শমীক সরকার, ১১ জুলাই, তথ্যসূত্র রাইজিং কাশ্মীর, কাশ্মীর টাইমস#
শুক্রবার কাশ্মীরের নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিন-এর একুশ বছর বয়সী কমান্ডার, উপত্যকার পরিচিত মুখ বুরহান ওয়ানি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর থেকে উপত্যকা, বিশেষ করে দক্ষিণ কাশ্মীরের ত্রাল (ওয়ানির বাসস্থান এই ছোট্ট শহর), পুলওয়ামা, শোপিয়ান, বিজবেহারা ইত্যাদি এলাকায় হাজার হাজার যুবক কার্ফু উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে পড়েছে। হাতে পাথর নিয়ে ছুঁড়তে থাকা এই বিদ্রোহী যুবকদের ওপর সমস্ত জায়গায় লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস, এবং বেশ কিছু জায়গায় গুলি বর্ষণ করে চলেছে নিরাপত্তা বাহিনী। তাতে শনিবার থেকে সোমবার রাত অবধি মারা গেছে ৩১ জন। এদের মধ্যে দু-জন শিশু এবং একজন মহিলা। দ্বিশতাধিক মানুষ গুরুতর আহত আহত। মোট আহত দেড় হাজারের ওপর। মৃতদের মধ্যে একজন পুলিশের গাড়ির ড্রাইভার।
শনিবারের পর রবিবারও উপত্যকার হাজার হাজার মানুষ ওয়ানির বাসস্থান ত্রাল শহরে ছুটে গেছে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। এইখানে জমায়েত মানুষেরা কাশ্মীরের আজাদির পক্ষে, ইসলামের পক্ষে, বুরহানের পক্ষে এবং ভারত বিরোধী স্লোগান দিতে থাকে। পুলিশ ও সিআরপিএফের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়।
শনিবার ৯ জুলাই সকাল থেকেই হাজারে হাজারে মানুষ, বেশির ভাগ যুবক, দক্ষিণ কাশ্মীরের প্রায় সমস্ত শহরে রাস্তায় নামে, কার্ফু উপেক্ষা করে। অনন্তনাগের লাল চক এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে পাথর নিয়ে খন্ডযুদ্ধে নেমে যায় তারা। পুলিশও গুলি চালাতে শুরু করে।
রবিবার ১০ জুলাই সকাল থেকেই পুলওয়ামার নেওয়া এবং লসসিপুরায় বিপুল সংখ্যক যুবক প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা — পাথর হাতে ছুঁড়তে থাকে। লাঠি চার্জ ও কাঁদানে গ্যাস চালিয়ে প্রতিবাদ থামাতে ব্যর্থ হলে গুলি চালাতে শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনী, তিনজন প্রতিবাদী যুবক (গুলজার পন্ডিথ, মুজাফফর হোসেন, ইরফান মালিক) মারা যায়। কাজিগুন্দ-এ পুলিশ ও সিআরপিএফ এর সঙ্গে পাথর ছুঁড়ে সংঘর্ষ চালানোর সময় পুলিশের গুলিতে মারা যায় যুবক মাসুক আহমেদ।
পুলিশ-সিআরপিএফ এবং বিশাল সংখ্যক প্রতিবাদী যুবকদের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধের ঘটনা ঘটে দক্ষিণ কাশ্মীরের শোপিয়ান, রাজপুরা, হল পুলওয়ামা, লিটার, তাহাব পুলওয়ামা, তাঞ্চিবাঘ পাম্পোর, দামহাল, সঙ্গম, জাইনাপোরা, কোইমো, ইয়ারিপোরা, বেহিবাঘ কুলগাম, ভাইলু, ওয়ারপোরা সোপোর, টিকিপোরা সোগাম, লালপোরা কুপওয়ারা, কানইয়াল বাগ বারামুল্লা, আর্মপোরা সোপোর, তারজু, বাতামালু, কামরিয়া গান্দেরবাল, সইবাঘ বুদগাম, মিরগুন্দ, সেইকপোরা এবং শ্রীনগরের বহু এলাকায়।
শনিবার নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে জখম পাঁচজনের হাসপাতালে মৃত্যু হয় রবিবার। রবিবার সন্ধ্যেবেলায় পুলিশ বাটামালুর টেঙপোরায় সাবির আহমেদ নামে এক যুবককে গুলি করে। যুবকটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে মারা যায়। অনন্তনাগের সঙ্গম-এ পুলিশের একটি বাঙ্কার গাড়িকে ঠেলে ঝিলাম নদীর জলে ফেলে দেয় প্রতিবাদীরা। ড্রাইভার আফরোজ আহমেদ মারা যায়।
কুলগাম জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর বুলেটবিদ্ধ হয়ে যে মহিলা মারা গেছেন, তার নাম ইয়াসমিনা।
উল্লেখ্য, শনিবার পুলিশ ও সিআরপিএফ-এর গুলিতে মারা গিয়েছে ১২ জন প্রতিবাদী যুবক।
বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা গৃহবন্দী, জম্মু কাশ্মীর সরকার তাদের সাহায্যপ্রার্থী
শনিবারই সৈয়দ গিলানী, উমর ফারুক, সাবির শাহ, নঈম খান, আসরাফ সেহরাজ, আয়াজ আকবর প্রভৃতি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতৃবৃন্দকে গৃহবন্দী করে সরকার। উল্লেখ্য, উপত্যকায় কোনো অশান্তি দেখা দিলেই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের গৃহবন্দী করার রেওয়াজ সরকারের। তারপর সাধারণত সপ্তাহখানিক পরে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়, তারা অশান্তির সময় পুলিশের গুলিতে নিহত যুবকদের বাড়ি গিয়ে আত্মীয় পরিজনদের সান্ত্বনা দিয়ে আসে। এটাই রেওয়াজ।
কাশ্মীরের পিডিপি-বিজেপি জোট সরকারের মন্ত্রীরা একটি মিটিং-এ বসে এবং উপত্যকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে।
পুলিশ থানা, সিআরপিএফ চৌকি ও প্রশাসনিক ভবনে দলবদ্ধ নিরস্ত্র ও সশস্ত্র হামলা
রবিবার ১০ জুলাই আশমুকাম এ একদল প্রতিবাদী মহকুমাস্তরের প্রশাসক এসডিপিও-র বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিজবেহেরায় হাসানপোরা আরওয়ানিতে একটি পুলিশ ক্যাম্পে আগুন লাগানোর চেষ্টা করে প্রতিবাদীরা। কুপওয়ারার লোলাব-এ প্রতিবাদীরা নিরাপত্তাবাহিনীর একটি বাঙ্কারে আগুন লাগিয়ে দেয়।
রবিবার সন্ধ্যেবেলা থেকে মিছিল কমে এলেও ইতিউতি দলবদ্ধ হয়ে হামলা এবং নিরাপত্তাবাহিনীর হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। পুলওয়ামার লসসিপুরায় জনতা একটি থানা আক্রমণ করে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। বিজবেহেরা রেলস্টেশনের আরপিএফ ব্যারাক এবং জিআরপি গার্ড রুম-এ আগুন ধরিয়ে দেয় দলবদ্ধ মানুষ। খুশিপোরার দামহাল পুলিশ পোস্টেও আগুন ধরিয়ে দেয়। সইবাগ থানার পুরনো বাড়িটিতেও আগুন লাগিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। দমকলের গাড়ি আগুন নেভাতে যাওয়ার পথে আক্রান্ত হয় বিজবেহেরায়।
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সাথে সাথেই জঙ্গীরা গুলি ও গ্রেনেড ছুঁড়তে শুরু করে পুলিশ ও সিআরপিএফ জওয়ানদের দিকে। মুরান চকে মোতায়েন সিআরপিএফ-দের দিকে দুটি গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। কিছু সিআরপিএফ জওয়ান আহত হয়। শোপিয়ান-এর পুলিশ সুপারের গাড়িতে গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। উত্তরেসুর পুলিশ পোস্টে গুলি ছোঁড়ে জঙ্গীরা।
সারা দিন ধরেই দফায় দফায় বিভিন্ন থানা ও পুলিশ এবং সিআরপিএফ চৌকিতে আক্রমণ করে উত্তেজিত জনতা। বহু পুলিশ ও সিআরপিএফ জওয়ান আহত হয়।
১১ জুলাই রাত্রিবেলা শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নাওহাট্টায় সিআরপিএফ ক্যাম্পে গ্রেনেড হামলা হয়েছে, তাতে এগারো জন সিআরপিএফ কর্মী আহত হয়েছে।
পুলওয়ামায় কইল এয়ার ফোর্স বেস-এও হামলা চালিয়েছে উত্তেজিত মানুষ। ঢিল ছোঁড়ার পর সেখানে জড়ো করা শুকনো ঘাস-পাতায় তারা আগুন লাগিয়ে দেয়।
কেন্দ্রীয় সরকার আরো ৮০০ সিআরপিএফ জওয়ান কাশ্মীরে পাঠাচ্ছে। উল্লেখ্য কাশ্মীর উপত্যকায় সামরিক ও এবং আধা-সামরিক বাহিনীর প্রায় পাঁচ লক্ষ জওয়ান মজুত আছে।
কাশ্মীরি প্রতিরোধ আন্দোলন প্রাণ ফিরে পেয়েছে : আন্দরাবি
বিচ্ছিন্নতাবাদী মহিলা সংগঠন দুখতারন-ই-মিলত এর কর্ণধার আসিয়ে আন্দরাবি রবিবার বলেছেন — “কাশ্মীরিদের ঘরে বা মসজিদে বসে থাকার সময় এটা নয়। কাশ্মীরি প্রতিরোধ আন্দোলনে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। ভারতীয় বাহিনীর ধারাবাহিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করতে পরামর্শ না দিয়ে, নেতৃত্বের উচিত এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া এবং একে মিলিয়ে যেতে না দেওয়া। ভারতীয় বাহিনী অন্তত ২১ জনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে একজন মহিলা, দুজন শিশু। … রক্ষণাত্মক হওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে। এখন আক্রমণাত্মক হওয়ার সময়।”
