- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

চাষির চোখে সবজি বাজার

নদীয়া জেলায় ফুলকপি আর শীতের অন্যান্য সবজির জন্য বিখ্যাত মদনপুরের মাজদিয়া গ্রামের ছোটো চাষি বাসুদেব পরামাণিক-এর সাথে কথোপকথনে শমীক সরকার ও সম্রাট সরকার। বাসুদেবের কথা সম্পাদনা করেছেন শমীক সরকার। বাসুদেবের ছবি প্রতিবেদকের তোলা, মদনপুর, ১৪ জুলাই#

‘মদনপুর বাজার যখন শুরু হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল, ‘চাষির মাল চাষিই বিক্রি করবে’ … ‘

এবার দশ-পনেরো দিন আগে সবজির একটু বেশি দাম হয়েছিল। চাষিরা পেয়েছিল একটু। কারণ তখন মার্কেটে মালটাই কম ছিল। এখন এক বিঘে জমিতে চাষি দশ মণ করে পটল তুলছে, সপ্তাহে। ওই সময়টাতে এক মণও হত না। সবজির এত ক্রাইসিস হয়ে গিয়েছিল। একটা কারণ তো ছিল, ব্যাপক খরা। তাছাড়া সবজি টবজি এমন জিনিস, আমি দেখি, একসাথেই হয় সব। যখন হবে তখন সবার একসঙ্গে বিশাল হবে। আবার ফুরিয়ে গেল, ফুরিয়ে গেল। যখন ক্রাইসিস থাকে, তখন দামটা বাড়ে। কিন্তু চাষিরা যা দাম পায়, বাজারে তার থেকে ডবলেরও বেশি দাম থাকে।
আমি এবার পটল লাগিয়েছিলাম। ভালো হয়নি খুব একটা। এবারে সবচেয়ে বেশি দাম ছিল ১৩০ টাকা পাল্লা (৫ কেজি)। গতবারে বর্ষার পরে, বন্যার পরে পটল বিক্রি করেছিলাম সবচেয়ে বেশি ২৩০ টাকা পাল্লা। অর্থাৎ কেজিতে দাম পেয়েছিলাম ৪৬ টাকা। সেই পটল বাজারে বিক্রি হবে ৬০ টাকা কেজি। পটলের দাম সবথেকে বেশি হয় ওই আগস্টের শেষের থেকে অক্টোবরের শুরু অবধি। ওই সময় ভাদ্র মাস, রোদটাও খুব প্রখর হয়। সেই সময় দিনের বেলা এক পশলা ভালো বৃষ্টি হলেই পটল পচে যায়।
এখন মদনপুর বাজারে বেগুনের দাম চাষিরা পাচ্ছে তিন টাকা কিলো। এবার বেগুন বেশি উঠেছে। একমাস আগে জমিতে বেগুন খুঁজতে গেলাম বাড়ির জন্য, সাত-আট কাঠা জমিতে দুটো মাত্র বেগুন পেলাম, তাও একটায় পোকা। সেই জমিতেই এখন পাঁচ মণ বেগুন (২০০ কেজি)। কাঁচামালের ব্যাপারটা না, সিজনে কিছু মাল প্রচুর উঠে পড়ে। কপি যে যতই আগে বুনুক, সেই একই সময়ে সবার ফুটবে। আর দামটা কমে যাবে। চাষিও মনে করে, আমি তাড়াতাড়ি বিক্রি করতে পারলে বাঁচি, লস লাভের হিসেব করে লাভ নেই। চাষিদের অনেক সমস্যা।
