রীণা মণ্ডল, হাবড়া, ২১ আগস্ট#
হাবড়া থেকে সকাল সাতটা পঞ্চাশের বনগাঁ শিয়ালদা মাতৃভূমি লোকালের একজন নিত্যযাত্রী আমি, ১৯ আগস্ট বুধবার ট্রেনে যাচ্ছি। সহযাত্রীদের কথায় কথায় মাতৃভূমি লোকালে তিনটে কম্পার্টমেন্ট জেনারেল করা নিয়ে আলোচনা। তাদের কথায় এই নিয়ে খড়দার মেয়েদের প্রতিবাদের কথা উঠে আসছিল। কেউ কেউ বলাবলি করছিল, আজ এই ট্রেনটা বারাসত গেলে আমরা মাতৃভূমি লোকালের কম্পার্টমেন্ট জেনারেল করা নিয়ে অবরোধ করব। কিছুক্ষণের মধব্যে চারটি স্টেশন পেরিয়ে ট্রেন এসে বারাসতের আগে বামুনগাছি স্টেশনে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে গেল।
হঠাৎই মেয়েদের মধ্যে থেকে জনা কুড়ি মেয়ে, ‘আমরা এখানেই অবরোধ শুরু করব’ বলতে বলতে নেমে গেল। আমরা ছিলাম ট্রেনের পেছনের দিককার কম্পার্টমেন্টে (কত নম্বর কামরা সেটা আর বলছি না, টার্গেট হয়ে যাবে)। সামনের দিকে যেতে যেতে সকল কম্পার্টমেন্টের মেয়েদেরই ডাকা হলো একসাথে এগিয়ে আসার জন্য। ধীরে ধীরে ট্রেন থেকে হাজারখানেক মেয়ে ট্রেনের সামনে চলে এল। রেললাইনে নেমে তারা ট্রেন অবরোধ শুরু করে দিল। আমিও তাদের পেছন পেছন চলে এলাম।
এমনি করেই আধাঘন্টা অবরোধ চলল, হঠাৎই ওই মাতৃভূমির জেনারেল কম্পার্টমেন্ট থেকে শ-দুয়েক পুরুষ যাত্রী নেমে এসে অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য চেঁচামেচি শুরু করে দিল। মেয়েদের কেউ কেউ ছেলেদের বোঝাতে চেষ্টা করল — বনগাঁ লাইনে বারো বগির ট্রেন চালু করা দরকার, আর লেডিজ স্পেশালে ছ’টি কম্পার্টমেন্ট জেনারেল হোক বাকিটা লেডিজ — এই আমরা চাইছি। ছেলেরা ‘লেডিজ স্পেশাল একেবারে তুলে দেব’ বলে চিৎকার শুরু করল।
কিছুক্ষণের মধ্যে ছেলেদের দিক থেকে শুরু হয় খিস্তি খেউড় — ‘এই মেয়েরা সব সোনাগাছি যায়’, ‘এদের এমনই ব্যবহার’, ‘যায় তো ঝি-গিরি করতে’, ‘ট্রিপ মারতে যায়’, ‘এসব ট্রেন তুলে দেওয়াই উচিত’ ইত্যাদি। অদ্ভুত ইঙ্গিতে ‘ও বুলাদি’। এর সঙ্গে অদ্ভুত সব অঙ্গভঙ্গী, ভয়ঙ্কর টিজিং চলতে থাকে। হঠাৎ মাঝবয়সী মহিলাদের একজন চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘তোরা তো সোনাগাছি যাস, তাই তো জানিস, আমরা কোথায় যাই’। তবুও বেশিরভাগ মেয়েই শান্তভাবে অবরোধটা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
হঠাৎই মাঝবয়সী পুরুষদের একাংশ অল্পবয়সী ছেলেদের খেপিয়ে তোলে, প্লাটফর্ম থেকে রেললাইনের অবরোধকারী মেয়েদের মধ্যে তাদের ঠেলে দেয়। এসব ছেলেরা উৎসাহিত ও উত্তেজিত হয়ে মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেয়েরা অপ্রস্তুত হয়ে নিজেদের সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্লাটফর্মের ওপরের দিকটা প্রায় পুরুষদের আর রেললাইনের শত শত মেয়ের মাঝে কিছু বেপরোয়া ছেলে আমাদের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে