অমিত মাহাতো, ঝাড়গ্রাম, ৩০ মে#
ক-দিন আগে বৈশাখী ধান কাটার কাজ ফুরিয়েছে। ফুরিয়েছে বৈশাখ মাস-ও। জৈষ্ঠ্য মাসের প্রথমদিন থেকে শুরু হয়েছে অরণ্য অঞ্চলের আদিবাসীদের বৃহৎ শিকার উৎসব। এই শিকার উৎসব মূলত তিনদিনের। বৈশাখী বুদ্ধ পূর্ণিমায় পেরিয়ে গেল তাদের বীর দিশম সেঁদরা বা শিকার হিসেবে খ্যাত পুরুলিয়া অযোধ্যা পাহাড়ে শিকার। জৈষ্ঠ্যের অমাবস্যা উপলক্ষ্যে বেগুনবাড়ি শিকার চলে আসছে বংশ পরম্পরায়। এবার বলি বেগুনবাড়ি জায়গাটি কোথায়। খড়্গপুর ও হাওড়ার মাঝের স্টেশন ক্ষীরাই। সেখান থেকে দক্ষিণে প্রায় সাড়ে চার কিমি গেলে পৌঁছানো যায় বেগুনবাড়ি নামক শিকারের জায়গাটিতে। শিকারের রাত্রিকালীন আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত জায়গাটি। এর অন্য নামও আছে। শিকার সম্বন্ধীয়। গিবিতিজ টাঁড়ি বা সহবাসের স্থান। অমাবস্যার রাতে পূজিত হন শিকারের দেবী টাঁড়ি। শিকার উৎসবের তিনদিন আগে থেকে সুদূর ঝাড়খণ্ড ওড়িশা ও পশ্চিমবাংলার জঙ্গলমহলের তিন জেলা থেকে আদিবাসী মানুষেরা শিকারের জন্য জড়ো হয় রূপনারায়নের দুই তীরে, কোলাঘাটের এদিক ওদিক। সঙ্গে নিজেদের হাঁড়ি কুড়ি কাঠ মাদুর চাটাই ও হাঁড়িয়া মদ সহযোগে শিকারে মেতে ওঠে। দিনের শুরুর সাথে সাথেই শিকার শুরু হয়ে যায়। এখানে বলে রাখি, তারা মূলত পাখি ও গোসাপ শিকারের জন্যই এই জায়গাটি বেছে নেয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগে শিকার করার অর্থ ছিল জীবিকা। সেই সময় এই জীবিকা জীবনধারণের প্রধান মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হত। যুগ পরিবর্তনের ফলে মানুষের জীবন জীবিকা পাল্টায়। মানুষ চাষবাস ও ব্যবসা বাণিজ্য করতে শেখে। তারপর তো এই শিকার হল বিনোদনের সেরা মাধ্যম। আদিবাসীদের শিকার উৎসবের মধ্যে সাম্যবাদ নীতির প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন, শিকারের মাংস সমানভাবে বন্টন। সাথী কুকুরটির জন্য সমপরিমাণ ভাগ দেওয়া হয়। এছাড়া যখন জঙ্গলে শিকার কিংবা ফলমূল পাওয়া যায়, সে মূলের খাওয়ার মতো অংশ নিয়ে বাকি অংশটি ওই মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে পরবর্তী কোনো ব্যক্তির খাবারে যাতে টান না পড়ে। তাই এই নীতি। শিকারকে নিয়ে কিছু সামাজিক লোকাচারও রয়েছে তাদের মধ্যে। শিকারে যাওয়ার আগে বিবাহিত পুরুষটিকে তার স্ত্রীর হাতের লোহার খাড়ুটি (বালা জাতীয়) খুলে দিয়ে যেতে হয়, যেটি স্বামী বিয়ের সময় পরিয়ে দিয়েছিল। অতীতে শিকারে প্রাণহানির মতো ঘটনা আকছাড় ঘটত। তাই এই লোহা খুলে রাখা। তাছাড়া শিকার থেকে ফিরলে ওই বউটি তার স্বামীর পা ধুইয়ে তেল মাখিয়ে তাকে প্রণাম করবে। স্বামী তখন লোহাটি আবার পরিয়ে দেবে। এখানে একটি সুন্দর বির-সেরেঞ বা বনসঙ্গীত তুলে দিলাম
~
জমা ঞুআঃ লাগিৎ কে হো
বির য়ৌ লেনা নোয়া জিয়ন দ
বির বুরু উদৌও পারম
দা দরয়া ধানটা পারম দ
বরং বতর দেয়া কাতে
জানুম ধান্টি তালম কাতে
তবে নাহি হো শোস সাহার দ
ঞামদে লেন হো জিয়ন আহার দ
অর্থাৎ
জীবিকার জন্যই জীবন
বন পাহাড় পেরিয়ে
জল নদী টপকে
ভয়কে পেছনে ঠেলে
কাঁটাকে মাড়িয়ে
এগিয়ে গেলেই তো
রসদ পাবো খাবার পাবো
শিকার শেষে যখন ক্লান্ত হবে শরীর, তখন গিয়ে আশ্রয় নেবে গিবিতিজ টাঁড়ি বা সহবাসের স্থানে, গান ও কথায় শ্লীলতা ও অশ্লীলতায় শিকারীর চিত্তবিনোদনের মাধ্যমে।
Leave a Reply