আমরা পাল্লা হিসেবে যা বিক্রি করি, তা যদি সরাসরি বাজারে যায়, তাহলেও একটা দামের ফারাক হবেই। আমি পাঁচ কিলো দিয়েছি। তার মধ্যে থেকে কিছু পাকা, পোকা, ছোটো মোটোও বেরোবে। আমি পাঁচ কিলো (দাঁড়িপাল্লার) যে ঝুলে দিয়েছি, সে তো দুশো-আড়াইশো করে দেবে, পাঁচ কিলো তার পুঁজবে না। তবে আমরা ঝুলে কম দিই না, কিন্তু এমন চাষিও আছে, সাড়ে চার কিলো মাল ঝুলে পাঁচ কিলো করে দিল। ভালো খারাপ সব আমাদের মধ্যেও আছে।
আমি নিজে বিক্রি করছি, আর নিজেই যখন কিনতে যাচ্ছি, ডবল দাম। চাষিরা কত বোকা দেখ। কেউ লঙ্কা নিয়ে গিয়েছে পাঁচ কুইন্টাল। বাড়িতে একমুঠো লঙ্কা রেখে যায়নি। আমার নিজের চোখে দেখা। সেই লঙ্কাই সে কিনছে দোকান থেকে ডবল দাম দিয়ে। ভোরে মাঠ থেকে বাজারে যাওয়ার সময় লঙ্কা রেখে যায়নি বাড়িতে। এরকম পরিবার অনেক আছে। আমি জিজ্ঞেস করি, তো আরেকবার মাঠে গিয়ে দুটো গাছ ছিঁড়ে নিয়ে আসলেই তো হয়। বলে, অত সময় নেই, বাড়িতে রান্না বসাবে। আমি সবসময় বাড়িতে বেশি বেশি করে রেখে যাই।

‘… মদনপুর বাজারের বেশিরভাগটা আড়তদারদের হাতে চলে গেছে’

মদনপুর বাজার যখন শুরু হয়েছিল, তখন লেখা ছিল, ‘চাষির মাল চাষিই বিক্রি করবে’। যে উৎপাদন করবে, সে-ই বিক্রি করবে। কিন্তু এখন উলটো হয়ে গেছে।
মদনপুর বাজারটার বেশিরভাগ জায়গা আড়ত হয়ে গেছে, লোকে রাজনৈতিকভাবে দখল করে নিয়েছে। এই নিয়ে মদনপুরে অনেক মিছিল মিটিং হয়েছে। চাষিরাই করেছে। কিন্তু চাষিদের ভেতরে ইউনিটি (একতা) নেই। আমিও ছিলাম আন্দোলনে। সামনের সারিতেই ছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক বড়ো বড়ো নেতারা দেখল, তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করছে উঠতি বয়সের কিছু ছেলে। তাই আমাদের ডাউন করার জন্য আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই রাখল না। আমাদেরকে আর পরে কোনো মিটিং-টিটিঙে ডাকল না। ওরা ওরাই সব করে ফেলল। আমরা হেরেই গেলাম। আমাদের পাড়ারও দু-একজন ওইরকম নেতা আছে।
মদনপুর বাজারে কেবল মাজদিয়া গ্রামের কোনো চাষি আড়তে বিক্রি করে না। বাদবাকি আলাইপুর, সগুনা, বামুনপাড়ার সব চাষি আড়তে দেয়। মদনপুর বাজারটা সব দখল হয়ে গেছে। শুধু আমার বারান্দাটা নিয়ে আর এই ঘর দুটো নিয়ে যতটা জায়গা, তার সমান জায়গায় মাজদিয়ার চাষিরা বসে, সরাসরি বিক্রি করতে পারে, দখল হয়নি। এবার ধরো, আমার সগুনার দুটো চাষি বন্ধু হয়ে গেছে, তারাও এল, এই জায়গাটায় বসল। এই জায়গাটুকুর ওপর এখন সব জায়গার চাষির নজর, জানে এখানে বসলে পয়সা দিতে হবে না।