দেয়। মেয়েরা লাইনের ওপর পড়ে যায়। পুরুষ সহযাত্রীরা এই বীভৎসতা প্লাটফর্মের ওপরে দাঁড়িয়ে মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলতে থাকে। আর সহযাত্রী পুরুষরা কীভাবে মেয়েদের শ্লীলতাহানি করছে তা উপভোগ করতে থাকে। মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ মাথায় চোট পায়, কানে লাগে, গায়ের জামা ছিঁড়ে যায়।
অতি দ্রুততার সঙ্গে আমি লাইনের ধারে লতাপাতার মধ্যে থেকে যশুরে লতা খুঁজে মেয়েদের ক্ষতস্থানে প্রাথমিক চিকিৎসায় লেগে পড়ি। উত্তেজিত মেয়েদের হাত থেকে পাথর কেড়ে নিই। তাদের চিৎকার করে বলতে থাকি, কেউ পাথর ছুঁড়বে না। মেয়েরা পরিস্থিতির সঙ্গে অসহায়ভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করে। এরই মধ্যে দেখি, পাশে এক সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ মানুষ মেয়েদের পাশে এসে রেললাইনে দাঁড়িয়েছেন। ছেলেদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদে ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘দেখি নেমে আয়, মেয়েদের ওপর হামলা কর। আয় দেখি’। এই একটা ব্যতিক্রমী মানুষ।
আবার আর একটি বছর তিরিশ বয়সের ছেলে বেশ মারমুখী হয়ে এরই মধ্যে বলতে থাকে, ‘এই যে কাজে যেতে পারলাম না, আজকের রোজের দাম দিবি তোরা। দিয়ে দে। এক্ষুনি দিতে হবে।’
হঠাৎ-ই ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া এসে ছবি তুলতে লেগে পড়ে। তারা আবার বেছে বেছে বেশ স্মার্ট সুন্দরী দেখে ক্যামেরা তাক করতে থাকে। আমাদের অবরোধের দিকটা যে বনগাঁ লাইনের সকল যাত্রীর জন্যই ছিল — বারো বগির ট্রেন চালু, আর মাতৃভূমিতে জেনারেল বগি তিনটের বদলে ছ’টা জেনারেল — সে কথাটা চাপা পড়ে গেল। ব্যাপারটা দাঁড়ালো এরকম, মাতৃভূমিতে জেনারেল কম্পার্টমেন্ট থাকবে না।
তিন দফায় ছেলেমেয়েদের এমন ধস্তাধস্তি চলার পর এল রেল পুলিশ। তারা মেয়েদের বলল, তোমরা উঠে যাও। নাহলে আমাদের কিছু করার নেই, অবরোধ তুলে নাও। পুলিশের এই কথা শুনে পুরুষ যাত্রীরা প্রচণ্ড উৎসাহিত হয়ে হাতে তালি দিয়ে চিৎকার করতে লাগল। মেয়ে পুলিশের একজন বিশেষ তৎপরতার সাথে আমাদের জোর করে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতে তারই সহকর্মী পুরুষ পুলিশ অফিসার তাকে বকে বলল, ‘আপনি সবে চাকরিতে জয়েন করেছেন। আপনি এগিয়ে যাচ্ছেন, আপনি কী বোঝেন? এদিকে চলে আসুন’। তিনি সরে গেলেন। এরপর আরো ওপর তলার অফিসার এসে জানালো, ‘আপনারা যদি এখনো সরে না যান, আমাদের কিছু করার নেই, আপনারা সারাদিন বসে থাকুন। আপনাদের দায়িত্বে।’ আবার তারা লিখিতভাবে অভিযোগ করতেও বললেন। মেয়েদের মধ্যে থেকে কয়েকজন বলল, ‘আমরা প্রচুর যাত্রীর স্বাক্ষর করে অভিযোগ জানিয়েছি। কোনো ফল পাইনি। তাই এই অবরোধের পথ ধরেছি।’ আমাদের কেউ লিডার ছিল না, আমরা সবাই কথা বলছিলাম। আমি তো সই করে লিখিত দেওয়ার কথা বললাম। কিন্তু অন্যরা রাজি হলো না। তাই আর আবেদন লেখা হলো না। আরো অনেক অনেক পুলিশ জড়ো হলো, বেলা বাড়ল, প্রায় বারোটা নাগাদ মেয়েরা অবরোধ তুলে নিল। আবার ট্রেন চলতে শুরু করল।
