অমিত মাহাতো, জঙ্গলমহল, ১৪ জানুয়ারি#
১০ জানুয়ারি শনিবার বেশ জমেছিল বেলিয়ার মকর হাট। বেলিয়া আমাদের প্রত্যন্ত পশ্চিম মেদিনিপুর জেলার ঝাড়খণ্ড লাগোয়া জামবনি ব্লকের একটি গ্রাম। যেটি দুবরা গ্রাম পঞ্চায়েতের সমৃদ্ধশালী সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার জন্য সুবিদিত ও সুপরিচিত। কুমোর চাষা মাঝি কামার শবর তেলি প্রভ্ররতি নানা সম্প্রদায়ের বসবাস। পাশেই অবস্থিত শানবেলিয়া গ্রাম। মাহাতো বা কুর্মী জনজাতি অধ্যুষিত গ্রাম। অন্যান্য সময় শনিবারের এই হাট বসে বিকেল বেলা। মকরের হাট হওয়ায় বসেছে সকাল থেকেই। বাঁদরবনী থেকে টুসু নিয়ে পসরা সাজিয়েছে ধনপতি দাস, গোবর্ধন দাস, চরনদাস প্রমুখ বোষ্টম সম্প্রদায়ের মানুষ। এসেছে নতুন জামাকাপড়, তিল-গুড়-আখ। বেলিয়া গ্রামের তৈরি মাটির হাড়ি, সরা বা সারোয়া। তাওয়া, চেলাং। ছোটো বাচ্চাদের জন্য রঙবেরঙের খেলনা টুসু পসরা সাজিয়েছে। সাজিয়েছে স্থানীয় টেঙিয়া গ্রামের ডোম সম্প্রদায়ের নতুন কুলো ঝুড়ি প্রভৃতি। নতুন মাটির হাড়ি ছাড়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃতি বিশেষ পরব হাড়িয়া (সাঁকরাত হাডিঁ) আর ভাত রান্না হবে না। পূর্বপুরুষদের জন্যই নতুন হাঁড়ির প্রচলন। তাতে কুমোরেরও কিছু পয়সা আসে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনেরা প্রথমে শালপাতার তৈরি থালা জাতীয় দোনাতে নতুন হাড়িয়া উৎসর্গ করে মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য। এটাকে ওদের ভাষায় বলে চডর। তারপর তা চুমুক দেওয়ার পূর্বে বসুমাতা বা প্রকৃতিমাতাস্বরূপ মাটিতে তিন ফোঁটা ফেলে দেওয়া হয়। এছাড়াও সরা বা সারোয়া দিয়ে টুসুকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে লেখায় বিস্তারিত আলোকপাত করা হবে।
হ্যাঁ যা বলছিলাম, এছাড়াও বড়ো তাওয়ার দাম একটু বেশি হলেও, আদিবাসীদের মধ্যে বেশ চাহিদা রয়েছে। তাওয়া ছাড়া মকরের সব আয়োজন বৃথা। শূয়োরের মাংস ও গুঁড়ি দিয়ে তৈরি জঙ্গলমহলের বিশেষ চাড়পা পিঠে রান্না তাওয়া ছাড়া অসম্ভব।
বিকেলের শেষ আলো গায়ে মেখে পশ্চিম দিগন্ত যখন সদ্য কিশোরীর লজ্জায় লালিমা রাঙা মুখে প্রায় যুবতী হওয়ার বাসনামাখা চাউনি আর চটকে হাতছানি ইঙ্গিত। মুগ্ধ হতে হয় এই অধমকেও। চোখ টানে। শ্রীচরণদাসের হাতে টুসুর প্রথম সাজ। প্রথম কাজল পরা ভুরু যুগলে। রঙিন কাগজের সারি। কোমরবন্ধ। বুকের কাঁচুলি। চুরি, টিপ। দক্ষ হাতে পড়িয়ে দিচ্ছেন টুসুকে। এমন ভাব, যেন টুসু কোনো দেবী নয়, তার বড়ো আদরের সদ্য নাইন বা ইলেভেনে পড়া কিশোরী মেয়েটিকে সাজাচ্ছেন আপন হাতে। এখানেই মেয়েদের মেলা। কথা হয় গোবর্ধন দাসের সাথে।
উনি এসেছেন, বিনপুর এক নম্বর ব্লকের অন্তর্গত লালগড়ের দক্ষিণে কাঁসাই নদীর পাড়ের এক গ্রাম উপরডাঙা, মৌজা বাঁদরবনী থেকে। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ।
— টুসুর দাম কত করে রেখেছেন?
