অমিত মাহাতো, ১৫ জুন#
জৈষ্ট্য মাস শেষ হতে চলল, বৃষ্টি নেই। জৈষ্ট্যের তেরো থেকে কুড়ি তারিখ পর্যন্ত জঙ্গলমহলে যা রহৈন পরব নামে পরিচিত। এই রহৈন পরবও পেরিয়ে গেল মেঘহীন। দীর্ঘ বৃষ্টিহীনতা দুর্ভাবনার ছাপ ফেলেছে জঙ্গলমহলের চাষি পরিবারে। রহৈনালি বাতালিতে বীজতলা ফেলার উপযুক্ত সময় হিসেবে মান্যতা পেয়েছে গ্রামজীবনে। তা এবার বোধহয় আসন্ন খরা পরিস্থতির দিকে প্রকৃতি এক পা বাড়িয়ে দিয়েছে। জৈষ্ট্যের ফুটিফাটা মাঠে ঘাস তার স্বাভাবিক রং হারিয়ে এখন ধবধবে ধূসর। বনকুরচি গাছের পাতা ফুল খরায় ঝলসে শুকিয়ে যাচ্ছে। পুড়ছে মাটি। পুকুর ডোবাও শুকনো। কুয়োর জলস্তর তরতরিয়ে নিচে নামছে। গ্রামের ব্যস্ততার চেনা ছবিও ক্রমশ পাল্টিয়ে যাচ্ছে।
পাল্টে যাওয়া গ্রামে, বর্তমান ছবিটা কেমন তা দেখতে শেষ জৈষ্ঠ্যের দাবদাহে বিকেলের শেষ চারটা চল্লিশে শিলদা ঝাড়গ্রাম রোহিনী রুটের শুভযাত্রা নামের মিনিবাসে উঠে পড়লাম। আমার স্টপেজ চুনপাড়া নামের গ্রাম। বাসের ডানদিকে প্রথম সিটটি প্রবীন নাগরিক। বাঁদিকে দরজার গোড়ায় শারীরিক প্রতিবন্ধী ছাড়াও পেছন দিকে মাঝ বরাবর এমার্জেন্সি লেখা। এই রুটের বাসে অবশ্য সংরক্ষিত আসনের দাবিদার হিসেবে তেমন কেউ তর্ক করে না। ঝাড়গ্রামেই বাসটি ভরে উঠল। কয়েকজন ছেলেছোকড়া অবশ্য ছাদে উঠেও বসল। এই রুটের মিনিবাস বলতে তিনখানা। শুভযাত্রা নামের মিনিবাস দুটো যায় রোহিনী অবধি। অন্য একটি রূপসী বাংলা — এও মিনিবাস। এ যায় কেশিয়ারী। চোখে পড়ল বেশ ক-খানা রাস্তা। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় পাকাপোক্ত হওয়ার কাজ চলছে। আগামী পাঁচ বছরে আমূল পাল্টাবে গ্রাম। এ নিশ্চিত। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে কতখানি পরিবর্তন আসবে, তা হয়ত বলা যাবে না। একথা নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা সম্ভব না যে চাষি তার বছরভর পরিশ্রমে উপযুক্ত দাম সে পাবে। লোকসানের হিসেব থাকবে না। যাক সে কথা, অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছে।
লোধাশুলিতে বাস দাঁড়ালো মিনিট পাঁচেক। ড্রাইভারের পাঁচ মিনিট খাওয়ার সাময়িক বিরতি। যাত্রী উঠছে নামছে। জানলা দিয়ে মাঝবয়সী চানা মশলা ওয়ালা মশলা চানা বাড়িয়ে দিল বাড়ির ভেতরে। বাস নড়তেই একটি বৌ — তার বছর তিনেকের বাচ্চাটি ব্যাটা মামুর কোলে চাপ বলে আমার কোলের ওপর বসিয়ে দিল। মিনিবাস হওয়ায় বাঙ্কারে ব্যাগ রাখার ব্যবস্থাও সংকীর্ণ। তাই ব্যাগও ছিল আমার কোলের ওপর, এখন বাচ্চা সওয়ারি হলো। বাসযাত্রীর অভিজ্ঞতায় এ অবশ্য নতুন কিছু নয়। লোধাশুলির কিছুটা পূর্বে গজাশিমূল। এখান থেকে ডানদিকে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা গিয়ে উঠেছে কেশিয়াপাতা। আমার গন্তব্য ওই রাস্তাতেই পড়ে। একে একে তালকাটি, বেলিয়া, কঁঠাবিলা, সাঁওতালডিহা, ছোটোগহিরা, সিধাকূড়া, মুড়াকাটি, ধানঘড়ি, পালইডাঙা প্রভৃতি গ্রাম ছাড়িয়ে বাস দাঁড়ালো চুনপাড়া নামের গ্রামটিতে। দেখলাম এদিকেও, অর্থাৎ সাঁকরাইল ব্লকের গ্রামগুলোর দশা তথৈবচ। যেমন ফুটিফাটা মাটি, তেমনই বীজতলা ফেলতে পারেনি কেউ।
Leave a Reply