শমীক সরকার, কলকাতা, ৯ মে#
একদিকে সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ (বিচারপতি লোধা এবং অন্যান্যদের) জাতীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই-কে উপদেশ দিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের পোষা তোতা হয়ে না থাকতে এবং শিকল কেটে উড়তে। অন্যদিকে একই সময়ে সুপ্রিম কোর্টের আরেকটি বেঞ্চ (বিচারপতি রাধাকৃষ্ণণ এবং বিচারপতি দীপক মিশ্র-র বেঞ্চ) কেন্দ্রীয় সরকার এবং পরমাণু প্রতিষ্ঠানগুলি — যথা এইআরবি, এইসি, আইএইএ, এনপিসিআইএল প্রভৃতি — এদের বাঁধা বুলিই কুদানকুলাম নিয়ে ৬ মে দেওয়া রায়ে পাতার পর পাতা লিখে গেছে। কুদানকুলাম প্রকল্পের কমিশনিং স্থগিত করার আর্জি জানিয়ে চেন্নাই-এর একটি পরিবেশ সংগঠনের করা পিটিশন খারিজ করে দিয়েছে ওই বেঞ্চ। পরমাণু বিদ্যুতের ওপর যাদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল, সেইসব প্রতিষ্ঠানের অন্যায় দাবিগুলির পক্ষে সওয়ালের কিছু নমুনা নিচে দেওয়া হলো :
- পরমাণু প্রতিষ্ঠানগুলি, যথা অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন (AEC), এবং অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড (AERB) বক্তব্যকে শেষ কথা বলে ধরে নিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের দীপক মিশ্র এবং কে এস রাধাকৃষ্ণণের বেঞ্চ।
- পরমাণু লবির দাবি, ‘পরমাণু শক্তি পরিষ্কার, নিরাপদ, নির্ভরশীল এবং সস্তা’ — এই দাবিগুলি বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছে এবং এর পক্ষে সওয়াল করেছে কোর্ট
- ফুকুশিমা বিপর্যয় পরবর্তীতে পরমাণু শক্তি যে সারা পৃথিবী জুড়েই পড়তির দিকে, তার কোনও উল্লেখ না করে বরং পরমাণু বিদ্যুৎ সম্পর্কে এক সোনালি ছবি আঁকা হয়েছে, যা কেবলমাত্র পরমাণু-পাগলদের কাছেই শোনা যায়।
- ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি, যা একটি পরমাণু প্রতিষ্ঠান এবং যা নিজের অস্তিত্বের খাতিরেই পরমাণু শক্তির সোনালি ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে দায়বদ্ধ, তাদের ২০০৮ সালের দাবির ওপর ভিত্তি করে, ‘ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য ২০৫০ সালের মধ্যে তিনগুণ পরমাণু বিদ্যুৎ প্রয়োজন’ — এর পক্ষে সওয়াল করেছে কোর্ট
- এইআরবি-র সেফটি কোডটি ১২ পাতা জুড়ে ব্যাখ্যা করেছে রায়
- কুদানকুলামের ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় জ্বালানি কোথায় ফেলা যায়, তা নিয়ে অনেক কথা বলেছে রায়। কিন্তু এটা শুধু কুদানকুলামের ইস্যু নয়, সারা পৃথিবীর সমস্ত পরমাণু চুল্লির সমস্যা, যার এখনও পর্যন্ত কোনও সমাধান হয়নি। রায়ে তার কোনও উল্লেখ নেই।
- কুদানকুলামে বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা মহড়া না করেই কমিশনিং করা হচ্ছে, পরমাণু প্রতিষ্ঠানগুলির নিজেদেরই চালু করা এই আইন অমান্য করা হচ্ছে কুদানকুলামে, সে বিষয়ে উল্লেখ নেই রায়-এ।
- পরমাণু প্রতিষ্ঠানগুলির নিজেদের তৈরি করা আইনেই আছে, প্রকল্পের দেড় কিলোমিটারের মধ্যে কোনও জনবসতি থাকতে পারবে না। কিন্তু কুদানকুলামের ৭০০ মিটারের মধ্যে রয়েছে সুনামি কলোনি — এই বেআইনি বিষয় নিয়ে কোনও উল্লেখ নেই রায়-এ।
- পরমাণু প্রতিষ্ঠানগুলির নিজেদের তৈরি আইনেই আছে, পরমাণু প্রকল্পের পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ২০ হাজারের বেশি জনসংখ্যা থাকতে পারবে না। রায়-এ উল্লেখ আছে, এই জনসংখ্যা ২৪ হাজার। কিন্তু সেটা ২০০১ এর জনগণনা — ২০১১ সালের জনগণনার হিসেবটি রায়-এ উল্লেখ নেই।
- রায়-এ ভারত যাতে পরমাণু-বিচ্ছিন্ন দেশ না হয়ে পড়ে, তার সাবধানবানী শোনানো আছে। বস্তুত, পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া বাকিরা পরমাণু-বিচ্ছিন্ন, এবং ২০১১ সালের ফুকুশিমা বিপর্যয় পরবর্তীতে বেলজিয়াম, ইতালি, জাপান, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশগুলি সচেতনভাবে পরমাণু-বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগেই সচেতনভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশগুলি।
- কোস্টাল রেগুলেশন জোন আইন যে ভাঙা হয়েছে কুদানকুলামে, তার কোনও উল্লেখ নেই রায়-এ — বরং এই আইন ভাঙা-কে কোর্টের সিলমোহর দেওয়া হয়েছে।
- রায়ে বলা হয়েছে, তেজস্ক্রিয়তার সুদূরপ্রসারী কুফল-এর ভয়ের কোনও ভিত্তি নেই এবং ভবিষ্যতে কি হবে তা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। একইসাথে রায়ে বৈজ্ঞানিক মনন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে!
Leave a Reply