— এই সামনের ছোটোগুলো কুড়ি। এগুলো (অর্থাৎ একটু বড়ো) তিরিশ। সবচেয়ে বড়ো (দেড় দু হাত) সত্তর টাকা।
— এছাড়াও আর কি করেন?
— সারা বছরই মাটির কাজ করা হয়।
— মাটির কাজ?
— এই ধরুন মাটির প্রদীপ, খুড়ি, ঘট, হাতি ঘোড়া, এই সব আর কি।
— আয় কী রকম হয়?
— কী বলব চলে যায় (মুখে হাসি দেখি)।
— মাটির হাড়ি কলসী এসবও বানান?
— না ওসব নয়, ছোটো ছোটো জিনিস গড়ি।
ধনপতি দাস গোবর্ধন দাসেরা ছোটো ছোটো জিনিস গড়লেও তা কোনো ছোটো কাজে লাগে না। লাগে মহৎ সব কাজে। জঙ্গলমহলের বিভিন্ন উৎসবে পার্বণে। মাটির জিনিস ছাড়া চলে না। এখন আবার ফাইবারের কুলো ঝুড়ি এসবেও বাজার ছেয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও ডোম মাহালি সম্প্রদায়ের ঝুড়ি কুলোর বিকল্প কিছু নেই।
হাটপর্ব সমাপন করব বাঁদরবনীর কাছেই কাঁসাই নদীর ওপারে বরকোলা গ্রামের নদী ঘাটে মকর উপলক্ষে বসা বরকুল মেলায় চরণ মাহাতোর কাছ থেকে শোনা টুসু গান দিয়ে —
মেদিনীপুরে সিলিক শাড়ি লিলি লো তুই কী দরে
উপরডাঙার বোষ্টমঘরে ছিলি লো তুই কী করে
বরকুল যায়ে যে গো চোদালি
দশহাত ধুতির ছঁট ভিজালি
কোন দোকানে লিলি শাড়ি
কে দিলো খরিদ কইর্যে।
লিলজ শাড়ি লিলি কী দরে।
ও তুই বললি না আমারে।
লিলজ শাড়ি কিনলি কী দরে।
বোস্টমের হাতে পড়া টুসু বা টুসু স্বরূপা কোনো কুর্মী আদিবাসীদের ঘরের মেয়ের দুর্দশা উপরোক্ত গানটিতে কোনো মেঠো অখ্যাত গেঁয়ো কবি ফুটিয়ে তুলেছেন। যেন টুসুর সাজকে জনজীবনে ঘটমান সামাজিক চিত্র স্বরূপ লিপিবদ্ধ করেছেন। আজকের বাজারি পুঁজি আগ্রাসনে বিলুপ্তপ্রায় চিরাচরিত তাঁতির বোনা তাঁত শাড়ি, আজকের ভোগবাদ সংস্কৃতির নগ্নরূপ কবি তার শ্লীলতা খোয়ানো ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন আপন মহিমায় আপন ভাষায়। নিলাজ।
বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য গত ৪ ও ৫ জানুয়ারি শনি ও রবিবার ঝাড়গ্রামের অগ্রসেন ধর্মশালায় অনুষ্ঠিত হলো টুসু গানের বিশেষ প্রতিযোগিতা। উদ্যোক্তা ঝাড়গ্রামের কাছে কনেডোবা তারামা সেবাসমিতি।
Leave a Reply