বাজারের জায়গা যারা দখল করে আড়ত করে বসে আছে, তারা যে সবসময় কেনে, তা নয়। অনেকসময় দেখা যায়, ওদের আট ফিট বাই আট ফিট বা দশ ফিট বাই দশ ফিট জায়গা আছে। তুমি বিক্রি করো। আমাকে কিছু দাও। কত? কিছু কিছু আড়তদার একশো টাকায় দশ টাকা নিয়ে নেয়। কিছু কিছু আবার ঝুড়ি অনুযায়ী। এই ঝুড়িটার এই রেট। আড়তদার কিন্তু মাল যাতে বিক্রি হয় সে ব্যাপারেও কোনো দায়িত্ব নেবে না। শুধু মালটা রাখার জন্যই টাকা।
মদনপুর বাজারে যারা রাত একটা থেকে রাত তিনটে পর্যন্ত মাল কেনে, তারা কোলে মার্কেটে (শিয়ালদা) নিয়ে যায়। তারা অনেক মাল কেনে। এরা পাইকার। ট্রেনে করে নিয়ে যায়। ওই সময় যত ট্রেন যায়, তারা মদনপুরে দু-এক মিনিট বেশি দাঁড়ায়। ওই সময় কোনো প্যাসেঞ্জার থাকে না। পুরোটা মালগাড়ি। যারা কোলে মার্কেটের জন্য কেনে, তারা আমাদের (চাষিদের) কাছ থেকে কিনলে ক্যাশে কেনে। কিন্তু আড়তদারের কাছ থেকে কিনলে অনেক সময়ই ধারবাকি হয়।
তারপর যারা কেনে, তারা লোকাল। মানে কল্যাণী, চাকদা। তারা ছোটো ছোটো গাড়ি, যেমন ১৬০ (ছোটো মালবাহী গাড়ি), বা কেউ ভ্যানরিক্সা করেও নিয়ে যায় আশেপাশের বাজারে। এরা খুচরো। এরা ডাইরেক্ট পাবলিককে খাওয়াচ্ছে। ওরা বেশিটা কেনে না। …

… ফসলের বাজার ফড়েদের ওপর নির্ভরশীল

আবার যাকে আমি সরাসরি মাল বিক্রি করছি, সে সবজিবিক্রেতা না হয়ে ফড়েও হতে পারে। আমার কাছ থেকে মাল কিনে নিয়ে অন্য কাউকে বেচে দিল। যেমন ধর, গতবার আমি লঙ্কা নিয়ে গিয়েছি একদিনে পাঁচ কুইন্টাল (৫০০ কেজি)। এবার আমার কিন্তু একটা ভয় আছে। পাঁচ কুইন্টাল লঙ্কা আমি একা বিক্রি করতে পারব না। ধরা যাক, আমি রাত দুটোর সময় গেলাম, ভোর ছ-টা সাড়ে ছ-টা অবধি খরিদ্দার থাকে, যেই সেই টাইমটা পার হয়ে গেল, আমি কেঁদে ফেলব। মাল বিক্রি না হলে নষ্ট হয়ে যাবে তো। তখন কোনোরকমে দিয়ে-টিয়ে আমি পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচি। তাই বেশি মাল নিয়ে গেলে, রাত্রিতে গিয়ে প্রথমেই ওদেরকে (ফড়েদের) দিয়ে দিলাম, যে পারব না আমি একা অত মাল বিক্রি করতে। এবার তখন টাকা দেবে না। আমি তো ওদের মালটা দিয়ে বাড়ি চলে আসলাম, কি আবার ভুঁইয়ে গেলাম, অন্য মাল নিয়ে আবার গেলাম বাজারে। তখন আমার মালটা ওরা বিক্রি টিক্রি করে ফেলেছে, তখন টাকা দিল।
