি অবস্থায়।
Leave a Reply