উত্তরপ্রদেশের লখনৌ শহরে রাম মনোহর লোহিয়া ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রী-হোস্টেলে মেয়েদের প্রবেশ করার নির্ঘন্ট নিয়ে একটি অপ্রত্যাশিত আন্দোলন হয়। কর্তৃপক্ষ ফরমান জারি করেছিল, রাত দশটার বদলে রাত সাড়ে ন’টার পর আর মেয়েদের বাইরে থাকা যাবে না, তার বিরুদ্ধে ছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করে। নিচে ওই ছাত্রীদের ২৫ নভেম্বরের প্রচারপত্রটি ছাপিয়ে দেওয়া হলো। বাংলা অনুবাদ করেছেন চূর্ণী ভৌমিক।
এই ২২শে নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী পড়ে গিয়ে হাত ভেঙ্গে ফেলে। তারপর তাকে মেয়েদের হস্টেলে নিয়ে যেতে যেতে রাত ১০-১৫ মত বেজে যায়। সেখানে পৌঁছানোর পরে তাকে ‘দেরি হওয়ার কারণ’ একটি আবেদন পত্রে লিখে জমা দিতে হয় । তাকে তারপর জানানো হয় যে হস্টেলে ফেরার নির্ধারিত সময় ১০টা থেকে কমিয়ে রাত্তির সাড়ে ন’টা করে দেওয়া হয়েছে (পরীক্ষা চলাকালীন এটা ঘটে যাতে আমরা ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ করতে না পারি)। এরপর তাকে হস্টেলে ঢুকতে দেওয়া হয় না, সে দরজার বাইরে বসে কেঁদে ফেলে এবং জিজ্ঞাসা করতে থাকে কেন তার সঙ্গে এরকম করা হচ্ছে। গার্ডেরা তাকে জানায় যে রোজকার মতই ম্যাট্রন তাঁর সঙ্গে চাবি নিয়ে ছাত্রীরা সবাই হস্টেলে সময়মত ফেরত গেছে কিনা যাচাই করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে টহল দিতে বেরিয়েছেন।
আমাদের সহকারী ওয়ার্ডেন শকুন্তলা সঙ্গম রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং তাঁর আদেশ মাফিকই চাবি দেওয়া হচ্ছিল না। আরেকজন ছাত্রকেও দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল, ১০-৪০ নাগাদ সে পরীক্ষার পড়া পড়বে বলে অনুরোধ করায় গার্ডদেরকে গেট খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। আমদের এতক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখার ফলে আমরা রাতের খাবার খেতে পাইনি কারণ ১০টার সময় সব খাবার মেসে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আমাদের বন্ধুটিকে যথাসময়ে ফার্স্ট এড দিতে না পারার জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে একটা ছোটখাট অপারেশন করতে হয়েছে, ওর একাধিক জায়গায় হাড় ভেঙ্গে গেছিল তাই হাতে রড বসাতে হয়। মেয়েদের হস্টেল থেকে তাকে ‘নিয়ম না মানার ‘ ও ম্যাট্রনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অপরাধে বহিষ্কার করবার নোটিশ দেওয়া হয় (তার দেরি করে ফেরার কারণটিকে ‘অজুহাত’ হিসেবে দেখায় কর্তৃপক্ষ) ।
আরও কিছু মেয়ে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে হস্টেলের ওয়ার্ডেন ডঃ বিশালাক্ষ্মী ভেগেস্না বলেন ‘এসব বিষয়ে তাদের মাথা না ঘামাতে’।
২৪শে নভেম্বর ছাত্রীরা রাত দশটা পর্যন্ত লাইব্রেরিতে কাটিয়ে সবাই মিলে সোয়া দশটায় হস্টেলে ঢোকে একথা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যে সময় নির্ধারণের নিয়মটি তারা মানছে না।
