৩১ ডিসেম্বর, জিতেন নন্দী, রবীন্দ্রনগর, মহেশতলা#
পরশু রাতে ঘুমের ঘোরে সকলের অগোচরে চলে গেলেন অনিল তপাদার। পাশে শুয়েছিলেন ওঁর স্ত্রী; পাশের ঘরে ছেলে, বউমা এবং নাতনি। কেউ টেরও পেল না। সকালে উঠে ডাকাডাকি করতে গিয়ে টের পাওয়া গেল চলে গেছেন তিনি। মহেশতলা রবীন্দ্রনগরের বাসিন্দা অনিল তপাদার ছিলেন নিতান্তই এক সাধারণ মানুষ। খুব বেশি কথা বলতেন না, কিন্তু সকলের সঙ্গে মিশতেন অকাতরে।
গল্প, প্রবন্ধ, এমনকী উপন্যাসও লিখেছেন, কিন্তু সাহিত্যিক হিসেবে কোনো বড়াই ছিল না। যুগান্তর, নব কল্লোল, যুবমানস, যোজনা-র মতো বড়ো পত্রিকায় লিখেছেন, কিন্তু মূলত তিনি ছিলেন লিট্ল ম্যাগাজিন তথা স্থানীয় পত্রিকা জগতের লেখক। রবীন্দ্রনগরের বাসিন্দা প্রয়াত সাহিত্যিক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর পত্রিকা ‘শৃন্বন্তি’র মধ্যে দিয়ে তাঁর লেখার জগতে উঠে আসা।
অল্প বয়সে বাবার হাত ধরে পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার চাওচা গ্রাম থেকে এসেছিলেন মেটিয়াবুরুজে। লেখাপড়া শিখেছেন অনেক কষ্ট করে বন্ধুর পথে। পুরুলিয়াকে বাংলার মধ্যে রাখার জন্য যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, তার সপক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে জেল খেটেছেন। প্রথম জীবনে পোস্টাপিস এবং পোর্টের চাকরি ছেড়ে দিতে হয় সেই কাজের গুনাগার দিতে। পরে সওদাগরি অফিসে চাকরি করেছেন; শেষে মিশনারি স্কুলে। বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সেই সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএম প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে অবশ্য প্রত্যক্ষ পার্টি-রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন।
তাঁর সমস্ত লেখার মধ্যে প্রথম গ্রন্থ ‘কলকাতার ছোট লখনৌ’ সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল। পরে লিখেছিলেন ‘রবীন্দ্রনগরের ইতিকথা’। ইদানীং বারবার গল্প করতেন তাঁর ছোটোবেলার গ্রামের কথা। তাঁর স্মৃতিচারণে ছবির মতো ভেসে উঠত বাংলাদেশের গ্রাম, মাঠ-গাছপালা, নদী-নালা-বিল, নৌকা বেয়ে স্কুলে যাওয়া, জলাশয়ে অফুরন্ত সুস্বাদু সব মাছ, আরও কত কী! আমরা লিখতে বলতাম। তবে বলতেই ভালোবাসতেন তিনি। গ্রামের দুর্গাপুজোর ভাসান নিয়ে সামান্য লিখেছিলেন একবার।
১৯৯৯ সালে আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় মন্থন পত্রিকার সূত্রে। বাবরি মসজিদ ভাঙা এবং পরবর্তী দাঙ্গা-হাঙ্গামার স্মৃতি তখন আমাদের মধ্যে সজীব।
আফগানিস্তানের বামিয়ানে বুদ্ধমূর্তি ভাঙার ঘটনার নিন্দায় আমরা সরব হলাম। তারপরে ঘটল গুজরাত গণহত্যা। এইসব দুঃখজনক ঘটনার পটভূমিতে মেটিয়াবুরুজ-মহেশতলার লিট্ল ম্যাগাজিন সম্পাদক-লেখক-পাঠকেরা একসঙ্গে ওঠাবসা শুরু করল। গড়ে উঠল একটা মঞ্চ ‘মাটির কেল্লা’। এই গড়ে ওঠার পর্বে সামনের সারিতে ছিলেন অনিল তপাদার। পরে অবশ্য ব্যক্তিগত কারণে ‘মাটির কেল্লা’র সঙ্গে সম্পর্ক থাকেনি।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
Leave a Reply