ট্রেন মধ্যমগ্রামে পৌঁছতেই আবার ঝামেলা শুরু। এবার ছেলেরা অবরোধ শুরু করেছে, ট্রেন যেতে দেবে না। তাদের অভিযোগ, এই ট্রেনের (মাতৃভূমি) মেয়েরা লেডিজের জন্য নির্দিষ্ট কম্পার্টমেন্ট ছেলেদের উঠতে দেয়নি। মেয়েরা নাকি গালাগালি করেছে — ছেলেদের বলেছে, ‘তোরা যা গিয়ে, তোদের মায়ের পাশে গিয়ে শো।’ এবার ট্রেন থেমে থাকে। ছেলেদের কেউ কেউ চড়াও হয়, লাঠি দিয়ে ট্রেন পেটাতে থাকে। জানলায় মারতে থাকে। গালিগালাজ করে। একটি মেয়ে মোবাইলে ছবি তুলবার চেষ্টা করছিল। তৎক্ষণাৎ তাকে বলল, ‘তোর মোবাইল যে কোথায় যাবে, খুঁজেও পাবি না …’। মেয়েটা দ্রুত মোবাইল বন্ধ করে লুকিয়ে ফেলে। আমরা কয়েকটি মেয়ে একজোট হয়ে লেডিজ স্পেশালেরই লেডিজ কম্পার্টমেন্টেরই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি, যাতে হঠাৎ করে ছেলেরা কম্পার্টমেন্টের মধ্যে ঢুকে কিছু না করতে পারে। ভদ্রবেশী চাকুরে ছেলেরাও চিৎকার করে হুমকি দিচ্ছে — ‘ট্রেন থেকে নাম — এ ট্রেন যাবে না। কেউ ট্রেনে থাকবি না …।’ সেই বামুনগাছি থেকে অনেক ছেলে গালাগাল দিতে দিতে আসছে। এরপর আবার পুলিশ আসে। তখন মধ্যমগ্রামের অবরোধ উঠে যায়।
বেলা গড়িয়ে যায়। অনেকেই টিফিন করতে শুরু করে। মেয়েরা অনেকেই ছেলেদের মধ্যে কাউকে কাউকে ডেকে বলে — ‘আসুন ভাই, আসুন দাদা, আমরা একসাথেই বসে খাবো। যা আছে ভাগ করে খাওয়া যাক।’ খেতে খেতে একটি মেয়ে বলে, ‘আজ অবরোধ করতে গিয়ে আমার একটা পরীক্ষা দেওয়া হলো না।’ আর একটি ছেলে বেশ দুঃখে আর ক্ষোভের সাথে বলে, ‘আমারো এ-বছরে আজকের পরীক্ষাটা দেওয়া হলো না।’ ওর জন্য আপশোস হলো।
অবরোধ চলছে, উঠছে, চলছে। আর দেখা না দেখা বিভিন্ন অভিযোগ ও গুজব সব ছড়িয়ে পড়ছে মোবাইল থেকে মোবাইলে। তবু মাতৃভূমি স্পেশাল ট্রেন এর বিষয় নিয়ে রাস্তাঘাটে বাসে অটোতে চলতে ফিরতে কতই না কথা বার্তা চলছে। সেই কবে ট্রেনটা চালু হয়েছিল, তখন পুরুষ যাত্রীদের কেউ কেউ চিৎকার করে বলেছিল, ‘দুধের গাড়ি যাচ্ছে।’ এই গাড়িতে যেতে যেতেই দেখেছি, পঞ্চাশোর্ধ যেসব মহিলারা ঠিকমতো যাতায়াত করার ক্ষমতা নেই, গ্রামে থেকে কোনো কাজকর্ম করতে পারছেন না, তারা এই ট্রেনের জন্যই শহরে গিয়ে কিছু কাজকর্ম করতে পারছেন — কেউ বা ভদ্রলোকের বাড়ির গৃহপরিচারিকা (ওদের কথায় ঝি-এর) র কাজ করে কোনোমতে বেঁচে আছেন। কিন্তু সকালের দিকে অন্য কোনো বনগাঁ লোকালের যাতায়াত করার দুঃস্বপ্ন দেখারও সাহস তারা করতে পারবেন না। এছাড়া দেখেছি, আগে আয়ার কাজে বারো ঘন্টার ডিউটি করতে যারা বাধ্য হতো, এখন সকাল বিকাল মাতৃভূমি ট্রেনে আসা যাওয়া করে তারা কেউ কেউ ছয় ঘন্টা কিংবা আটঘন্টা অথবা কেউ কেউ দশ কিংবা বারো ঘন্টাও ডিউটি করছে নিজের খুশিমতো। এটা কিন্তু কর্তৃপক্ষ মেনেও নিয়েছে।