সবজির দাম কিন্তু ঠিক করি আমরাই। এক চাষি যখন বাজার থেকে ফেরে, তখন যে চাষি মাল নিয়ে যাচ্ছে, পথে জিজ্ঞেস করবেই, বাজার কেমন? আজ সকালে আমি পটল বিক্রি করেছি পঞ্চাশ টাকা পাল্লা, মানে দশ টাকা কিলো। এবার কালকে গিয়েও আমি একই দাম চাইব। বা পঞ্চান্ন টাকা পাল্লা চাইব। এটা দীর্ঘদিন যে চাষি মাল বাজারে নিয়ে যায়, তার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। মালের যখন চাহিদা হয়, তখন আমি যখন মালটা নামাচ্ছি তখন একসাথে পাঁচটা খরিদ্দার এসে বলবে, দাও আমি নামাচ্ছি আমি নামাচ্ছি। সবাই জিজ্ঞেস করবে, কত। তখন আমি বুঝতে পারলাম, আজকে চাহিদা আছে মালটার। তখন একটু বাড়িয়ে বললাম। এবার যেদিন মাথা থেকে ঝুড়ি নামানোর সময় ধরার লোক পাচ্ছিনে, কোনো খরিদ্দার এসে জিজ্ঞেস করছে না যে কত, বোঝা গেল যে আজকে হবে না। সেদিন আমি বুঝলাম, কালকে পঞ্চাশ দিয়েছি, আজকে চল্লিশ হলেই বাঁচি।
এখন সব থেকে বেশি আপ ডাউন হচ্ছে লঙ্কার বাজার। আজকে লঙ্কা দুশো টাকা পাল্লা। এবার ধর, চাকদায় আজকে বিক্রি হয়েছে দেড়শোটাকা পাল্লা। কালকেই দেখবি মদনপুরে লঙ্কা ভর্তি হয়ে যাবে। লরি লরি লঙ্কা চলে আসবে মদনপুরে। কালকে আর লঙ্কার খরিদ্দার পাওয়া যাবে না। তুই শুনলে বিশ্বাস করবিনি, লঙ্কার দাম যখন মদনপুরে আড়াইশো টাকা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে তখন এক ধরনের খরিদ্দাররা ফোনে ফোনে সব বাজারে জিজ্ঞেস করে নেয়, চাকদায় কত। সব দালাল আছে। ফোনে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেয়, সব মাল কিনে ফেল। পঁয়তাল্লিশ মিনিট একঘন্টার মধ্যে গোটা মদনপুর বাজার লঙ্কায় ভর্তি হয়ে যাবে। ট্রেনে দশ পনেরো মিনিট সময় লাগে। বস্তা বস্তা আসবে পরের ট্রেনেই। যেদিন চাকদায় রেট বেশি, মদনপুর থেকে সব মাল তুলে নিয়ে চাকদায় চলে যায়। চাষিরা কিন্তু এটা করতে পারে না, যে চাকদায় আজকে দাম বেশি, আমি চাকদায় নিয়ে চলে গেলাম। ক্ষমতাও নেই। সে মাঠে যাবে, না চাকদায় যাবে? তাছাড়া, তার কোনো সরঞ্জামও নেই। আর ওদের লরি, ছোটো গাড়ি সব রেডি। সবকিছুরই দালাল আছে। ফোনে ফোনে সব খবর হয়ে যায়। চাষি কোনোদিন ফোন টোন নিয়ে বাজারেও যায় না, অত সময়ও নেই। কিন্তু ওদের কাছে সব খবর আছে। কোলে মার্কেটেরও খবর আছে। এরা ঠিক আড়তদারও নয়। এদেরকে বলে ফরিদ খরিদ্দার, ফড়ে। এরা খুব চালাক। …

‘… যেই মমতা চাপ দেবে, অমনি ফড়েরাও চাষিদের দাম কম দেবে’