কর্তৃপক্ষ বলেছে হস্টেলে ঢোকার সময়টা দশটা থেকে কমিয়ে রাত সাড়ে ন’টা করার কারণ হল সাড়ে ন’টার পরে ক্যাম্পাসে “খারাপ ঘটনা” ঘটে।
গত তিনমাসে আমাদের ক্যাম্পাসে অসংখ্য সিকিউরিটি ক্যামেরা বসানো হয়েছে, প্রতি ২০ মিটার অন্তর, ক্যাম্পাস রক্ষীর সংখ্যা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। তা সত্বেও ‘নিরাপত্তা’র অজুহাতে নিজেদের হস্টেলেই বন্দি করে রাখা হয়েছে আমাদের যা আদতে নীতিপুলিশি। অন্যদিকে ছেলেরা ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাইরে অবাধ যাতায়াত করে সারারাত, রাত ৩টেয় বেরোলেও কোন অসুবিধে নেই।
রাতের বেলা যে রক্ষীরা থাকে তারা আমাদের হস্টেলে পাঠানোর সময় খারাপ ব্যবহার করে, সঙ্গে বিপরীত লিঙ্গের কোন বন্ধু থাকলে অপ্রত্যাশিত মন্তব্য করে। অযৌক্তিক পৌরুষ প্রদর্শনের উদাহরণ আরও আছে। একটি মেয়ে একটি প্রতিযোগিতায় যেতে হবে বলে তার পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিল। নিরাপত্তাকর্মিদের প্রধান, অগ্নি কুমার সিংহ সন্দেহ প্রকাশ করে ও তাকে বলে গেটের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে এবং তার বন্ধুটিকে তাড়িয়ে দেয়।
সংবিধানের Art 14, Art 21, Art 19 (1)(d), Art 21A; Art 38- ধারায় বলা আছে যে মৌলিক অধিকারগুলি আছে তা থেকে আমাদের বঞ্চিত করা এবং অমানবিক লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের এই প্রতিবাদ। আমাদের বাকস্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছে — যে মেয়েরা এই ব্যপক অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলছে তাদের পরীক্ষায় যথেষ্ট নম্বর দেওয়া হবে না বলে শাসিয়েছেন ওয়ার্ডেন।
আমরা তাই ঠিক করেছি, প্রতিদিন রাত ১০-৩০টা থেকে প্রতিরোধ অবস্থানে বসব, এবং অবস্থানের সময় পনের মিনিট করে বাড়াতে থাকব যতদিন না উপাচার্য আমাদের সঙ্গে এসে সরাসরি কথা বলে আমাদের দাবী মঞ্জুর করছেন ।
আমাদের প্রশ্ন হলও, আমাদের বাবা মায়ের দেওয়া পয়সায় লাগানো ক্যামেরা ও নিরাপত্তারক্ষীরা থাকা সত্ত্বেও আমাদের নিজেদের ক্যাম্পাসেও কি আমদের সুরক্ষিত থাকার জন্য দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মত দুর্ব্যবহার পেতে হবে?
একদিন রাত্রীকালীন অবস্থানের পরই ২৬ নভেম্বর রাম মনোহর লোহিয়া ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ছাত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। রাত সাড়ে ন’টার বদলে সাড়ে দশটা পর্যন্ত হোস্টেলে ঢোকা বেরোনো যাবে এবং সকালে সাড়ে ছ’টার বদলে সাড়ে পাঁচটার সময় হোস্টেলের গেট খুলবে — এই আশ্বাসের পর আপাতত আন্দোলন তুলে নেওয়া হয়। আন্দোলনরত ছাত্রীরা জানায়, পরের সেমেস্টারে ফের আন্দোলন শুরু করা হবে, রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত লাইব্রেরী খুলে রাখার দাবিতে এবং রাত বারোটা অবধি হোস্টেলের গেট খোলা রাখার দাবিতে।
সংবাদের সূত্র : ‘পিঞ্জরা তোড়’ -এর ফেসবুক পৃষ্ঠা। পিঞ্জরা তোড় একটি দিল্লি ভিত্তিক অটোনোমাস কালেকটিভ (স্বাধীন জোট) যারা দিল্লি শহরে ছাত্রীদের নিরাপদ, সস্তা ও লিঙ্গবৈষম্যহীন থাকার জায়গার খোঁজ রাখে।
Leave a Reply