রামজীবন ভৌমিক ও শঙ্খ্যজিৎ দাস, ২৮ ডিসেম্বর#
মধ্য হলদিবাড়ির বেশিরভাগ অংশ আসামের কোকরাঝাড় জেলায়। কুমারগ্রাম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পূর্ব দিকে মধ্য হলদিবাড়ির দক্ষিণাংশে মধ্য-হলদিবাড়ি শরণার্থী শিবির। একটিমাত্র ত্রিশ ফুট বাই চল্লিশ ফুট ঘর। পাকা দেওয়াল ও টিনের ছাওনি দেওয়া ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের তৈরি স্থানীয় কমিউনিটি হল। ২৬ ডিসেম্বর শুক্রবার থেকে ১০৬জন সাঁওতাল ও দুজন ওরাও, এই ১০৮জন ভিটেমাটিহীন মানুষের ঠিকানা এখন কমিউনিটি হল। চারপাশে কৃষিজমি। তার পাশে শ্যামল দাসের বাড়ি। শ্যামল দাস শরণার্থীদের পরিষেবায় বিশেষ যত্ন নিচ্ছেন। ছয়জন সি আর পি এফ জওয়ান বন্দুক উঁচিয়ে পাহারা দিচ্ছেন। কমিউনিটি হল থেকে অদূরে পলিথিন ঘেরা অস্থায়ী টয়লেট। ঘরের মেঝেতে খড় বিছিয়ে বিছানা করা। ‘টুয়েলভ ইয়ার্স আ স্লেভ’ সিনেমায় দেখা ক্রীতদাস ক্রয়বিক্রয়ের দৃশ্যে সারিসারি বসে থাকা কৃষ্ণকায় অধোবদন অসহায় শিশু-কিশোর-কিশোরীদের মতো নারীপুরুষের নিশ্চুপ নিস্তব্ধ বসে থাকা। ১০৮ জন শরণার্থীর মধ্যে শিশু কিশোর কিশোরীর সংখ্যা ৪৬ জন। তিনজন দুধের শিশুও চোখে পড়ল। গত শনিবার ২৭ ডিসেম্বর বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ ও গৌতম দেব পরিদর্শন করে গেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে আসেননি। স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ল। সেলফ হেল্প গ্রুপ রান্না করা খাবার পরিবেশন করছে। শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোন অভিযোগ পাওয়া গেল না।
২৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা আসামের শোণিতপুর, এবং চিরং জেলার পাঁচটি জায়গায় এনডিএফবি (সংবিজিত) গোষ্ঠীর ধারাবাহিক হামলায় মৃত সাঁওতাল ও ওঁরাও মানুষদের খবর আলিপুরদুয়ার ও কোকড়াঝাড় বর্ডারের কুমারগ্রাম লাগোয়া গ্রাম — ফুলকুমারি, বালাগাও, ড্যামড্যামা ও সংকোশ নদীর টাপু (চর)-এ এসে পৌঁছায়। এখানকার সাঁওতাল মানুষেরা আতঙ্কিত হতে থাকে। কুমারগ্রাম থেকে ৮-৯ কিমি দূরে আসামের কচুগাও অঞ্চলে সাঁওতাল হত্যা শুরু হয়। বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালের হত্যালীলার অভিজ্ঞতা থেকে সবাই খুব ভয় পেয়ে যায়। সবাই জান বাঁচাতে ২৫ ডিসেম্বর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পরে। হঠাৎ যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল সেখান থেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলে যায়। একদিন এক রাত গভীর বনের মধ্যে থেকে সংকোশ নদী পেরিয়ে কুমারগ্রামের কাছে চলে আসে। অনাহারে আর ঠাণ্ডায় এত শিশু কিশোর বৃদ্ধ-বৃদ্ধার অসহায় অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে মধ্য হলদিবাড়ির স্থানীয় মানুষদের চোখে জল চলে আসে। ২৬ ডিসেম্বর শীতবস্ত্রহীন ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে যাওয়া শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পায় স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতায়।
আশ্রয় শিবিরে কথা হল বয়স চল্লিশের সিতো হেমব্রমের সাথে। পেশায় দিনমজুর, চার সন্তানের মা। সন্তানদের বয়স দু-বছর থেকে সাতবছর। কিছুদিন আগেই স্বামীকে হারিয়েছেন। স্বামী চাষের কাজে গিয়ে হাতির পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন। মুখে শোকের অন্ধকার নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন। সন্তানেরা ঘিরে বসে আছে। তাদেরও চাঞ্চল্য আজ উড়ে গেছে।
কমিউনিটি হলের এক কোণে লালু সোরেনও নির্বাক পাথরের দৃষ্টি নিয়ে একদৃষ্টে কি যেন দেখছেন। দুই সন্তান লালু সরেনের কাছে থাকলেও ওদের মায়ের কোন খোঁজ নেই। আশেপাশের তিনটি শরণার্থী শিবিরে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেছেন কোথাও ওদের মায়ের খোঁজ নেই। আরেকজন শরণার্থী জানালেন খোঁজ নেই মানে তার জীবিত থাকার আশা লালু সরেন করছেন না।
শ্রী মণি মূর্মু নামে দুই কাকাতো-জ্যাঠাত বোন বালাপাড়া এম পি স্কুলের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। আত্মীয়বাড়ি ঘুরতে এলে আসামজুড়ে জঙ্গিহানার আতঙ্কের মধ্যে পড়ে গিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। এখন মধ্যহলদিবাড়ি শরণার্থী ক্যাম্পই ওদের ঠিকানা। বাবামায়ের খবর ওদের অজানা। বেঁচে আছে কি? এই প্রশ্ন ওদের তাড়া করে ফিরছে।
Leave a Reply