মমতাও চাষিদের উপকার করতে পারবে না। আমাদের ছোটো মাথায় এমনই বলে। মমতা ওখানে বসে যা করছে, সব আমলাদের কথা শুনেই তো করছে। চাষিদের সাথে ওর যোগাযোগ নেই। আর যেসব চাষির সাথে যোগাযোগ করেছে, তারা সব আমাদের মতো চাষি না, উঁচু চাষি। হয়ত তার একশো বিঘে জমি আছে, চাষ করছে দশজন। তার সাথে যোগাযোগ করেছে। একদম নিচু লেভেলে না এসে এসব ব্যাপার বুঝতে পারবে না। মমতা যে পলিসি করেছে, তাতে হবে না। আজকে ফড়েরা যে দামে চাষির কাছ থেকে কিনছে, তার ডবল দামে বিক্রি করছে। কিন্তু যেই মমতা চাপ দেবে, সঙ্গে সঙ্গে ফড়েরাও দাম কম দেবে।  বলবে, কিনব না মাল। এবার আমি ধর কুড়ি কিলো মাল নিয়ে গিয়েছি। সাতটা বেজে যাচ্ছে, খরিদ্দার পাচ্ছি না। ওরা একটা রেট বলছে, যা খুব কম। আমি হয়ত পঞ্চাশ টাকা পাল্লা পেলে বিক্রি করে দেব। ওরা বলল, তিরিশ। দিলাম না। খানিকক্ষণ পরে এসে ওরাই পঁচিশ টাকা পাল্লা বলা শুরু করল। তখন আমি চমকি খেয়ে যাব। এই মরেছি আমি। এই রকম লস আমরা মাঝেমাঝেই খাই। প্রত্যেকের সাথে এটা হয়। এবার আজকে ধর এটা হল। কালকে আমার মানসিকতা দাঁড়াবে, যা পাব প্রথমেই, তাতেই বিক্রি করে দেব। পরদিন চল্লিশ বলাতে বিক্রি করে দিলাম। পরে শুনলাম, আজ বেশি দাম গেছে। এবার মমতা যদি বেশি চাপ দেয়, তাহলে সব খরিদ্দার, ফড়ে আর খুচরো ব্যবসায়ী, সব এক হয়ে যাবে।
একটা যেটা করতে পারে, মাল ডাইরেক্ট বাজারে বেচা-কেনা করতে হবে। চাষিদের কাছ থেকেই কিনতে হবে। একটা প্রশাসনিক লোক থাকবে। কার কাছ থেকে মাল কিনেছ, সেটা খরিদ্দারের কাছে লেখা থাকতে হবে। এবং কত দামে কিনেছে, কতটা কিনেছে, সেটাও। বাজার কমিটিও এটা করতে পারে। যেমন গরুর হাটে হয় বলে শুনেছি। মাঝে মাঝে তদন্ত করতে হবে, খরিদ্দারের কাছে প্রশাসনের কেউ এসে দেখতে চাইবে রসিদ। পালটা চাষির কাছ থেকেও জানতে চাইবে, খরিদ্দার ঠিক বলছে কিনা।
আমি পনেরো বিশ বছর বাজারে যাই। প্রথম থেকেই এই ফড়েদের দাপট দেখছি। তবে আগে এত ব্যাপক হারে ছিল না। মোবাইলের যুগ ছিল না। মনে কর, বেলডাঙায় লঙ্কার দাম কত চলছে, সেটা তিনদিন চারদিন পরে শুনতে পেত ফড়েরা। এখন এক মিনিট লাগছে। যার জন্য এখন ব্যাপক হয়। জায়গা ভেদে মালের দামও আলাদা। বেলডাঙার লঙ্কার যা দাম, মদনপুরের লঙ্কার অত দাম হবে না। আবার মদনপুরের কপির দাম সবচেয়ে বেশি থাকবে।
কমপিটিশন 