আসিয়ে আন্দরাবি বুরহান মুজাফফর ওয়ানি-র ভূয়সী প্রশংসা করেন — “প্রতিরোধ আন্দোলনে তার উদ্ভাবনী কায়দাগুলো অসাধারণ। সে কেবল সশস্ত্র সংগ্রামকে নয়া জীবন দেয়নি, এইসব কায়দার সাহায্যে এবং উত্তেজক বক্তৃতার মাধ্যমে সে কাশ্মীরিদের এক নায়কে পরিণত হয়েছে।”
বিজেপি জম্মু-কাশ্মীরের ভারপ্রাপ্ত নেতা রাম মাধব, ওয়ানি-হত্যার পর সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের প্রতিবাদ দমনের নয়া পদ্ধতি তৈরি করতে হবে, যাতে প্রাণহানি না হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত
সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব কাশ্মীর, অবন্তীপুরের ইসলামি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ১৮ জুলাই পর্যন্ত সমস্ত ধরনের পরীক্ষা, ভর্তি প্রক্রিয়া স্থগিত ঘোষণা করে দিয়েছে।
উপত্যকা জুড়ে মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা শনিবার থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ট্রেন চলাচলও বন্ধ শনিবার থেকে। অমরনাথ যাত্রাও স্থগিত আছে। উল্লেখ্য, বুরহান ওয়ানি মারা যাওয়ার আগে অমরনাথ যাত্রীদের অতিথি সম্বোধন করে নির্ভয়ে অমরনাথ যাত্রা করতে বলেছিল।
সোমবার ১১ জুলাই বিকেলে বিজবেহারার জিরপোরাতে পুলিশ প্রতিবাদী যুবকদের ওপর গুলি চালালে দুইজনের গুলি লাগে, একজনের পেটে, আরেকজনের বুকে। তাদের শ্রীনগরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে চিকিৎসার জন্য।
হাসপাতালে পুলিশ-সিআরপিএফ-এর হামলা
এর মধ্যে ১১ জুলাই বিজবেহারার এসডিএইচ হাসপাতালে ভাঙচুর চালিয়েছে সিআরপিএফ এবং পুলিশ। ডাক্তার এবং রোগী উভয়কেই মারধোর করা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনন্তনাগ-এর জেলাশাসকের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে।
জম্মু কাশ্মীর কোয়ালিশন অব সিভিল সোসাইটি নামে একটি নামকরা মানবাধিকার রক্ষা সংগঠন বিবৃতি দিয়ে বলেছে, প্রতিবাদী বাদেও সিআরপিএফ এবং পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় রোগী, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপরও হামলা চালাচ্ছে, যারা আহতদের চিকিৎসা করছে। শনিবার থেকে সোমবার — এই তিনদিনে অন্তত চারবার পুলিশ ও সিআরপিএফ হাসপাতালে রেইড করেছে।
শ্রীনগরের শ্রী মহারাজা হরি সিং হাসপাতালের ডাক্তারদের একটি সংগঠন, রেসিডেন্ট ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, হাসপাতালের মধ্যে কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। হাসপাতালের স্টাফদেরও হয়রানি করেছে।
শনিবার অনন্তনাগে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে একটি অ্যামবুলেন্সে আক্রমণ করে সিআরপিএফ জওয়ানরা। অভিযোগ, জানলার কাঁচ ভেঙে তারা আহত-র অক্সিজেন মাস্ক ও স্যালাইন-ও খুলে দেওয়ার চেষ্টা করে।
ডাক্তাররা জানিয়েছে, যাতে প্রাণহানি হয়, সেইজন্য শরীরের ঊর্দ্ধাঙ্গ লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। একটি মিডিয়া রিপোর্ট মোতাবেক, হরি সিং হাসপাতালে অন্তত সাতাত্তর জন এসেছে চোখে শটগান থেকে ছোঁড়া ছড়রা বুলেটের আঘাত নিয়ে। আঠারো জনকে অপারেশন করতে হয়েছে। এদের মধ্যে কেউই হয়ত আর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে না।
Leave a Reply