অমিতাভ সেন, ১৭ মার্চ ২০১২
সন্তোষপুর স্টেশনে বসে আছি। সন্ধ্যে আটটা তেইশের শিয়ালদা যাওয়ার গাড়ি বজবজ থেকে আসতে দেরি করছে। সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চিতে বসে দেখছি। হাঁটুর কাছে বসে আছে লুঙ্গি ও হাফশার্ট পরা ফলওয়ালা, ষাটের কোলে বয়স। সামনে প্ল্যাটফর্মে প্লাস্টিক পাতা। তার ওপর বিছানো আছে আপেল আর বেদানা। পাশে রাখা বস্তার ভিতরে কুচো কাগজের টুকরোয় জড়ানো ফলগুলো বারবার টিপে দেখছে। ডানহাতে ছুরি। আপেলের পচা অংশগুলো কেটে কেটে আরেকটা চটের বস্তায় রাখছে, আর কাটা আপেল সুন্দর করে সাজিয়ে সামনে রাখছে। যেগুলো একটু ভালো, বেশি পচেনি, সেগুলো একপাশে সরিয়ে রাখছে। স্টেশনে মার্কারি ল্যাম্পের আলো, প্ল্যাটফর্মের লোহার রেলিং ঘেঁষে দোকানের বাল্বের আলো খোলা বেদানার লাল টুকটুকে দানায় আর হলুদ আপেলে ঝিলিক মারছে। এই ঝিলিকের থেকেও বেশি রোশনাই দেখেছি এখানে এসে বসার সময়ে। তখন কালো লুঙ্গি, সবুজ চেকশার্ট আর রবারের চপ্পল পরা এক যুবক ফলের ডাঁইয়ের সামনে উবু হয়ে বসে খুচরো পয়সা গুনছিল। পাথুরে প্ল্যাটফর্মে তার পাশে হাফপ্যান্ট পরে প্লাস্টিকের চটি পায়ে দাঁড়িয়েছিল এক সাত-আট বছরের বালক। তাকে এই যুবক, তার বাবা, একটা বেদানা কিনে দিয়েছে। দশটাকায় একশো গ্রাম বেদানা, অনেক দরাদরিতে আট টাকায় কেনা হল। কালো প্লাস্টিকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে সেই বেদানার একটা-দুটো দানা মুখে ফেলে সেই বালকের কী হাসি।। সে উজ্জ্বলতার রোশনাই আরও বেশি চিকণ হয়েছিল পিছনে তার মা দাঁড়িয়ে থাকায়। অমন মলিন সায়ার আধহাত খালিপায়ের ওপর লুটিয়ে অমন রংচটা খাটো শাড়ি পরে অমন করুণামাখা চোখে এইসব কেনাবেচা কে আর দেখবে?
দক্ষিণ-পূর্বদিকে ওদের তিনজনের চলে যাওয়ার পথ বেয়ে একরাশ ধুলো উড়ে এল। আকাশে চৈত্রের মেঘ, গুমোটভাঙ্গা বাতাসে ফলওয়ালার গলা ‘ঝড় উঠবে নাকি?’ আমার কাঁধের ব্যাগে নিজেদের বাড়ির গাছ থেকে তুলে যে টমাটোগুলো বন্ধুরা গুছিয়ে দিয়েছিল সেগুলো অন্ধকারে গুমরাচ্ছে। ‘হাফ কিলোয় পনেরো টাকা’, ‘হাফ কিলোয় কুড়ি টাকা’ – থেকে থেকে হাঁক দিচ্ছে ফলওয়ালা একবার কাটা আপেল আর একবার গোটা আপেলের দিকে আঙ্গুল তুলে। ফলওয়ালা পাশেই স্টিলের বাসনের দোকান লাগিয়েছে একজন ছোকরা। চোগা-চাপকান পরা, এককানে দুল, এককানে মোবাইলের তার গুঁজে গানের তালে তালে মাথা নাড়ছে সেই শৌখিন যুবক। থালা, গামলা, বাটির দোকান তার। সে ফলওয়ালার সাথে রগড় করছে — ‘একটাকা দু-টাকা কিলো হয় তো পাঁচকিলো দিয়ে দাও। ও পচা ফল তোমার কেউ নেবে না, ফেলে দিতে হবে’। ফলওয়ালা গলা তুলছে, ‘ওঃ, পচা আলু কেটে বেচে দিচ্ছে, আর আমার তো আপেল’, তারপর পাশে বসা আর একজন বুড়ো লোককে বলছে, ‘মানুষের পেট হু-হু করে জ্বলবে আর গানেই সব মস্তি হয়ে যাবে। সবসময় প্যাঁপ্যাঁ করি বাজতিছে’। যার উদ্দেশ্যে এই টিপ্পনী সেই বাসনের দোকানি তখন প্ল্যাটফর্মের ধারে গেছে পানপরাগের পিক্ ফেলতে।
হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল, ঝুপ করে অন্ধকার। বাসনের দোকানদার এসে ফলওয়ালাকে বলল, ‘তোমার জন্যই কারেন্ট চলে গেল। পচা পচা ফল বেচছো’। তার কিন্তু তখনো পর্যন্ত একটাও খদ্দের আসেনি। ফলবিক্রেতা বোধহয় সেইজন্যই বলে চলেছে, ‘দাঁড়া না তোর পাশে বসেই সবকটা বেচব। না হলে ট্রেনে উঠলেই সব বিক্রি হয়ে যাবে’। তার উত্তরে বাসনওয়ালা চেঁচায়, ‘ওই তো ট্রেন আসছে, উঠে পড়ো, উঠে পড়ো’। সত্যিই ট্রেন এসে গেল। আমি উঠতে উঠতে দেখলাম ফলব্যাপারীর কোনোরকম নড়াচড়া নেই — সে হাসছে আর বলছে, ‘আরে উঠলেই তো সব শেষ হয়ে যাবে’।
Leave a Reply