এই যে খুচরো মার্কেটে বড়ো পুঁজির কথা আসছে, তাতে হয়ত প্রথমে চাষির ভালো হত। তারপরে খারাপ আছে। রিলায়েন্স যেমন বলছিল, চাষিদের কাছ থেকে ডাইরেক্ট মাল কিনব। মাঝে আর কিছু থাকবে না। ও একাই যা করবে। এতে ভোক্তাও কম পাবে দামে, চাষিরাও একটু বেশি পাবে। এই করতে করতে একসময় হয়ত দেখা যাবে যে যারা খুচরো মাল টাল কেনে, এরা আর থাকল না। এরা তো ওদের সাথে টেক্কা দিয়ে পারবে না। ক্ষমতা নেই। তখন ওরা যা দাম বলবে, তাই। ওরা তো আরেক ফড়ে। এখন তো তাও কমপিটিশন হচ্ছে। কোনো খরিদ্দার ভাবছে, আমি এক টাকা কেজিতে বেশি দিলেই ওই চাষি আমাকে দেবে। কমপিটিশন আছে। আমি যদি একটা ভালো মাল নিয়ে যাই, সেই মালটা কিন্তু কমপিটিশনে বিক্রি হচ্ছে। দাম বাড়ছে। এমনও দেখা গেছে, আমি চেয়েছি একঝুড়ি পঁচিশটা কপি হয়ত দুশো টাকা, কেউ হয়ত পটাং করে দুশো দশ টাকা বলে ফেলল। চাষি দেখল যে হয়েছে কায়দা। বলল, হবে না। আরেকজন বলল, তাহলে দে দুশো কুড়ি। এরকমভাবে হয়ত আড়াইশো টাকা দাম উঠে পড়ল। তবে সেটা কম। হয়তো বছরে একদিন এমন হয়। চাষিরা বাজারে যাওয়ার পথেই অন্য চাষিদের জিজ্ঞেস করে জেনে নেয় বাজার কেমন। হয়তো জানল, অন্য সব বাজার খারাপ, বেগুনের বাজারটা ভালো। বা লঙ্কার দামটা আজ এত।
তবে এর থেকে ভুল বোঝাও হয়। একবার শীতকালে আমি লঙ্কা নিয়ে গেছি, শুনলাম লঙ্কার পাল্লা চলছে ষাট টাকা। আমি তাই বললাম। সঙ্গে সঙ্গে একজন বলল, সব আমার। তারপর আমার কাছ থেকে নিয়ে, আমার ঝুড়ি, আমার পাল্লাতেই একশ’ টাকা পাল্লা বিক্রি করে দিল। পাঁচ পাল্লা মতো ছিল। সেই ফড়ে খরিদ্দার দুশো টাকা লাভ করে চলে গেল। আমি পেলাম তিনশো টাকা। পরে শুনলাম, আইরেট লঙ্কার পাল্লা ষাট টাকা। আমি যে লঙ্কা নিয়ে গেছি, তা ভালো জাতের। দাম বেশি। …

‘… তবে শুধু চাষি থাকলেও বাজার চলবে না, ফড়ে-ব্যবসায়ী লাগবেই’

মদনপুর বাজারের একটা নাম আছে। নামের একটা কারণ, এটা রেলস্টেশনের পাশে। রাত একটা থেকে তিনটে পর্যন্ত এখানে ব্যাপক মাল বিক্রি হয়। সারা বছর। ওইসময় মদনপুর স্টেশনে শুধু কালো মাথা দেখা যায়, এত ভিড়। ওই সময় কেউ কম মাল কেনে না। সব পাইকারি খরিদ্দার। মালও আসে দূর দূর থেকে। এখানে সুদূর বগুলা থেকেও মাল আসে। এক ব্যবসাদারের বাড়ি আমি গিয়েছিলাম, সে করে কি, দশ পনেরোটা চাষির কাছ থেকে মাল কিনে নিয়ে আসে মদনপুর বাজারে। সেখানে সে বিক্রি করে। ওর হাতে সেই চাষিরা। সে সন্ধ্যেবেলা ওদের সবার বাড়ি বাড়ি ঝুড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াবে, জিজ্ঞেস করবে মাঠ থেকে কী মাল তুললি? কেউ বলল, এক মণ বেগুন আছে, কেউ বলল পাঁচ কিলো টমেটো আছে। সব তুলে নিল। পয়সা-টয়সা কিচ্ছু দিল না। বিক্রি করে ফেরত গিয়ে পয়সা দেবে। কত দামে সে বিক্রি করল, চাষিরা কিছু বুঝতেই পারল না। ও লস খেলে চাষিদের কিছুই পয়সা দেবে না, চাষিদের লস। কিন্তু লাভ করলে ওরই লাভ। কিন্তু বগুলার ওই চাষিদের অন্য কোনো উপায়ও নেই, ওর কাছে দেওয়া ছাড়া। সে তো দূরে কোনো বাজারে নিজে যেতে পারবে না, ওইটুকু মাল নিয়ে সেই বগুলা থেকে মদনপুরে আসা লস, সময় নষ্ট, পয়সা নষ্ট।
