অমিত মাহাতো, জঙ্গলমহল, ১৪ জানুয়ারি#
কদিন আগেও ছিল মাঠময় সোনালি ধানের খেত। ছিল প্রান্তিক অন্ধকারে থাকা চাষিদের কর্মব্যস্ততা ও তা নিয়ে হাজারো চিন্তা। ঘরে তোলা ঝাড়ান মাড়াই ঠাকুরানা ইত্যাদি কাজগুলো। তার পর্ব এখন প্রায় শেষ। খোলা খামারে এখন ঝাড়াই ও কামিন মুনিশের দাম মেটানোর চেষ্টা। অতএব ধান বেচো। কিন্তু ধানের দাম, মোটা ধান ১০৫০ টাকা কুইন্টাল এবং স্বর্ণটা ১০৮০ থেকে ১১০০-র মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। এই মানুষগুলিকে যারা নগদ অর্থ শাড়ি এবং বাজার প্রভৃতি ধারে দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে এই ক-মাসে তারাও এখন আপন পাওনাগণ্ডা বুঝে তা আদায়ে সচেষ্ট। তাই ধান বেচো। খামার থেকে গোলাঘরে যাওয়ার আগেই ধান বেচো। পাওনাদারেরা মুখিয়ে। চাষিদের এই সময় অভাবী বিক্রি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প উপায় নেই। অতএব ধান বেচো। আপন ঘামে মাখা সোনালি রঙে রাঙা ধান বেচো। দোরগোড়ায় মকর এসে দাঁড়িয়ে।
হ্যাঁ মকর। জঙ্গলমহলের টুসু পরব ও মকর মেলা। হাঁড়িয়া মদ ছেলেমেয়েদের নতুন জামা, বউয়ের শাড়ি, নতুন খেজুর গুড়, তিল, নতুন চালের বড়ি, মাস পিঠার হাঁস, মাংস — সবকিছুর জোগাড়। এটা এই ধান বিক্রি করা ছাড়া সম্ভব নয়। বাজারে নতুন তোলা কাঁচা আলু তার দামও দশ টাকা কিলো এবং এক কিলো সাইজের বাঁধাকপি ফুলকপি জোড়া পনেরো টাকা, সিম ষোলো টাকা। টমেটো বেশ সস্তা। মেলার দিন পনেরো কুড়ি আগে থেকে ঝাড়গ্রামের ফুটপাথ ছেয়ে গেছে সস্তা রঙিন জামাকাপড়ে। এবার ঝাড়গ্রামের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন পাঁচমাথার মোড় নবদ্বীপময়। শান্তিপুর নদীয়া থেকে এসে পসরা সাজিয়েছে ফুলিয়ার শাড়ি। শাড়িগুলো বেশ সস্তা। একশো কুড়ি থেকে দেড়শো টাকার মধ্যে। জঙ্গলমহলে সস্তার দু টাকা কেজি দরে রেশনের চালের ভাত খাওয়া, কুর্কুট খাওয়া এখানকার আদিবাসী মাহাতো ভূমিজ কামার শবরদের মকর পরবে এবারের সংযোজন নবদ্বীপের শাড়ি ও জুতোর রমরমা। কোনো ধর্মীয় কারণেই এই জায়গার ব্যবহার ওখানকার পসরাওয়ালাদের মুখে। একটু মেলাতে গিয়ে বুঝি, ওদের সকলের বাড়ি শান্তিপুর সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে। কিন্তু প্রথমে থাকবে নবদ্বীপ। এটাও হয়তো ব্যবসার সাথে ধর্মীয় ভাবাবেগকে ব্যবহার করা। ওরা সংখ্যায় প্রায় পঁচিশ তিরিশ জন। তাদের কয়েকজনের সাথে
কথাও বললাম। যেমন, রাজেশ চৌধুরি, বয়স পঁয়ত্রিশ। শহরের পাঁচমাথার মোড় থেকে উত্তরে যে রাস্তা চলে গেছে স্টেশনের দিকে, অর্থাৎ ট্রেকার স্ট্যান্ড ও উড়িবাবা ও বালাজি হোটেলের সামনের ফুটপাথে ব্যবসার শাড়ি নিয়ে বসেছিলেন ওঁরা তিনজন। আমি প্রথমজনের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আমার পাশেই শাড়ি নেড়েচেড়ে দেখছিলেন জনাচারেক আদিবাসী মহিলা, চাররকম বয়সের।
— শাড়িগুলো কত করে?
— ১২০, ১৫০।
— এই বছরই প্রথম?
— হ্যাঁ
— মকরের জন্য এসেছেন?
— মকর কবে?
— বৃহস্পতিবার।
আদিবাসী মহিলারা নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করলেন,
প্রথম মহিলা — নোয়া দঃ অড়েচ শাড়ি।
দ্বিতীয় মহিলা — বাং ভাগেয়া।
তৃতীয় মহিলা — হাতাও মে।
চতুর্থ মহিলা — দাম দঃ কম গেয়া।
অর্থাৎ, এই শাড়িগুলো ভালো না, ছেঁড়া, তবু নাও, দাম তো কম। ওদের কথার ফাঁকে আমার সাথে রাজেশের কথা হয় আবার।
— হাটে হাটে ফিরি করেন?
— হ্যাঁ এই কাজ নিয়েছি। পাঁচ ছয় বছর ধরে করছি।
— আগে কী করতেন?
— বাড়িতে এমব্রয়ডারির কাজ হয়।
— কত জন এসেছেন?
— বিশজন। একসাথে থাকি একটা রুম নিয়ে। রাত্রে নিজেরাই রান্না করি।
এখান থেকে ক-পা দূরে রবীন্দ্র পথ। ওখানে নিজের জায়গা করে বসেছেন বছর পঞ্চাশের নারায়ণ ভৌমিক। এসেছেন নবদ্বীপ থেকে। উনি এর আগে কয়েকবার শাড়ি নিয়ে এসেছেন। এবারও মকরের সময়। জানালেন, আগের তুলনায় এবারের বাজার পড়তিমুখো। তেমন লাভ নেই। তার মুখ থেকে শুনলাম,
— কতদিন ধরে এই ব্যবসা করছেন?
— এটা আমাদের জাত ব্যবসা।
— বিক্রি কেমন এবার?
— ভেবেছিলাম বেচাকেনা হবে। হচ্ছে, তবে খুব কম।
Leave a Reply