শুরু থেকেই মাতৃভূমির ভ্যান্ডারে কিছু পুরুষযাত্রী নিয়মিতই যাতায়াত করেন। আর সন্ধ্যেবেলা ফেরার পথে দত্তপুকুরের থেকে বনগাঁ মাতৃভূমিতে পুরুষ যাত্রীরা যাতায়াত করেন, কিছু ছোটোখাটো বিরোধ হয়। কোনো কোনো ছেলেমেয়েদের মধ্যে। কিন্তু সকলের মধ্যে কখনোই হয় না। প্রচুর অসুস্থ-বৃদ্ধ-শিশুরা যাতায়াতের জন্য এই ট্রেনটিই এখন বেছে নিয়েছে। প্রেগন্যান্ট মেয়েদের একমাত্র ভরসা একমাত্র এই ট্রেনটাই। কত অক্ষম অসুস্থ ভিখারী এই ট্রেন অবলম্বন করেই কোনোরকমে বেঁচে আছে। আবার এই ট্রেনটাই একটু ফাঁকা থাকে বলে হকারদের যা একটু বিক্রিবাটা হয়।
আমি তো সাধারণ ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্টেই নিত্য যাতায়াত করছিলাম আগে। দাদা দিদি ভাই বোন মামা মাসী কাকা দাদুদের সাথেই। একই সাথে সুবিধা অসুবিধা ভাগাভাগি করে একে অপরের জন্য সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে বসে চলছিলাম। এমনি চলতে চলতে একদিন গেটের কাছে একজনকে বলেছিলাম, ‘ভাই একটু ঠিক হয়ে দাঁড়াও।’ সে এমন সব বাজে কথা বলতে শুরু করল, অন্য সকল যাত্রীরা এমন নীরব থাকলো, সেদিনের অপমান লজ্জা দুঃখে এখন সেই থেকে লেডিজ কম্পার্টমেন্টে যাতায়াত করি সাধারণ ট্রেনগুলোতে। এমন কতই না অভিজ্ঞতা হয়েছে। একদিন হাবড়ায় নামবো বলে আগের স্টেশন অশোকনগরে গেটের কাছে এগিয়ে এসেছি, আচমকা নিচ থেকে একটা ছেলে লেডিজে পাথর ছুঁড়লো। পায়ের হাড়ের কাছটায় ক্ষত হলো। ফুলে উঠল। অনেকদিন লেগেছিল ক্ষত সারতে। কিন্তু আজও সেই দিনের কথাটা মনে পড়ে।
লেডিজ স্পেশাল নিয়ে এই যে অবরোধ আন্দোলন এরপরও অনেকে অনেক রকম কথা বলছে। তবুও কিছু কথা কোথায় যেন কানে ঠেকছে। যেমন, এম এ বি এড পাশ শিক্ষিতা টিচার হওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর দুটি মেয়ে বললো, মাতৃভূমি লোকাল তুলে দেওয়াই উচিত। অথচ দিনের পর দিন তারা নিজেরা সাধারণ ট্রেনের লেডিজে যাতায়াত করে, অথচ কিছুতেই জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠবে না। মেয়েদের মধ্যে আবার কেউ কেউ বলছে, লেডিজে যখন জেন্টসদের উঠতে দিচ্ছে না, তখন জেন্টস-এও মেয়েদের উঠতে দেবে না। ওই মেয়েরা জানেই না, কেবল জেন্টসদের জন্য কোনো ট্রেন নেই, ওটা জেনারেল কম্পার্টমেন্ট, অর্থাৎ সর্বসাধারণের জন্য। এরপর জেনারেল কম্পার্টমেন্টে একটি মেয়ে উঠেছিল, তাকে পুরুষ যাত্রীরা কিছুতেই তার গন্তব্য বারাসতে নামতে দেয়নি, গর্বভরে পুরুষদের মুখে মুখে এই বীরত্বের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। আর ইতিমধ্যে মন্ত্রীরা ঘোষণা করেছে, যেমন চলছে, চলবে।
সাক্ষাৎকার ও অনুলিখন বঙ্কিম
Leave a Reply