তবে আড়তদার, ব্যবসায়ী, ফড়ে না থাকলে বাজার চলবে না। এককালে মদনপুর বাজার যাতে চাষিদের হাতে থাকে, তার জন্য আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক, মদনপুর বাজারে যদি শুধু চাষিরাই বিক্রি করত, তাহলে এটার এত রমরমা হত না। কারণ, কোনো খুচরো বা পাইকারি খরিদ্দার যখন মদনপুর থেকে মাল কিনতে আসছে, সে চায় এখান থেকেই তার সব মাল কিনবে। কপি, পটল, টমেটো থেকে আদা, রসুন — সব। এবার মদনপুরের চাষিরা কী কী মাল তৈরি করতে পারে? পটল, উচ্ছে, ঝিঙে, কপি এইসব। আমরা আদা তো আর করি না। আম এখানে কারও গাছে হয় না। এবার ব্যবসায়ী বা ফড়েরা এখানে সবকিছু নিয়ে আসে, ক্যাপসিকাম থেকে বিন, আদা রসুন পেঁয়াজ — সব এখানে নিয়ে চলে আসে। খুচরো বা পাইকারি খরিদ্দাররা মদনপুর বাজারে এসে সব পায়। এখান থেকে পটল, আর চাকদা বাজারে গিয়ে বিন কিনতে হয় না পাইকারি বা খুচরো খরিদ্দারদের।
১৯৯০ সাল নাগাদ এই নতুন মদনপুর বাজারটা তৈরি হয়েছিল। চাষিরা নিজের মনে করে বাজারটা করেছিল। কন্ট্রাকটরই করছিল, রেলের জমিতে, কিন্তু চাষিরা কেউ কেউ নিজেরাই কোদাল টোদাল নিয়ে মাটি কেটে দিয়েছিল এমনিই। তখন কেউ বুঝতে পারেনি এই অবস্থা হবে, বাজার আড়তদার আর ফড়েদের হাতে চলে যাবে। একসময় একটা চট পেতে বাজারে বসেছিল হয়তো কেউ, আড়ত করবে বলে। চাষিরা হয়তো মেরে তুলে দিয়েছে কয়েকবার। তারপর নেতারা বলেছে, ওকে তুলিস নে, ও আমাদের লোক, একপাশে থাক না। তারপর দশ বারো বছর পর সেই চটপাতা লোকই দশ চাকার লরি কিনে ফেলেছে দুটো তিনটে করে। কুমড়ো হয়তো নিয়ে আসছে পাঞ্জাব থেকে। তারা এখন চাষিদের চোখ রাঙায়, বলে, এই ওই মাল আমার আড়তে নিয়ে চল। এরকম করে প্রতিদিন বিশটা করে ঝুড়ি যদি আসে, প্রতি ঝুড়িতে কমিশন পঞ্চাশ একশো টাকা করে হলে দিনে হাজার দু-হাজার টাকা ইনকাম। এর জন্য কোনো খরচও নেই। আমাদের মাজদিয়া গ্রামের চাষিদের মধ্যে একতা আছে বলে তাদের জায়গাটা দখল হয়ে যায়নি এখনও।
তবে বাজারে চাষিদের একেবারে জায়গা থাকবে না, এটাও ঠিক না। আবার শুধু চাষি থাকলেও বাজার চলবে না।